বাঙালির কাছে কি আকর্ষণ হারাচ্ছে ডুয়ার্স, নাকি দেখতে হবে অন্য চোখে?

জঙ্গল হিসেবে কৌলিন্য হয়তো নেই খুট্টিমারির, কিন্তু এর নিসর্গ অন্যরকম

 |  7-minute read |   23-06-2018
  • Total Shares

ডুয়ার্সে মশাই আছেটা কী? সেই একঘেঁয়ে গরুমারা, জলদাপাড়া, বক্সা। নয়তো সামসিং, সুন্থালেখোলা অথবা ঝালং, বিন্দু।

মানে ডুয়ার্স তার আকর্ষণ হারাচ্ছে?

তা নয়। তবে নতুন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আর তার নেই।

বেশ, এ বার একটু অন্য ভাবে দেখা যাক।

body4_062318040134.jpg

ক’দিন ধরেই মনটা উড়ু উড়ু করছিল। এই বিতর্কে সেটা আরও উস্কে গেল। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। তখনই শিলিগুড়ি থেকে ভ্রাতৃপ্রতিম কমলের ফোন। নর্থ বেঙ্গল ট্যুরিজমের কমল মুহুরী।

-রাজাদা তো ভুলেই গিয়েছেন। আমাদের এলাকায় তো আর আসছেন না?

-আসলে ডুয়ার্সের সবটাই তো ঘুরে দেখা তাই..

-চলে আসুন কথা দিচ্ছি হতাশ হবেন না।

ব্যাস আর যায় কোথায়। তরিঘড়ি টিকিট কেটে চেপে বসলুম পদাতিক এক্সপ্রেসে। পরদিন এনজেপি পৌঁছতেই একগাল হাসি সহ কমলের অভ্যর্থনা।

-দাদা কিছু খেয়েছেন?

-না। পথেই খাওযা যাবে। তা যাচ্ছি কোথায় সেটা তো বলবে?

-আপনার পছন্দসই কোথাও। আপাতত ধুপগুড়ি হয়ে গয়েরকাটা। তারপর দেখা যাক।

একটু রহস্য রেখে দেয় কমল। অগত্যা। যাত্রী সংখ্যা দুই। কমল আর আমি। কমলই ড্রাইভ করছে। পথে ফাটাপুকুরে যাত্রাবিরতি দিয়ে উপোষ ভাঙা হয়েছে গরমাগরম পুরী সহযোগে। ড্রাইভ করতে করতেই কমল এবার ঝুলি থেকে বিড়াল বের করে।

body2_062318040211.jpg

-রাজাদা খুট্টিমারি ফরেস্টের নাম শুনেছেন?

-হুঁ, কিন্তু সেখানে তো কিছুই নেই। জঙ্গল সাফারিও হয় না।

-এটা কিন্তু আপনার থেকে আশা করিনি দাদা। আপনি কবে থেকে টিপিক্যাল পর্যটক হয়ে উঠলেন বলুন তো?

আমি হেসে ফেলি। তাছাড়া কমলের উপর এই ভরসাটুকু রাখা উচিৎ ছিল। কথা ঘোরাই তাড়াতাড়ি।

-খুট্টিমারির কাছে রাভা গ্রাম আছে না?

-হ্যাঁ, খুকলুং আর মেলা নামে দুটো গ্রাম। আপনি জঙ্গল সাফারি বলছিলেন না? এই গ্রাম দুটোতে গেলেই আপনার জঙ্গল সাফারির সাধ মিটতে পারে।

কথায় কথায় ধুপগুড়ি ছাড়িয়ে গয়েরকাটা পৌঁছে গিয়েছি। ইতিমধ্যে কমল নেমে কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরেছে। গয়েরকাটা থেকে বাঁদিকে ঘুরতেই পাতলা হতে শুরু করল জনপদ। তারপর আচমকাই সবুজের প্রভায় স্নিগ্ধ হল চোখ।

