লুকনো ঐতিহ্যের কথা: কলকাতায় একটুকরো মিয়ানমার

শহরের কোলাহলের মধ্যে একটুকরো শান্ত জায়গা, ভিতরে বর্মামুলুক

 |  3-minute read |   21-12-2018
  • Total Shares

মিয়ানমার বললে এখন প্রথমেই মনে আসে রোহিঙ্গাদের কথা, তারপরেই সু চি... আগে অবশ্য মিয়ানমার বলতে প্রথমে মনে পড়ত সু চির কথাই, তারপরে জুন্টা সরকার। তারও আগে এই দেশটার নাম ছিল বর্মা বা ব্রহ্মদেশ, মানে বর্মামুলুক। সেই মুলুকের সঙ্গে বাংলার আঁতের টান আছে। কত লোক যে সেখান ঘুরে এখানে এসেছেন! শ্রীকান্তের কথাই ধরুন না, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত।

এক টুকরো বর্মা রয়েছে এই কলকাতার বুকেও। লোকে যখন চিড়িয়াখানায় ভিড় করে কিংবা আইপিএলের সময় যখন ইডেন গার্ডেন ভেঙে পড়ে তখনও সে পড়ে থাকে একাই। সারা বছর ধরে সংস্কারের কাজ চলেছে এই বর্মামুলুকে, অন্তত নিন্দুকে তেমনই বলে।

dsc_0779_122118080016.jpgসংস্কার হয়ে চলেছে প্যাগোডায় (ছবি: লেখক)

প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে এই প্যাগোডাটি বর্মার কোনও প্যাগোডার আদলে তৈরি হয়নি। বর্মার প্রোম শহর থেকে সালঙ্কার প্যাগোডাটি ১৮৫৪ সালের অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে খুলে আনা হয়েছিল এবং ১৮৫৬ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে এটি পুনর্নির্মাণ করা হয় কলকাতায়, একটি উদ্যানের মধ্যে। প্রতিষ্ঠালিপি থেকে এ কথা জানা যায়। প্যাগোডাটি পুনর্নির্মাণের পরে তা আবার জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৭২ সালে, তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তবে সেই ফলকটি এখন বেহাল, বেশ কষ্ট করেই পাঠোদ্ধার করতে হয়।

dsc_0804_122118080222.jpgপ্যাগোডা পুনর্নির্মাণের প্রতিষ্ঠালিপি। (ছবি: লেখক)

dsc_0805_122118080255.jpgসংস্কারের পরে লাগানো ফলক, কালো অংশ খসে গেছে। (ছবি: লেখক)

এ বার আসা যাক প্যাগোডাটি যে বাগানে, সেই বাগানের কথায়। ইতিহাসের শুরু ভারতের গভর্নর জেনারেল মানে বড়লাট অকল্যান্ডের সময়ে। তিনি ১৮৩৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ছিলেন এ দেশে। তাঁরা ছিলেন ১৪ জন ভাইবোন। তাঁর দুই বোন এমিলি ও ফ্যানি ভারতে এসে বেশ কিছুদিন ভাইয়ের কাছে ছিলেন। তখন কোম্পানি আমল, কোম্পানিশাসিত ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। স্বভাবতই তাঁরা কলকাতাতেই ছিলেন।

ছোট থেকেই বাগানের খুব শখ ছিল এমিলির, তাঁর ইচ্ছাতেই শুরু হয় বাগান তৈরির কাজ। স্থপতি ক্যাপ্টেন ফিতৎগেরাল্ড তাঁদের ভাবনা বাস্তবায়িত করেন। ১৮৪০ সালেই তৈরি হয়ে যায় অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন, পরে অবশ্য নাম বদলে তা করা হয় ইডেন গার্ডেন্স। লর্ড অকল্যান্ডের আসল নাম জর্জ ইডেন, তিনি ছিলেন অকল্যান্ডের প্রথম আর্ল, তাই তিনি লর্ড অকল্যান্ড নামেই খ্যাত। তাঁর বাবার নাম উইলিয়াম ইডেন।

dscn1706_122118081111.jpgইডেন গার্ডেন্সের ভিতরের দৃশ্য (ছবি: লেখক)

কলকাতা হাইকোর্টের অদূরে ও ক্রিকেট মাঠ ইডেন গার্ডেন লাগোয়া এই উদ্যানে লোকের আনাগোনা নেই বললেই চলে। বাগান খোলা থাকে দুপুরে, তখন ভিতরে ঘুরে বেড়াতে বাধা নেই। প্যাডোর দু’পাশে একটি করে জলাশয় আছে, অত্যন্ত মনোরম। প্যাগোডা থেকে একটি জলাশয়ে যাওয়ার পথে সেই বর্মামুলুক থেকে আনা মূর্তি সাজানো হয়েছে।

dsc_0798_122118081335.jpgবর্মা থেকে আনা মূর্তি (ছবি: লেখক)

তাজং স্টাইলে তৈরি এই সদ্যসমাপ্ত প্যাগোটি লর্ড ডালহৌসির চোখে পড়ে যখন তিনি প্রোম শহর দখল করেন। এমন সুন্দর কারুকাজ করা স্থাপত্য তো রাজধানীর বুকেই মানায়! ডালহৌসির নির্দেশেই সেই স্থাপত্য খুলে ফেলে কলকাতায় আনা হল এবং পুনর্নির্মাণ করা হল। প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ামে খণ্ডাংশগুলি রাখা ছিল, তার পরে বর্মামুলুক থেকে আনা কারিগররা এটি স্থাপন করেন ইডেন গার্ডেনের ভিতরে। মূল প্যাগোডাটি তৈরি হয়েছিল ১৮৫২ সাল নাগাদ, প্রোমের প্রয়াত শাসক মং হননের স্ত্রী মা কিন এটি স্থাপন করিয়েছিলেন। খরচ পড়েছিলন তৎকালীন সময়ে দেড় হাজার টাকা। 

বাগানের ভিতরে একটি নহবৎখানাও রয়েছে। তবে পুরনো কলকাতার নহবৎখানার মতো এখানে সানাই বাজত কিনা জানা নেই, সম্ভবত পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আসরই এখানে বসত। রয়েছে একটি সুন্দর ফোয়ারাও।

dscn1705_122118081043.jpgইডেন গার্ডেনের ভিতরে নহবৎখানা (ছবি: লেখক)

এই বাগানে নানা প্রজাতির গাছ আছে। বিকেলের দিকে পাখির কলতান শোনা যায় এই বাগানে।

এখানে একটি জাপানি গার্ডেনও রয়েছে। যাঁরা এই শীতে বোটানিক্যাল গার্ডেন যাওয়ার কথা ভাবছেন তাঁরা একবার এখানে ঘুরে যেতে পারেন। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতো অত রকম গাছ দেখতে পাবেন না এখানে, সেই সেই সুবিশাল বটগাছও। সারাদিন কাটানোর মতো জায়গা এটি নয়। তবে কলকাতার মধ্যে চুপচাপ কয়েক ঘণ্টা কাটানোর জন্য এই জায়গাটি আদর্শ।

একটা কথা বলা হয়নি, মূল প্যাগোডার ভিরতে একটি বুদ্ধমূর্তি ছিল, যার কপালে ছিল একটি দামি পাথর। সেটির খবর আমার জানা নেই। 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment