ফেসবুকের ডেটিং ফিচার চালু হলে কী ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য আরও আগলহীন হবে?
নিউস ফিড অংশে ডেটিং প্রোফাইল দেখা যাবে না, ফেসবুকের বন্ধুরা দেখতে পাবেন না
- Total Shares
অবশেষে হতে চলেছে। বহু কোটি টাকার ঘটকালির ব্যবসায় টিন্ডার এবং গ্রিন্ডারের মতো সংস্থাগুলির রমরমা হলেও, এবার সেই একই ব্যবসায় আসতে চলেছে ফেসবুক।
এই সপ্তাহের গোড়ার দিকে যে এফ৮ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে এই বিশাল সোশ্যাল মিডিয়া সাম্রাজ্যের সিইও বিশ্বকে জানিয়ে দেন যে ফেসবুকে একটি ডেটিং অ্যাপ যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন এই অ্যাপটির মাধ্যমে পাত্রপাত্রী খোঁজা যাবে আবার একজন ব্যক্তি তাঁর পছন্দ মতো আর একজন ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন। অ্যাপটির নাম ফেসবুক ডেটিং।
এই প্লাটফর্মে একজন ব্যক্তি বিভিন্ন লোকের ছবি ও তাঁর সম্মন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য ঘেঁটে নিজের পছন্দ মতো মানুষটিকে খুঁজে নেবেন। এই জাতীয় অন্য অ্যাপগুলির মতো ফেসবুক এই মৌলিক ভাবনাটি তাঁদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা টিন্ডার থেকে ধার করেছে কিংবা বলা যায় চুরি করেছে।
এই অ্যাপটি বাস্তব রূপ পেতে যদিও এখনও কয়েক মাস দেরি আছে, কিন্তু ইতিমধ্যেই জানা গেছে যে এই অ্যাপটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না তাই যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাঁদের নিউস ফিডের অংশে ডেটিং প্রোফাইলগুলি দেখা যাবে না এর ফলে সেই ব্যক্তির ফেসবুকের বন্ধুরা সেগুলো দেখতে পাবেন না। অ্যাপ্লিকেশনটির সম্বন্ধে বিস্তারিত বলতে গিয়ে জুকেরবার্গ বলেন, যে এই অ্যাপটির উদ্দেশ্য হল কিছু সত্যিকারের সম্পর্ক তৈরি করা, কোনও রকম চটজলদি স্বল্পমেয়াদি সম্পর্ক গঠন নয়।
এই অ্যাপটি একজন ব্যক্তির ফেসবুক বন্ধুদের তালিকার মধ্য থেকেই কয়েকটি নাম নির্বাচন করে সেই ব্যক্তির সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী হিসেবে দেখাবে না বরং সেই ব্যক্তির প্রোফাইলের সঙ্গে মানানসই ব্যক্তিদের নাম দেখাবে যাঁরা তাঁর ফেসবুক বন্ধুর তালিকায় নেই। এই কাজটা করার জন্য ফেসবুক নিজের যে বিশাল সংগ্রহ রয়েছে তাঁর থেকে একজন ব্যক্তির সঙ্গে মানানসই পছন্দ আর অপছন্দগুলোকে মাথায় রেখে আর একজন ব্যক্তির নাম পাঠাবে।
এই প্ল্যাটফর্মে একজন ব্যক্তি বিভিন্ন লোকের ছবি ও তাঁর সম্মন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য ঘেঁটে নিজের পছন্দ মতো মানুষটিকে খুঁজে নেবেন
আর এখানেই সমস্যার সূত্রপাত।
ব্যক্তিগত তথ্যগুলো সংগ্রহ করার এ এক নতুন উপায়
সাম্প্রতিক কালে যখন ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা- এই দুটি সংস্থাই ডেটিং অ্যাপ নিয়ে একটি কলঙ্কে জড়িয়ে পড়েছে ঠিক তখনই ফেসবুক এই ধরণের একটি উদ্ভট ও অনধিকারপ্রবেশমূলক ডেটিং অ্যাপ নিয়ে আসার কথা ঘোষণা করে নিজেদের আরও বেশি বেকায়দায় ফেলেছে। এই নতুন কৌশলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত সব তথ্য ফেসবুক খুব সহজেই পেয়ে যাবে।
ফেসবুক ডেটিং অ্যাপটিতে বিভিন্ন ফিচার রয়েছে। এই অ্যাপটিতে একটি মেসেঞ্জার বাক্স বা একটি প্ল্যাটফর্ম দেওয়া হয়েছে যার সাহায্যে অন্যজনকে কোনও ব্যক্তিগত বার্তা পাঠানো যাবে। ফেসবুকে যে সব সমস্যাগুলো বর্তমান, বিশেষ এই ফিচারটি ওই সমস্যাগুলোকে আরও প্রকট করে তুলবে।