-আপনার সামনেই খুট্টিমারি ফরেস্ট। ভিতরে ফরেস্ট বাংলোতেও থাকার ব্যবস্থা আছে তবে আপনার জন্য ব্যবস্থা এই রিসর্টেই।

body6_062318040253.jpg

রিসর্টের পরিবেশ দেখে মন ভাল হয়ে গেল। সামনেই শুরু সবুজের সমারোহ। তার ঠিক গা ঘেঁসেই বয়ে যাচ্ছে নাম না জানা এক তন্বী নদী। তন্বীদের মতনই তার কোমরের ভাঁজ। সময়টা পুজোর ঠিক আগে। বর্ষা যাই যাই করেও বিদায় নেয়নি এখনও। তারই ইঙ্গিত নদীর কলতানে। তাই সবুজেরাও আরও বেশি তাজা। মৃদুমন্দ বাতাসেও ভিজে ভাব। পুরো আকাশ ঢাকা না থাকলেও আকাশে জলভরা মেঘেদের ইতস্ত আনাগোনা। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পংক্তিটা তুলে ধরার লোভ সামলানো গেল না। “…এখানে মেঘ গাভীর মতন চরে”। সব মিলিয়ে ক্যানভাসে আঁকা নিখুঁত জলরঙা ছবি।

দুপুরে বেশ কব্জি ডুবিয়েই খাওয়া সারা হল। কমলের প্রস্তাব ছিল আমি যেন একটু গড়িয়ে নিই। আমার ধমক খেয়ে মত বদলাল। এই সময়ে এখানে একটা চিটপিটে গরম থাকে। ভোর রাতের এক পশলা যেন আমাদের রেহাই দিতেই কৃপা বর্ষণ করেছে। বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

সবুজ বনানীর বুক চিরে কালো ফাঁকা পিচ রাস্তায় সুযোগ বুঝে ৭০-এ তুলেছিল কমল গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা। আবার একটা সস্নেহ ধমক খেয়ে তড়িঘড়ি চল্লিশের আশপাশে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমি চল্লিশের বেশি গতিতে যাওযার বিরোধী, সে হাই-ওয়ে হলেও। দুটো কারণ। এক এই গতিতে গেলে আশপাশে চোখ চালালে জঙ্গলের বাসিন্দাদের ঝাঁকি দর্শন মিলতে পারে। এমন ঝুড়িঝুড়ি অভিজ্ঞতা আছে আমার ঝুলিতে। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটাই প্রধান। হঠাৎ যদি বন্যপ্রাণ উঠে আসে রাস্তায় গতি বেশি থাকলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ক্ষতি উভয় পক্ষেরই। মনে পড়ল কয়েক বছর আগে রাতের অন্ধকারে জয়ন্তী থেকে আলিপুরদুয়ার ফেরার পথে হেডলাইটের আলোয় আচমকাই চোখে পড়ে একটি শাঁখামুঠি (ব্যান্ডেড ক্রেট) রাস্তা পার হচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত গতি থাকায় সে যাত্রায় রক্ষা করা গিয়েছিল তার প্রাণ।

সন্ধানী দৃষ্টি চালিয়ে চলেছি পথের দুপাশের জঙ্গলের দিকে। এক্কা দোক্কা স্থানীয় মানুষ সাইকেলে যাতায়াত করছে এই জঙ্গল পথেই। খানিকটা এগোতেই কমলকে ইশারা করি গাড়ি থামাতে। ছোট্ট একটা কালভার্ট, তার তলা দিয়ে বয়ে যায় এক ঝোরা। সেই ঝোরার ধার বরাবর রাস্তা থেকে খানিকটা জঙ্গলের ভিতরে গোটা দুয়েক ইন্ডিয়ান গাউর (বাইসন)। তার মধ্যে একটা বুল। নিশ্চিন্তে ব্যস্ত ভোজন সারতে। কি পেশিবহুল রূপ। দৃষ্টি ফেরানো যায় না। মাঝে মাঝে পেশীর কুঞ্চনে হেলায় খেদিয়ে দেয় উত্যক্ত করতে থাকা মাছিদের। মিনিট পাঁচসাতেক দাঁড়িয়েছিলাম, তারপর আপন খেয়ালেই জঙ্গলের আরও ভিতরে প্রবেশ করে আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে অন্তর্হিত হল তারা। কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। বোধহয় তাদের একান্ত যাপনে অনাহুতদের উপর বিরক্তিতেই। কমলের ফিসফিসে সম্বিত ভাঙে আমার।

