এই প্রজন্মের বাঙালিদের বাংলা ভাষা আর টানে না কেন

নরমে গরমে দুগ্গা দুগ্গা করে সকল দুর্গতিকে সঙ্গে নিয়েই কেটে যায় আমার সাহিত্যের ক্লাস

 |  2-minute read |   24-08-2018
  • Total Shares

দ্বিধায় পড়লাম আবার।  প্রশ্নপত্রের মাথায় গিয়ে দেখলাম - হ্যাঁ, নিজের ভাষাতেই লিখতে বলা হয়েছে! ভুল তো করেনি সে।  'কর্ণকুন্তী সংবাদ'-এর উত্তরে কেবল লিখেছে - 'কর্ণ কুন্তীকে এবার ঝেড়ে কাশতে বললেন।'  - ফরেন্সিক টেস্ট ছাড়াই নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় যে এ ওর একান্ত সিগনেচার ল্যাঙ্গুয়েজ। 

খাতাটার একটা হেস্তনেস্ত করে পরের খাতায় গেলাম।  প্রথমেই 'কপালকুণ্ডলা'। বঙ্কিমী ভাষা।  আহা! কত কষ্টই না পেয়েছে বেচারারা এর মর্ম উদ্ধার করতে। গোটা নবকুমার চরিত্রে বার চারেক পুনরুক্তি পার করে এসে শেষ লাইনে পৌঁছলাম। 'বাংলা সাহিত্যে এমন ক্যালানে পাবলিক আর দুটো নেই।' কালজয়ী সাহিত্য আগামীকে ছুঁয়ে যায়... হাতে কলমে অনুভব করলাম।

সেদিন  'শেষের কবিতা' পড়িয়ে বেরনোর সময় কোনও আশা নেই জেনেও প্রশ্ন করলাম - 'কিছু জানার আছে আজকে যতটা পড়ানো হল তার থেকে?' অকস্মাৎ একটা হাত উঠল। নেহাত গোবেচারা, পড়ুয়া টাইপ এক ছাত্রী। আমি প্রায় গদগদ হয়ে তাকালাম তার দিকে।  - 'ম্যাম, এই যোগমায়া কি যোগমায়া দেবী কলেজের যোগমায়া?'  সত্যি ভাবা প্র্যাক্টিস করতে হয়ই বটে।

body_082418063912.jpgনতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষার প্রতি বিমুখ

এ ভাবেই নরমে গরমে দুগ্গা দুগ্গা করে সকল দুর্গতিকে সঙ্গে নিয়েই কেটে যায় আমার সাহিত্যের ক্লাস। আর প্রতিবারই ফিরে এসে ভাবি চোরাবালিটা ঠিক কোথায়? ভাষার এমন বিপর্যয় কোথা থেকে হল। মনে পড়ল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই গান - 'ওগো কাজলনয়না হরিণী...'।  আর তারপরই  'তোমার ঠোঁট দুটো ঠিক কমলা লেবুর কোয়া...' পরের লাইনটা হতেই পারতো - 'তোমার চোখ দুটো ঠিক জয়নগরের মোয়া...।"  দুই রূপই চাক্ষুষ একবার দেখতে ইচ্ছে করে! ভাবনার এই বিপর্যয় কবে ঘটল? 

নতুন 'বন্ধু' এখন হয় না আর।  নতুন 'ফ্রেন্ড' হয়। 'বর' কখন যেন 'হাবি' হয়ে যায়। চারদিক জুড়ে ভেঙে পড়ে আমার সংস্কৃতি।  আমি অসহায়ের মতো দেখি। ঠান্ডা ঘরে বসে দেশভাগের সিনেমা দেখি।  গলা কাঁপিয়ে ভাষা আন্দোলনের কবিতা পড়ি।  কপালে 'ৎ' লেখা টিপ।  পরনে পদাবলি লেখা শাড়ি।  সবই তো ঠিকঠাকই আছে। নিখুঁত ভাবে করছি। তাহলে? কুমীরটা ঢুকলো কোন খাল দিয়ে?

জীবনের বড় বড় ঝাপটাগুলোকে এড়াতে না পারলেও শেখার ক্ষেত্রটাতে সব কিছুকে সরল করে নিয়েছি আমরা ক্রমে। গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে বাঙালির মাত্রাজ্ঞানকে ছাড় দেবার মতো উদার, বহু খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।  আত্মবিশ্বাসহীন আমরা নিজের ঐতিহ্যকে ভুলতে চেয়েছি অতি দ্রুত। অপরকে গ্রহণের ক্ষেত্রে বাছবিচার রাখিনি কোনও।    

আমি বহুভাষা শিক্ষার বিরোধী নই। শুধু বলতে চাই আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ অপরকেও যোগ্য সম্মান করতে পারে না। অক্ষমের অনুকরণ প্রেমিকের মুখোশ পরে কেবল। প্রেমিকের হৃদয়কে চেনে না।  ফলে কোনও ভাষাতেই নতুন কোনও উত্তরণের পথ সংযোজিত হয় না। ভিড় বাড়ে কেবল। ইংরাজিতে আমরা গদগদ হই, তুলসীদাসে আত্মহারা। সব গ্রহণ করি। 'লুঙ্গি ডান্স'-এ নাচতে গিয়ে বোশেখ মাসের  পঁচিশ তারিখে ধুতির কোছাটা যে কখন খুলে যায় খেয়ালই থাকে না।  'সংসকিতি' চলতেই থাকে... চলতেই থাকে...   'চোখে আঙুল দাদা'রা এসব বললে তর্ক জুড়তে পারেন।  তর্কে ভয় পেয়ে বাঙালি জাতের কলঙ্ক আমি কখনই হব না। কিন্তু তবুও বলি, দাদাদের ভাষার সেই মিসাইল রোধ করবার বর্ম আমার নেই। তাই এসব কথা সামলেই চলি। 

তবু হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়ায় সেদিন আধুনিকা হাইহিল তরুণী সান্ত্বনা দিল  - 'আন্টি এ সব ভেবে পরেসন হয়ো না তো একদম...।' 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

RIYA CHAKRABARTI RIYA CHAKRABARTI

The writer is a Bengali professor and an acclaimed writer.

Comment