জুকেরবার্গ কোন প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, আর কোন প্রশ্ন তাঁকে করাই হল না
অস্বস্তিকর প্রশ্ন সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন ফেসবুক সিইও
- Total Shares
এপ্রিলের ১০ তারিখে ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও মার্ক জুকেরবার্গ ওয়াশিংটনে উপস্থিত হয়েছিলেন।মার্কিন কংগ্রেসে হাজিরা দিয়ে ফেসবুক-কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কাণ্ডের বিষয়ে জবাবদিহি করলেন তিনি। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা এই শুনানি পর্বে বিশ্বের অন্যতম ধনী তথা শক্তিশালী ব্যক্তিটি যে বেশ নাজেহাল হয়েছেন তা বলাইবাহুল্য। একগুচ্ছ অস্বস্তিকর প্রশ্ন ধেয়ে আসে তাঁর দিকে।
এই শুনানি পর্বের আগে তিনি নাকি কয়েকজন বিশেষজ্ঞদের কাছে কী ভাবে বিনয়ী থেকে ও হাসতে হাসতে জনসমক্ষে কথা বলা (পড়ুন দোষ স্বীকার) যায় তার উপর বিশেষ তালিম নিয়েছিলেন। তাঁর এই বিশেষজ্ঞ দলে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রাক্তন বিশেষ পরামর্শদাতাও ছিলেন। আর, তিনি যে একেবারে সঠিক তালিম পেয়েছেন তা শুনানি পর্বের শেষে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। জনসমক্ষে পরীক্ষা দিতে বসে তিনি শুধু সসম্মানে উত্তীর্ণ হননি, ফেসবুকের শেয়ার বাজারও এক লাফে সাড়ে চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৬৫ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল - সংস্থাটির কাছে যা গত দু'বছরে একদিনের সর্বাধিক বৃদ্ধি।
এর ফলে ফেসবুকের মূল্যও ২,১০০ কোটি ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও ৩০০ কোটি টাকা মতো ব্যক্তিগত ভাবে জুকেরবার্গের কপালেও জুটেছে। কিন্তু এই রোজগার কী ফেসবুকের সততার পুরষ্কার? নাকি, সিইওর ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে যুদ্ধ জয়ের প্রাপ্তি? উত্তর প্রথমটা নয়, দ্বিতীয়টা।
অস্বস্তিকর প্রশ্ন সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন ফেসবুক সিইও
জুকেরবার্গ যা বলেননি
কয়েকটি প্রশ্নে একেবারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি জুকেরবার্গ। কিন্তু শুনানি চলাকালীন অধিকাংশ সময়তেই বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখিয়েছে তাঁকে।
এর আগে বেশ কয়েকটি এই বিষয়ে বেশ কয়েকটি আলোচনা সভায় ক্যামেরার সামনে রীতিমতো ঘামতে দেখা গিয়েছিল ফেসবুক সিইওকে। তবে মঙ্গলবারের জুকেরবার্গ নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। ৪৪ জন মার্কিন রাজনীতিবিদ যাঁদের আবার জেরা করবার বিষয় বেশ সুনাম রয়েছে তাঁদের প্রশ্নবানের জর্জরিত হতে দেখা যায়নি জুকেরবার্গকে।
হাজারো ক্যামেরার ফ্লাশবাল্বের ঝলকানির সামনেও অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো সুন্দর ভাবে এড়িয়ে গেলেন। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য পরীক্ষকেরাও এই ধরণের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে জুকেরবার্গকে সাহায্য করেছেন।
ফেসবুকের সঙ্গে প্যালানটির যুক্ত
এর মধ্যে একটি প্রশ্ন খুবই উল্লেখযোগ্য। মার্কিন সংসদের উচ্চকক্ষের ডেমোক্র্যাট সদস্য মারিয়া ক্যান্টওয়েল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কাণ্ডের বাইরে গিয়ে হঠাৎ প্যালানটির নিয়ে প্রশ্ন করে বসেন। এই সংস্থাটি ফেসবুকের বোর্ড সদস্য পিটার থিয়েল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বর্তমানে থিয়েলই এই সংস্থাটির চেয়ারম্যান।
ক্যান্টওয়েল প্রশ্ন করলেন, "প্যালানটির কী কোনওদিনও ফেসবুকের তথ্য চুরি করেছিল?"
