ঢাকায় অ্যাপট্যাক্সি চালুর পর যে স্বস্তির বাতাস বয়েছিল তা অভিযোগের পাহাড়ে চাপা পড়ে গেছে

গণপরিবহণে জনভোগান্তির শহর ঢাকায় অ্যাপ ক্যাব নিয়ে অভিযোগ থাকলেও এর বিকল্প নেই

 |  6-minute read |   13-05-2018
  • Total Shares

যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্র্যান্সিসকো-ভিত্তিক অনলাইন ট্র্যান্সপোর্টেশন নেটওয়ার্ক কোম্পানি উবার ঢাকায় চলছে প্রায় দেড় বছর। অল্পদিনেই রাজধানীর মধ্যবিত্তের মধ্যে গ্রহণযোগ্য পরিবহণ হয়ে উঠেছে উবার। ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকার রাস্তায় নেমেছিল ভাড়ায় চালিত গাড়ির মোবাইল অ্যাপভিত্তিক এই পরিষেবা। যাত্রীদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়ার পর উবার ঢাকায় ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল পরিসেবাও শুরু করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্য একটি অ্যাপভিত্তিক সেবা 'পাঠাও'-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে উবারের। ঢাকায় সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামেও উবার চালু করেছে এই সংস্থা। তবে উবার ব্যবহারকারীরা অনেকেই সুবিধার পাশাপাশি সমস্যার কথাও জানিয়েছেন। বিশেষত চালকদের স্বল্প দূরত্বে না যাওয়ার প্রবণতায় উদ্বিঘ্ন ব্যবহারকারীরা। অনেক ক্ষেত্রে দূরত্ব ভেদে ভাড়ার পরিমাণ নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে।

ঢাকায় দিনদিন বাড়ছে উবার ব্যবহারকারী

বর্তমানে উবার বহরে ঢাকায় কতগুলো গাড়ি যুক্ত আছে- উবার কর্তৃপক্ষ তার সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। তবে সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রায় দেড় বছরে ঢাকায় উবার বহরে যুক্ত হয়েছে পাঁচ হাজারের অধিক প্রাইভেট কার। বর্তমানে উবার ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে দশ হাজার হাজার ট্রিপ দিচ্ছে। সপ্তাহের প্রথম ও শেষ দিনে ট্রিপ সংখ্যা আরও বাড়ে। চালুর পর প্রথম বছরে ঢাকায় উবারের ট্রিপ সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ৮০ হাজার। প্রতি ট্রিপে ন্যূনতম একজন যাত্রী হিসেবে মোট ট্রিপ সংখ্যার সমান অর্থাৎ ১০ লাখ ৮০ হাজার যাত্রী উবার সেবা নিয়েছেন। এ সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে।

স্বস্তি ও শান্তির উবার

সিএনজি অটোরিকশা চালকদের দৌরাত্ম্য ঢাকায় দীর্ঘদিনের। তাদের আচার-ব্যবহারে অতীষ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষ। তাদের হাত থেকে বাঁচতে যখন উদ্গ্রীব ছিল ঢাকার মানুষ, তখনই অবতার হয়ে আসে উবার। ঢাকায় উবার ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগই সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকুরে। তা ছাড়া ব্যবসায়ী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই পরিষেবা নিচ্ছেন। ব্যবহারকারীরা জানান, উবার অনেক বড় স্বস্তি দিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় সিএনজি অটোরিকশা চালকদের দৌরাত্ম্য থেকে তারা অনেকটাই রক্ষা পেয়েছেন উবারের কল্যাণে। ভাড়া ৫০ টাকা বেশি হলেও অনেক শান্তিতে যেতে পারছেন তারা।

উবার ব্যবহারকারী মামুন বলেন, ঢাকা এমন শহর যেখানে সামান্য যে কয়েকটি ট্যাক্সি ক্যাব চলে, সেগুলো মধ্যবিত্তের নাগালের একেবারে বাইরে। তা ছাড়া বেশি ভাড়া নিলেও এগুলোতে সেবার মান ভালো নয়। আর এমন কেউ নেই, যার সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে চরম ভোগান্তির অভিজ্ঞতা নেই। এর মধ্যে উবার অন্যরকম স্বস্তি নিয়ে এসেছে। নাঈমা নামক আরেক ব্যবহারকারী জানান, উবার ডেকে পাননি এমন অভিজ্ঞতা তার নেই। তিনি খুব সন্তুষ্ট উবার পরিষেবা নিয়ে।

ভোগান্তি বেশি!

