তিলোত্তমা কলকাতা কতটা প্রতিবন্ধী-বান্ধব?
আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী আইন নিয়ে আলোচনা সভা বসলেও প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করা হয় না
- Total Shares
আচ্ছা, শীতের দুপুরে বইমেলায় যেতে কার না শখ হয়? কলকাতাবাসী মানুষের কাছে বইমেলার মতো বড় আকর্ষণ আর কী আছে? বই পড়তে ভালোলাগা, এক জায়গায় অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ, এমনকি যে ফুডস্টল নিয়ে এত সমালোচনা, সেই খাবারের স্টলের প্রতি উৎসাহ তো কম নেই আমাদের। তা ছাড়া আমরা গর্বও করি যে কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলাগুলির মধ্যে অন্যতম। কিন্তু কাদের জন্য এই বইমেলা? শুধুমাত্র শারীরিক ভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য?
কিছুদিন আগেও বইমেলার ওয়েবসাইটে লেখা ছিল যে যাঁদের চলাফেরার অসুবিধা আছে তাঁদের জন্য বইমেলায় থাকবে হুইলচেয়ার ও ব্যাটারিচালিত ছোট গাড়ি। অথচ কসবার অনুরাধা দেবী তার ৭০ বছরের মাকে বইমেলায় নিয়ে গিয়ে হতাশ শয়ে ফিরে এলেন কারণ ওই সব কথা ওয়েবসাইটে লেখা থাকলেও আসলে ব্যবস্থা ছিল না। বইমেলার বাইরে বসা গার্ড হতবাক এমন ব্যবস্থার কথা শুনে, আর ভিতরের অফিসে এই প্রশ্ন করলে অনুরাধা দেবীকে শুনতে হয় বিদ্রূপ।
অনুরাধা দেবী নিজে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় অফিসার, আমাদের কাছে ফোন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, বলেন মা সারাদিন একা থাকেন, বই পড়তে ভালবাসেন, ভেবেছিলাম একটা শনিবার অন্তত মাকে একটু আনন্দ দিতে পারব। প্রতিবন্ধকতা-যুক্ত মানুষ বুবাই বাগ কলেজে পড়ান, তিনিও জানান যে বইমেলায় কোনও রকম সুযোগ সুবিধা তিনি পাননি। ক্র্যাচ–এর সাহায্যে অতিকষ্টে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন।
শিক্ষিত বা সচেতন মানুষরাও প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়টাকে এড়িয়ে চলেন [ছবি: পিটিআই]
শুধুই কি কলকাতা বইমেলা? কলকাতা শহর আসলে কতটা প্রতিবন্ধী-বান্ধব? দিল্লি মেট্রো বা চেন্নাই মেট্রো রেল শুরু থেকেই সুগম্যতাকে মাথায় রেখে কাজ করছে। কলকাতায় যখন মেট্রো রেল চালু হয় তখন এই ধরণের ইউনিভার্সাল ডিজাইনের কথা সত্যিই আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল না। কিন্তু যখন শুরু হয় দ্বিতীয় দফার কাজ, তখন তো ভারতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের জন্য আইন চালু হয়ে গেছে। আমাদের মত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বারংবার চিঠিচাপাটি পাঠানোর পরে কলকাতা মেট্রো কর্তৃপক্ষ আমাদের, বিশেষজ্ঞদের, ডেকে পাঠান। কিন্তু তা সত্বেও আমাদের দেওয়া স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সাল ডিজাইন মেনে নতুন মেট্রোর কাজ হয়নি।
যানবাহন, বইমেলা, বাড়িঘর কোনও কিছুতেই কি আমরা এতটুকু পরিবর্তন দেখেছি গত দশ বছরে? হ্যাঁ, শপিংমলগুলিতে সুগম রাস্তা, অর্থাৎ র্যাম্প, আছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ টয়লেটও আছে। কিন্তু নিজস্ব গাড়ি না থাকলে এঁরা শপিং মলে পৌঁছবেন কী করে? হুইলচেয়ার নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠতে চাইলে তার জন্য আলাদা ভাড়া দাবি করেছেন ট্যাক্সিচালক, এমন অভিযোগ বহু শোনা যায়। আর বাসের কথা ছেড়েই দিলাম, পাছে ভাড়া না দেন, সেই ভয়ে প্রতিবন্ধী দেখলে বাস দাঁড় করান না বাসচালকরা, এ অভিজ্ঞতা নিত্যদিনের।
টালিগঞ্জ থেকে কবি সুভাষ দ্বিতীয় দফার মেট্রোর কাজও স্ট্যান্ডার্ড উনিভার্সাল ডিজাইন মেনে হয়নি [ছবি: পিটিআই]
স্কুল-কলেজ সব জায়গাতেই চিত্র একই রকম। তাই হুইলচেয়ারে বসে যে পরীক্ষর্থী পরীক্ষা দিচ্ছেন কলকাতার সবথেকে নামকরা আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে তাঁর হাত থেকে প্রশ্নপত্র পড়ে গেলে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ঘরে কেউ থাকেন না। আর, তা তুলতে গিয়ে তিনিও পড়ে যান তাঁর হুইললচেয়ার থেকে। কিন্তু এই সব ঘটনা নিয়ে কোনও মামলা দাখিল হয় না, যদিও দেশে এখন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের জন্য আইন খুবই শক্তপোক্ত। আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাঁ চক্চকে সাদা বাড়িতে অবশ্য সেই আইন নিয়ে মাঝেমধ্যেই আলোচনা সভা বসে।
সাধারণ মানুষ থেকে যাঁরা শিক্ষিত বা সচেতন সবাই কেন জানি না প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়টাকে এড়িয়ে চলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দৃষ্টিহীন ছাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছিল- “দিদি আমরা তো ‘হোক কলরবে’ও হেঁটেছি, আবার ইউনিয়নের দাবিতেও সরব, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে সাধারণ ছাত্র ইউনিয়ন বেশি কিছু বলে না কেন?”
আমরা যারা কলকাতায় জন্মেছি, ভালোবেসেছি এই শহরটাকে, আমাদের গর্ব আছে শহরটাকে নিয়ে। যে শহর মানুষকে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় বলে খ্যাত, সেই শহরই অনেক সময় নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। একটু সংবেদনশীল হলেই কিন্তু এই পরিবর্তন আনা যায় আর কলকাতা সকল মানুষের জন্যই “আনন্দ নগরী” হয়ে উঠতে পারে।

