ঢাকায় সর্বজনীন পুজোর শুরু ৪৭ সালে, দেশভাগের পরে একক ভাবে পুজো করাটা ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে

বাংলাদেশে এবছর ৩৪ হাজার দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হবে, গত বছর সংখ্যাটা ছিল ২৯ হাজার ৭৪টি

 |  4-minute read |   10-10-2018
  • Total Shares

আকাশে-বাতাসে এখন শারদ উৎসবের শিহরণ। শিল্পী তার তুলির নিপুণ আঁচড়ে উদ্ভাসিত করে তুলছে মহিষাসুর মর্দিনীকে। কুমারটুলী থেকে প্রতিমার অধিষ্ঠান শুরু হয়েছে মন্ডপে। বোধনে খুলে যাবে তার আয়ত চোখের পলক। অসুর বধে চক্র, গদা, তীর-ধনুক, খড়গ-কৃপাণ-ত্রিশুল হাতে দেবী হেসে উঠবেন ধরাতে। সনাতন বিশ্বাসে, কৈলাশ শিখর ছেড়ে পিতৃগৃহে আসছেন মা দুর্গা।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে প্রতিবারের ন্যায় এবারও দূর্গাৎসব হচ্ছে মহা ধুমধামে। রাজধানীতে এবার ২৩৫টি মন্ডপে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার ঢাকায় ১৩ টি মন্ডপ বেড়েছে। এর মধ্যে আদি ঢাকার সুত্রাপুর থানায় সবচেয়ে বেশি, ৪০টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শেষ করেছন পূজার সকল প্রস্তুতি। দেবী দুর্গা ঢাকায় ঠিক কবে এসেছিলেন তা বলা বেশ শক্ত। ইতিহাস বলে- বল্লাল সেন চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। অর্থাৎ দেবী দূর্গা সে আমলে ঢাকায় অপরিচিত ছিলেন না। আবার ফাঁদ রয়ে যায়, বল্লাল সেনের ঢাকেশ্বরী মন্দির তৈরির ঘটনাও এখনো প্রমাণিত নয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রাচীন যে কাঠামো এখনো দাঁড়িয়ে তা কোনভাবেই কোম্পানি আমলের আগেকার নয়।

body_101018122155.jpgবাংলাদেশের এক পুজো মণ্ডপে [ছবি: এপি]

ঢাকার দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরোন তথ্য পাওয়া যায় অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের আত্মজীবনী থেকে। ১৮৩০ সালের সূত্রাপুরের একটি পূজার উল্লেখ করেছেন তিনি। প্রায় দোতলা উঁচু ছিল দুর্গা প্রতিমাটি। সে সময়ে নন্দলাল বাবুর মৈসুন্ডির বাড়িতে পূজাটি হয়েছিল। তবে এরপর আর কোন বিস্তারিত বর্ণনা নেই সে পূজার। এছাড়াও ইতিহাস বলে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের পূজাও এক সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে সময়ে গোটা বাংলাতেই ব্রাক্ষ্মণদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত। তবে কিছুকাল পরেই অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ব্রাক্ষ্মণদের আধিপত্য। অনেকে পুরোহিত ছাড়াই শুরু করে দেন পূজা। তবে সেটাও যে খুব একটা প্রচলিত রীতি ছিল তা নয়।

ঢাকায় দুর্গাপূজা সাধারণ্যে আসতে প্রচুর সময়ের প্রয়োজন পড়ে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকায় সময় কাটানো বিভিন্ন মানুষের আত্মজীবনী থেকেই। হৃদয়নাথ, গণিউর রাজা, বুদ্ধদেব বসুসহ গত শতকের শুরুর দিকে যারা ঢাকায় সময় কাটিয়েছেন, তাদের কারো লেখাতেই আসেনি দুর্গাপূজার প্রসঙ্গ। এমনকী ঢাকাবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের পুরনো ঢাকার উৎসব ও ঘরবাড়ি বইটিতে ঢাকার উৎসব হিসেবে ঈদ, মুহররম, জন্মাষ্টমী, হোলি ও ঝুলনের উল্লেখ রয়েছে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় দুর্গাপূজা বিংশ শতকের শুরুতেও ছিল পারিবারিক, অভিজাতদের মাঝে। অভিজাতদের বাইরে কেবল এর সার্বজনীনতা অর্থাৎ এখন যে ধরণের পূজা প্রচলিত, তা শুরু হতে গত শতকের তিরিশের দশক লেগে যায়। তবে সার্বজনীন পূজা ব্যাপক আকারে শুরু হয় ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর। দেশ ভাগের পর এককভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্রাক্ষ্মণ-অব্রাক্ষ্মণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়। তবে এখনো পারিবারিক পূজার চল রয়ে গেছে পুরোন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। ৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিংবদন্তীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় দেশের কেন্দ্রীয় দুর্গা পূজা।

body1_101018122257.jpgঐতিহ্যশালী বনানী পুজোর পুজো মণ্ডপ [সৌজন্যে: ইউটিউব]

প্রথমদিকে যেহেতু কেবল বাবুগিরি আর ইংরেজদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্যই পালিত হত এ উৎসব, সে কারণেই ধর্মীয়ভাবের চেয়ে সেখানে বেশি প্রাধান্য পেত আমোদ-প্রমোদ। কিন্তু বিত্তবান বাবুরা দুর্গোৎসবের যে জোয়ার আনতে চেষ্টা করেছিলেন তাতে পাঁক ও আবর্জনাই ছিল বেশি। বাবুদের অর্থকৌলিন্য প্রকাশের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা লাভের উপায়ও ছিল এ উৎসব। কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নক্সায় ঢাকায় দুর্গাপূজার বর্ণনায় এসেছে বাঈজি নাচ, খেমটা নাচ, কবিগান, কীর্তনের। পূজায় ইংরেজদের আপ্যায়ণের জন্য প্রস্তুত থাকত ব্র্যান্ডি, শেরি, শ্যাম্পেন। হাকিম হাবিবুর রহমানের ঢাকা পচাস বারাস পেহলে বইতে উল্লেখ আছে যেকোন হিন্দু উৎসবে বাঈজি, খেমটা, সং আর গাঁজার আসর বসতই। আর নেশার চল এমনই ছিল যে, চুরুট তামাক ও চরসের ধোঁয়ায় প্রতিমাই ঢাকা পড়ে যেত।

এখন পূজা অনেক ভদ্রস্থ। মূলত পুরোন ঢাকার শাঁখারি বাজার এলাকায় মেলা বসে। প্রবেশ পথেই থাকে বেশ কিছু গজা, মুরালি, সন্দেশের মত মিষ্টান্নের দোকান। নাগরদোলা তো যেকোন মেলার প্রাণ। আর শাঁখারি বাজার, তাঁতী বাজার, সূত্রাপুর এলাকা ভরে যায় মন্ডপে। এলাকার মন্দিরগুলোও সাজানো হয়। তবে প্রতিমার স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় প্রায়ই প্রতিমাগুলোকে রাস্তায় উঁচু মঞ্চের উপর বসানো হয়। নিচ দিয়ে মানুষের ভীড়। মন্দিরগুলোতে পুরুত ঠাকুর বসে প্রণামী নেন, প্রসাদ দেন দেবী-ভক্তদের। এর বাইরে ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি সার্বজনীন পূজার আসর করা হয়। তবে সার্বজনীন পূজার আরো একটি সম্ভ্রান্ত রূপ এখন দেখা যায় বনানী মাঠে। বনানী মাঠে এ পূজার চল বেশিদিন আগের নয়। বড়জোর ৭-৮ বছরের। সনাতন ধর্মের অনুসারী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পদচারণায়, তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালায় এ পূজা এখন অন্যতম আকর্ষণ ঢাকার। মূলত গুলশান, বনানী, উত্তরার হিন্দুরাই এ মেলার মূল আয়োজক। পুরোন ঢাকার পূজামন্ডপে যেমন পাওয়া যায় ঐতিহ্যের আর ইতিহাসের, সেখানে বনানী মাঠেরটিতে খোঁজ মিলে আধুনিকতার।

এবছর রাজধানীর কয়েকটি পূজার মন্ডপ ঘুরে জানা গেছে, রমনা কালী মন্দিরে এবার দুর্গাদেবীকে সবার চেয়ে আলাদাভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন মন্ডপের চেয়ে রমনা কালী মন্দিরের ঐতিহ্যও দীর্ঘদিনের। তাই তাদের চ্যালেঞ্জটাও একটু বেশি। দেশের প্রধান পূজামন্ডপ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মন্ডপে প্রতীমা বরাবরের মতই হয়ে উঠেছে আকর্ষনীয়। পরানো হয়েছে দামি দামি বস্ত্রালঙ্কার। বনানীর পূজামন্ডপে লাগানো হয়েছে রকমারি ঝিলিকবাতি। বিশাল পরিসরে বসানো হয়েছে প্রতিমা। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য করা হয়েছে আলাদা পার্কিং। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার ও আশপাশ ঘিরে তৈরি হয়েছে একাধিক পূজার মন্ডপ। শারদীয় উৎসবে আইনশৃঙ্খলার যেন কোনো অবনতি না ঘটে সেজন্য পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা।

বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ হাজার পূজামন্ডপে চলছে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি। গত বছর ২৯ হাজার ৭৪টি পূজামন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SAHIDUL HASAN KHOKON SAHIDUL HASAN KHOKON @hasankhokonsahi

Bangladesh Correspondent, TV Today.

Comment