একজন ব্যক্তি ফেসবুকে রোজকার ঘটনাগুলো বা রাজনীতি নিয়ে কী ধরণের মন্তব্য করছেন, সে সবের উপর নজরদারি করা ছাড়াও এই অ্যাপটির সাহায্যে একজন ব্যক্তির যৌন প্রবণতার মতো বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়েগুলোও তারা জানতে পারবে। যদিও ফেসবুক দাবি করেছে যে এই অ্যাপটিকে এমন ভাবে বানানো হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন তথ্য সম্পূর্ণ ভাবে সুরক্ষিত থাকে এবং পাশাপাশি তাঁরা এটাও বলার চেষ্টা করেছে যে সাধারণ মানুষ যাঁরা এই অ্যাপটি ব্যবহার করবেন তাঁদের কোনও তথ্যের উপরে ফেসবুক নজরদারি করবে না। ফেসবুকের কাছে যে তথ্য সুরক্ষিত থাকে না সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। পাশাপাশি এই ধরণের ডেটিং অ্যাপের যে কতটুকু বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, তাও আমরা জানি, এই পরিস্থিতিতে ফেসবুক বা অন্য যে কেউ আমাদের এই সব ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারবে।
মানুষের বিভিন্ন তথ্য যেমন তাঁর জীবনের কোনও আপত্তিকর পরিস্থিতি, অস্বস্তিকর কোনও কথা বা তাঁর কোনও যৌন প্রবণতা তো বটেই, এ ছাড়াও একান্ত ব্যক্তিগত ছবি, যেগুলো আমরা হয়ত কোনওদিনই কাউকে দেখতে চাইব না, সে সব দেখতে পাবেন ভহু অপরিচিত ব্যক্তি। তাঁরা সেই সব ছবি নিয়ে নাড়াচাড়াও করতে পারবেন। আর এই সব কিছুই চলবে একটা ডেটিং অ্যাপের মোড়কে, এমন একটি অ্যাপ যেটি বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তিকে তাঁর মনপসন্দ সঙ্গীকে খুঁজে দিতে সাহায্য করবে।
আবার এর সঙ্গে ফেসবুক বিজ্ঞাপনের অদ্ভুত দিকটাও যুক্ত হয়েছে। এই জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া সাইটটি সবচেয়ে বেশি আয় করেছে বিজ্ঞাপন থেকে। কোনও ব্যক্তি যে সব জিনিস নিয়ে সবচেয়ে বেশি খোঁজ করেন অনলাইনে, তাঁর কাছে তাঁর পছন্দের বিজ্ঞাপনটিই তারা দেখায়। এই কাজ সোশ্যাল মিডিয়াটি করতে পারছে, কারণ তারা লোকজনের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে রাখে।
এই সংস্থাটি অবশ্য বলছে যে তারা বিজ্ঞাপন পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনও লোকের ডেটিং অ্যাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করবে না। মনে রাখতে হবে যে তারা এর আগে মেসেঞ্জার চ্যাট শুরু করার সময়ও এই একই দাবিই করেছিল কিন্তু তবুও একটি চ্যাট বক্সে দুজন ব্যক্তির মধ্যে কী ধরণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেই সবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পেতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু পচা আলুগুলোর কী হবে?
এই প্রশ্নটা ছেড়েই দিলাম যে ফেসবুকে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো ঠিক কতখানি সুরক্ষিত থাকে। এর পরে আরও একটা প্রশ্নটা মনে আসে। ফেসবুকে যে সমস্যাগুলো এখন রয়েছে, এই ডেটিং অ্যাপ চালু হলে সেই সমস্যাগুলো আরও ব্যাপক ভাবে বেড়ে যাবে না তো?
আমরা জানি যে বিভিন্ন সময় অনেক অসাধু মানসিকতার লোক ফেসবুকে নকল প্রোফাইল বানায় এবং পরে সেই প্রোফালিগুলোকে সৎ ও অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করার জন্যই যে এইসব নকল প্রোফাইলগুলো বানানো হয় জেনেও সেগুলো রুখতে ফেসবুক হয়ত তেমন কিছুই করবে না। তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হল, ফেসবুক ব্যবহারকারীরা যে ধরনের সমস্যায় পড়েন, এই নতুন অ্যাপের ফলে সেই সমস্যা আরও বেড়ে যাবে না তো?
যদিও ফেসবুক সংস্থার সিইও মার্ক জুকারবার্গ আশ্বস্ত করেছেন যে ডেটিং অ্যাপ সাধারণ মানুষ তাদের যে সব ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন সেগুলোর সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখা হবে, কিন্তু ঠিক কতখানি সুরক্ষিত থাকবে সেটা পরিষ্কার নয়। ফেসবুকের যে মৌলিক ওয়েবসাইটটি রয়েছে সেটি যেমন সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি ঠিক তেমন ভাবেই আমরা যদি ফেসবুকের এই ডেটিং অ্যাপটিকেও বিশ্বাস করি, তা হলে সেটা হবে চরম মূর্খামি।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন

