বছর দশেক নিয়মিত তুষারপাত হয় না দার্জিলিংয়ে, পাখা-এসি ক্রমশ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে

ছেলেবেলার দার্জিলিংকে পাওয়া যাবে শুধুই অঞ্জন দত্তের গানে, আমার শৈশবের দার্জিলিংটা

 |  3-minute read |   22-07-2018
  • Total Shares

আপনারা যাঁরা কলকাতায় বা দক্ষিণবঙ্গে থাকেন তাঁরা প্রতিবছর বৈশাখ মাসে অধীর আগ্রহে কালবৈশাখীর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। গ্রীষ্মের প্রবল দহনে যখন আপনাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে তখনই স্বস্তির বাতাস নিয়ে হাজির হয় কালবৈশাখী ঝড়, সঙ্গে এক পশলা বৃষ্টি। নিমেষের মধ্যে তাপমাত্রার পারদটা অনেকটাই নামিয়ে দেয়। এর পর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আপনারা বর্ষার জন্য মুখিয়ে থাকেন। বর্ষার আগমন মানেই তাপমাত্রা নামবে, বাজারে ইলিশের দামও কমবে। সব মিলিয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে থাকবে।

আমার জন্ম-কর্ম বেড়ে ওঠা পাহাড়ে। শৈল শহরে দার্জিলিংয়ে, যাকে আপনারা পাহাড়ের রানি হিসাবে চেনেন। আর আমরা, দার্জিলিংয়ের বাসিন্দারা, প্রতি বছর শীতকালে তুষারপাত দেখব বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। আপনাদের ওখানে প্রতি বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণে তারতম্য থাকে। কিন্তু কম হলেও প্রতিবছরই বৃষ্টি হয়। এই তো গত কয়েকদিন ধরেই মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে কলকাতা ও শহরতলিতে। দার্জিলিংয়ের পরিস্থিতিটা একেবারেই ভিন্ন। তুষারপাত পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যতদূর মনে পড়ছে বছর দশেক আগে আমি শেষ বার দার্জিলিংয়ে তুষারপাত দেখেছিলাম।

body1_072218033011.jpgআমার জন্ম কর্ম বেড়ে ওঠা পাহাড়ে

ছেলেবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম তখন গরমকালের এক-দুটো মাস বাদ দিলে সব সময় গরম জামা-কাপড় ব্যবহার করতে হত। গরমকালেও আমাদের সঙ্গে থাকত হালকা উলের সোয়েটার। সামান্য বৃষ্টি পড়লেই তা গায়ে চাপিয়ে দিতে হত। আর এখন? শুধুমাত্র জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাস বাদ দিলে গোটা বছর গরম জামা-কাপড়ের প্রয়োজন পড়ে না। প্রায় সব বাড়িতেই পাখা রয়েছে এবং বছর ছয়-সাত মাস তা ব্যবহার করতে হয়। দার্জিলিংয়ের আবহাওয়া অনেকটাই বদলেছে এবং তা শুধু গত এক দশকে। ২১ শতকের শুরুর দিকেও যা ছিল ২০১৮ সালে আর তা নেই।

body3_072218033118.jpgকোনও ভাবনাচিন্তা না করেই বছরের পর বছর শহরের পরিবেশ নষ্ট করেছি, শহরের পরিবেশ দূষিত করেছি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দার্জিলিংয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? উত্তরটা খুবই সহজ - আমরা। আমরা, মানে আমরা যাঁরা দার্জিলিংয়ে থাকি। আমরা, মানে শহরের পুরপ্রশাসন থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসন অবধি সকল স্তরের আধিকারিকরা। কেন? কারণ আমরা কোনও ভাবনাচিন্তা না করেই বছরের পর বছর শহরের পরিবেশ নষ্ট করেছি, শহরের পরিবেশ দূষিত করেছি।

body_072218033135.jpgশহরে উঠে এসেছে শপিং মল

শেষ দশ বছরে দার্জিলিংকে চেনা দায়ে। প্রচুর গাছ কাঁটা হয়েছে। শহরের সেই ছোট ছোট কাঠের তৈরি বাংলো ধরণের বাড়িগুলোর অধিকাংশই ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার জায়গায় উঠে এসেছে একের পর এক বহুতল। ভাবতে পারেন শহরের উচ্চতম বাড়িটি তেরো তলা! ভাবতে অবাক লাগে, একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় কী ভাবে ১৩ তলার বাড়ি তৈরি অনুমোদন করা হল।

শহরে উঠে এসেছে শপিং মল। চালু হয়েছে সিসিডি, কেএফসি বা পিৎজা হাটের মতো বহুজাতিক সংস্থার ফুড চেনগুলো। এগুলোর বেশিরভাগই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। প্রয়োজন না পড়লেও। এর ফলে পরিবেশ আরও দূষিত হচ্ছে যার প্রভাব পড়ছে শহরের আবহাওয়ায়। বসতবাড়িগুলোতেও পাখার ব্যবহার হচ্ছে। সব চেয়ে বড় কথা, এখন তেমন ঠান্ডা পড়ে না বলে অধিকাংশ বাড়িতে ফায়ার প্লেস লোপ পেয়েছে। তার পরিবর্তে সকলেই রুম হিটার ব্যবহার করছে। এই প্রবণতার জন্যও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আবহাওয়ার উপর তার প্রভাব পড়ছে।

body2_072218033211.jpgবছর দশেক আগে আমি শেষ বার দার্জিলিংয়ে তুষারপাত দেখেছিলাম

শুনলাম, মানে খবর পেলাম, দার্জিলিংয়ের বাসিন্দারা নাকি বাড়ির জন্যও শীততাপ যন্ত্র কিনছে। তা যদি সত্যি হয়ে থাকে আর এই প্রবণতা যদি বাড়তে থাকে তাহলে কিন্তু কবরের শেষ পেরেকটা পোঁতা হয়ে যাবে। শৈলশহর হয়ে থাকবে দার্জিলিং, কিন্তু শৈলশহরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো আর থাকবে না।

আমাদের ছেলেবেলার দার্জিলিংকে তখন শুধুই পুরোনো ছবি আর অঞ্জন দত্তের গানে খুঁজে পাওয়া যাবে - 'আমার শৈশবের দার্জিলিংটা'।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SAILESH SARDA SAILESH SARDA

DARJEELING RESIDENT. THE WRITER IS THE OWNER OF NATHMULLS AND THE WHISTLING KETTLE.

Comment