body5_062318040338.jpg

-আপনি লাকি রাজাদা, জঙ্গলে ঢুকতেই বাইসনের দর্শন।

আমি হাসি শুধু। ইশারায় এগিয়ে যেতে বলি। গতি পায় গাড়ি। পাখপাখালির গানের সঙ্গে ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন মিলে তৈরি হয় এক অনন্য যুগলবন্দি। আরও খানিকটা এগনোর পর জঙ্গল চিরে ডানদিকে চলে গিয়েছে গাড়ি চলার একটি পথ। তবে পাকা নয়। একেবারেই জঙ্গলপথ। মূলত বনকর্মীদের যাতায়াতের জন্য। কমল গাড়ি নিল সেই পথেই। খানিকটা এগোতেই বাঁদিকে বনদফতরের ছোট্ট অফিস সঙ্গে বনবাংলো। এখানেই থাকা যায়। আলাপ হল ফরেস্ট রেঞ্জারের সঙ্গে। হালকা ধমক দিলেন বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া ফরেস্টের এই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ার জন্য। পরে আমার সাংবাদিক পরিচয় আর বন্যপ্রাণ নিয়ে আমার উৎসাহ জেনে আমন্ত্রণ জানালেন এক কাপ চা পানের জন্য। তারপর নিজেই বললেন সোজা আরও খানিকটা এগোলেই পাবেন একটি ওয়াচটাওয়ার, লাক ট্রাই করতে বললেন। সঙ্গে একজন ফরেস্ট গার্ড দিতেও ভুললেন না অবশ্য।

জঙ্গল হিসেবে গরুমারা, জলদাপাড়া বা বক্সা টাইগার রিজার্ভের কৌলিন্য হয়তো নেই খুট্টিমারির, কিন্তু এর পরিবেশ মন মাতাতে কখনই ব্যর্থ হবে না। বন্যপ্রাণের মধ্যে হাতি, ভারতীয় গৌর (বাইসন), লেপার্ড, সম্ভর বা বার্কিং ডিয়ার উল্লেখযোগ্য। বরাতে থাকলে দেখা মিলতেই পারে। যেমন একটু আগেই হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে। তবে একান্ত যাপনে আগ্রহী হলে খুট্টিমারির এক রাত আপনাকে সবসময়ে আমন্ত্রণ জানাবে।

নিঃস্তব্ধ জঙ্গলের মাঝে একা এক নিঃসঙ্গ ওয়াচ টাওয়ার। উপরে উঠলাম। দারুণ একটা পরিবেশ। বুক ভরে টেনে নিচ্ছি জঙ্গলের বুনো গন্ধ। হাওয়ায় আন্দোলিত পাতারা শোনাচ্ছে প্রাকৃতিক সঙ্গীত, সঙ্গতে পাখিদের ডাকাডাকি। হঠাত্ই আলো পড়ে আসে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝি বেলা নয় মেঘেদের ঘনঘটা বেড়েছে আকাশে। গাছেদের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তার প্রমাণও মেলে। খানিকটা আরও সময় কাটালাম খুট্টিমারির গহনে। তারপর ফিরতি পথে। না, এখানে বন্যপ্রাণী দর্শনের সৌভাগ্য আর হয়নি। তবে পরিবেশটাই বা কম কী?