উবার নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই ঢাকায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের খবরেও আছে উবারের ভোগান্তির খবর। বিশেষ করে চালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগই বেশি।

body_051318055644.jpgউবার নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই ঢাকায়

উবারে ভোগান্তির শিকার গণমাধ্যমকর্মী সাজেদা পারভিন সাজু তার ফেসবুক পেজে অভিযোগ করেন, সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় তিনি অফিস থেকে ধানমন্ডি মডার্ন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য উবার কল করেন। যখন গাড়িতে ওঠেন তখন দেখেন গাড়িতে হেডলাইট নেই। এর প্রতিবাদ করলে চালক বাজে কথা বলতে শুরু করে আর গাড়ি এলোমেলো চালাতে থাকে। যখন তিনি গাড়ী ঠিক করে চালানোর কথা বলেন তখন চালক বলেন, "আপনাকে আমি নামতে দিলে তো! যখন তিনি পুলিশকে কল করার কথা তখন বলে- করেন আমাকে কি করে দেখি।" এর মধ্যে সে হঠ্যাৎ ব্রেক কষলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়েন সাংবাদিক সাজু।

মোহাম্মদ জাহিদ নামে এক উবার ব্যবহারকারী বলেন, একবার আমার থেকে নির্ধারিত ভাড়ার বেশি নিয়েছে। যা রেট দেখে ডেকেছি নামার সময় মিটারে তার বেশি শো করেছে। বলেছে স্যার ওয়েটিং চার্জ আছে। বেশি বিল আদায়ের অভিযোগ করেছেন বেলাল বিন কাসেম নামে এক সরকারি চাকুরে উবার ব্যবহারকারী।

জোবায়দুল হাসান নামে মফস্বল শহরের এক গণমাধ্যমকর্মী অভিযোগ করে বলেন- আমি উবারের চালকের দ্বারা হয়রানি ও প্রতারনার শিকার হয়েছি। আমি থাকি পটুয়াখালীতে। মাস তিনেক আগে কাজে এক বার ঢাকায় গেলাম। সে সময় উবার ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়েছি। তাছাড়া ওদের সার্ভিসও আমার ভাল লাগেনি। প্রতারণা করল আমার সঙ্গে। অ্যাপসে যা টাকা দেখলাম, গন্তব্যে গিয়ে ওদেরটায় টাকা বেশি শো দেখিয়ে হাতিয়ে নিল। মনে হচ্ছিল, যেন এদের কোন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই। অসহায়ের মত বেশি দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।

আরেক বেসরকারি চাকুরে রাশেদুল হাসান জানান, উবার ডাকার পর মাঝে মধ্যেই কিছু সমস্যা হয়। যেমন, তিনি স্মার্টফোনের অ্যাপ থেকে উবারে আরোহণ (পিকআপ) নিশ্চিত করার পর ড্রাইভারকে ফোন করলে বেশিরভাগ ড্রাইভারই গন্তব্য জানতে চান। অনেক চালকই গন্তব্য জানার পর যাবেন না জানিয়ে কল কেটে দেওয়ার জন্য বলেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী যেতে না চাইলে চালকেরই ট্রিপ বাতিল করে দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা নিজেরা তা না করে যাত্রীর উপর চাপাচ্ছেন। একবার কল দিলে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় পর যাত্রা বাতিল করলে গ্রাহককে ৩০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। তিনি জানান, একাধিকবার তাকে এ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। কবি শ্রুতি খান, বেসরকারি চাকুরে হাসানুজ্জামান সুমন, আইনজীবী আনাম সরকার, সাংবাদিক রবিউল ইসলামেরও অভিযোগ উবারের পরিষেবা নিয়ে।

চালকরা যা বললেন

বিড়ম্বনার অভিযোগ রয়েছে চালকদেরও। চালক আরমান জানান, অনেক সময় তাদের দূর থেকে যাত্রী নিয়ে আসতে হয়। যানজটের কারণে এ ধরনের ট্রিপে সমস্যায় পড়েন তারা। অনেক সময় যাত্রীরা ভুল লোকেশন দেওয়াতে যাত্রী পরিবহণে সমস্যা হয় তাঁদের।