ফেরার পথে রেঞ্জার সাহেবের আতিথেয়তায় চা পানও হল। বাইরে তখন টুপফোঁটাদের আনাগোনা। তবুও আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য রাভা গ্রাম খুকলুং। রাভা জীবনের এক ঝলক ঝাঁকি দর্শন লাভের লোভে।

body1_062318040400.jpg

একটি মতে রাভারা আদতে পশ্চিম চিনের লোক। তবে তখন-ও চিন বলে কোনও একক দেশের অস্তিত্ব ছিল না। সে সময় ছিল সাং রাজবংশের শাসন। রাভাদের তখন দাস হিসেবেই কাজে লাগানো হত। সেই অত্যাচার থেকে বাঁচতেই ওরা ক্রমশই পশ্চিমমুখী হতে থাকে। অধুনা মিয়ানমার এবং ভারতের অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড হয়ে তারা ধীরে ধীরে মেঘালয়, অসম এবং উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলে প্রবেশ করে। শতকে পর শতক তাঁরা এই সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এই অনিশ্চয়তার কারণেই আজও তাদের নিজস্ব লেখ্যভাষা বা লিপি গড়ে ওঠেনি। কথ্য ভাষাতেও অন্যান্য আদিবাসী জনজাতির ভাষা এবং যে অংশে ওঁরা থিতু হয়েছেন, সেই আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে মূল শিকড়টা হারিয়ে যেতে বসেছে। নিজেদের আহরিত সংস্কৃতির মধ্যেই তাই তাঁরা আজ খুঁজে পেতে চায় নিজেদের শিকড়কে। তাঁদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যদি অন্য কোনও জনজাতির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে কিছু কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

খুকলুং গ্রামে প্রবেশ করে গাঁওবুড়াকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। পরিচয় শুনে যথা সম্ভব আপ্যায়ন করলেন। তবে দুঃখ প্রকাশ করলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেদিন পরিবেশন করতে পারবেন না বলে। যদি পরের দিন ফিরে আসি তবে সেটা করা সম্ভব। কিন্তু আমার সে উপায় নেই। অসমে বসবাসকারী রাভাদের মতন এঁরাও পান তাম্বুলে আপ্যায়ন করলেন। তারপর গাঁওবুড়ার গৃহিনী জানতে চাইলেন লাউপানি চলবে কিনা।

-লাউপানি এদের নিজস্ব ধারায় প্রস্তুত করা এক ধরণের রাইস বিয়ার। যেহেতু শতাব্দীর পর শতাব্দী এঁদের সমানে স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছ তাই অনেক কিছুর মতনই এঁরা দক্ষ কুম্ভকারও হয়ে ওঠেননি। তাই মাটির হাঁড়ির বদলে প্রাচীন পদ্ধতিতে শুকনো লাউয়ের খোলেই করা হত ফার্মেন্টেশনের কাজ। সেই থেকে এ পানীয়ের নাম লাউপানি। তবে এখন এঁদের অনেকেই বাজার থেকে মাটির হাঁড়ি কিনে ব্যবহার করেন। তা দেখবে নাকি চেখে?

সলজ্জ হাসি হেসে কমলের বিনয়ী প্রত্যাখ্যান।

-আপনি চালান দাদা, আমি ও রসে বঞ্চিত।

আমিও আর এক যাত্রায় পৃথক ফল হতে দিলাম না। তাছাড়া এর আগেও একাধিকবার লাউপানি স্বাদের সুযোগ আমার হয়েছে।

body3_062318040153.jpg

সন্ধ্যায় মেঘ কেটে চাঁদ ওঠে। সম্ভবত সদ্য গিয়েছে পূর্ণিমা। সদ্যস্নাতা জঙ্গলকে অন্যরকম লাগে। আলো-আঁধারীতে আরও রহস্যময়। নদীর জল স্থানে স্থানে ঝিকিয়ে ওঠে চাঁদের আলো মেখে। জঙ্গল থেকে ভেসে আসে হঠাত্ কোনো জান্তব চিত্কার। যার সাথে অন্যমাত্রা পায় রাতচরা পাখীদের ডাক। কী রকম যেন ঘোর লাগে মনে, দু-চোখে। আবার নতুন যাত্রা, নতুন গন্তব্য।

সে কথা আজ আর নয়।  কয়েকটা প্রয়োজনীয় তথ্য- বন দফতরের বাংলোয় মাত্র দুটোই রুম আছে। বন দফতরের মাধ্যমে সরাসরি বুকিং সম্ভব। গয়েরকাটার দিকে আছে রিসর্ট, হোম-স্টে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

RAJA MUKHERJEE RAJA MUKHERJEE

Travel & Wildlife Journalist

Comment