চালক রিপন জানান, এক গন্তব্যের কথা বলে কোনও কোনও যাত্রী গন্তব্যের আগেই নেমে যাচ্ছেন। এতে যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। কোনও কোনও যাত্রী কম ভাড়া দেওয়ারও চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, দু-একজনকে নিয়ে এ রকম সমস্যা হয়। তবে বেশির ভাগ যাত্রীই ভদ্র।

যৌন হয়রানির অভিযোগ

উবার অ্যাপ নির্ভর যান্ত্রিক সেবা। রয়েছে পরিপূর্ণ পর্যবেক্ষণের সুযোগ। তারপর যাত্রা শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই সেবা নিয়ে উঠেছে অনিমের এর অভিযোগ। নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর অভিযোগ থেকে শুরু করে সময় মেনে না চলার মত ছোটখাট বিষয় লিপিবদ্ধ হচ্ছে এই সেবার অভিযোগের তালিকায়। রাজধানী ঢাকায় মুঠোফোনের ট্যাক্সিসেবা উবার চালু হলে যে স্বস্তির বাতাস বয়েছিল তা অনেকটাই অভিযোগের পাহাড়ে চাপা পড়ে গেছে। এ ধরনের সেবাকে নিয়ম নীতির আওতায় আনতে আইন/নীতি চালু হওয়ার আগেই যাত্রীদের অভিযোগে সরগরম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমগুলো।

কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এর সংবাদ উপস্থাপক আঁখি ভদ্র তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে উবারের সেবা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, ‘একজন নিয়মিত উবার ব্যবহারকারী হিসেবেই বলছি, উবার জাস্ট নষ্ট হয়ে গেছে। বেশিরভাগ চালকের ব্যবহারই মারাত্মক খারাপ। শুধু নিজের শান্তি নষ্ট করতে চাই না বলে এদের সঙ্গে কথায় জড়াই না। আজ থেকে উবার ত্যাগ করলাম।’

কেবল আঁখি ভদ্রই নন, একই ধরনের অভিযোগ করছেন আরও অনেক যাত্রী। উবার চালকদের ব্যবহার নিয়ে নারী যাত্রীদের নানান ধরনের অসন্তোষ রয়েছে।

সম্প্রতি এক নারী যাত্রী উবার চালকের বিরুদ্ধে হস্তমৈথুনের অভিযোগ তোলেন। তার অভিযোগে সাড়া দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয় উবার কর্তৃপক্ষ এবং চালককে বরখাস্ত করা হয়।

বিরক্ত গাড়ি মালিকরাও

কেবল যাত্রীদের নয় উবার নিয়ে রয়েছে গাড়ি মালিকদের ও অভিযোগ। ফেসবুকে একজন গাড়ির মালিক লেখেন ‘উবার এ গাড়ি দেওয়া মানে ড্রাইভারদের পকেট তাজা, গাড়ির গ্যারেজের ইনকাম উবার আসার আগের চেয়ে দ্বিগুণ। আর গাড়ির মালিকের হতাশা।’

উবারে গাড়ি দিয়েছেন এমন অন্য একজন মালিক জানান চালক অল্প শিক্ষিত হওয়ায় তার ফোনের বিল বেশি আসে। আবার এক ট্রিপ থেকে অন্য ট্রিপ ধরতে যে দুরত্ব সে খরচও মালিকের তার, উপর উবার ৩০ শতাংশ টাকা কেটে রাখে কমিশন হিসেবে। ফলে আদতে যত লাভের কথা বলা হচ্ছে তার কিছুই হচ্ছে না। সে কারণে আমি গাড়ি প্রত্যাহার করে নিয়েছি।

চাই সমস্যার সমাধান

গণপরিবহণে জনভোগান্তির শহর ঢাকায় উবার বা এধরনের সেবা নিয়ে অভিযোগ থাকলেও এর বিকল্প নেই। উবার কর্তৃপক্ষের কাছে সব বিষয়ে অভিযোগ করার সুযোগ থাকলে ঝামেলা এড়াতে অনেক যাত্রী সে পথে যান না। তবে তাদের আশা যে সব অভিযোগ আছে তা যথাযথ ভাবে সমাধান করে সেবার মান আরো বাড়ানো উচিৎ উবারের।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SAHIDUL HASAN KHOKON SAHIDUL HASAN KHOKON @hasankhokonsahi

Bangladesh Correspondent, TV Today.

Comment