উত্তরে জুকেরবার্গ জানালেন, "সেনেটর, আমি এই বিষয় ঠিক ওয়াকিবহাল নই।"
এর পর ডেমোক্র্যাট নেত্রীর প্রশ্ন, "আপনি কী প্যালানটির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।"
জুকেরবার্গ জানালেন তিনি প্যালানটির সম্পর্কে কিছু তথ্য জানেন। যা শুনে ক্যান্টওয়েল জানতে চাইলেন প্যালানটির সঙ্গে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কোনওদিনও কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা। উত্তরে, জুকেরবার্গ জানালেন যে তাঁর অন্তত জানা নেই। এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক ছিল, কারণ অনেকদিন ধরেই প্যালনটির সঙ্গে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। গত মাসে নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরির ব্যাপারে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে সহায়তা করেছিল প্যালানটির।
কয়েকটি প্রশ্নে একেবারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি জুকেরবার্গ
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ও রুশ বিজ্ঞাপন
আরও একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে জুকেরবার্গ খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেট সদস্য কমলা হ্যারিস তাঁকে প্রশ্ন করেন যে ২০১৫ সালে ফেসবুক তথ্য চুরির খবর জানতে পেরেও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কেন সংস্থাটির পক্ষ থেকে সে খবর দেওয়া হয়নি।
কিছুটা হতচকিত হয়েই প্রশ্নের জবাব দিলেন জুকেরবার্গ, "বর্তমানে এই চুরি সংক্রান্ত যা যা তথ্য আমাদের হাতে এসেছে আমরা বুঝতে পেরেছি যে আমরা আরও ভালো ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারতাম। ... সেই সময় লোকেদের এই তথ্যচুরির খবর না দিয়ে আমরা সত্যিই ভুল করেছিলাম।"
এরপর জুকেরবার্গকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন হ্যারিস। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন যে জাল রুশ বিজ্ঞাপন থেকে ফেসবুক কত টাকা রোজগার করেছে। জুকেরবার্গ এ বার আরও রক্ষণাত্মক ভূমিকা নিলেন, "আমি শুধু এটাই বলতে পারব যে রুশ সংস্থা আইআরএ প্রায় এক লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে কাজকারবার করে। কিন্তু সংস্থাটি জাল না ঠিক সে সম্পর্কে আমার সম্যক কোনও ধারণা নেই।"
বিদ্বেষমূলক উক্তি মুছে ফেলা
খুব স্বাভাবিকভাবে জুকেরবার্গ আরও একটি বিষয় উত্তর দিতে নিমরাজি ছিলেন - ফেসবুক মঞ্চকে ব্যবহার করে যে পরিমাণ বিদ্বেষমূলক উক্তি প্রচার হচ্ছে তা বন্ধ করতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে কি পদক্ষেপ করা হচ্ছে। সমস্যাটি রয়েছে তা জুকেরবার্গ অস্বীকার করেননি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এই সমস্যার সমাধান করা হবে কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছুই জানাননি তিনি।
তাঁর জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন যে এই মুহূর্তে ফেসবুকের তরফ থেকে এই বিষয়টি নিয়ে কিছুই করবার নেই। হয়ত, আগামী পাঁচ দশ বছরের মধ্যে উন্নতমানের প্রযুক্তির সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিদ্বেষমূলক উক্তিগুলো ফেসবুক থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হবে।
জুকেরবার্গ জানিয়েছেন, "আমি আশাবাদী যে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের আমরা উন্নতমানের প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারব যে প্রযুক্তি বিভিন্ন ভাষার বিদ্বেষমূলক উক্তিগুলোকে খুঁজে বের করে সাইট থেকে মুছে দিতে পারবে। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এ ধরণের কোনও প্রযুক্তি নেই।"
বাজারে একচেটিয়া অধিকার
রিপাব্লিকান সেনেটর লিন্ডসে গ্রাহামও অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন জুকেরবার্গকে। তিনি প্ৰশ্ন করেন যে সোশ্যাল মিডিয়ার বাজারে ফেসবুকের কী এক চেটিয়া আদিপত্য রয়েছে এবং কেন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোকে আইন করে কোনওরকম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাবে না।
ফেসবুকের সরাসরি প্রতিপক্ষ সংস্থার নাম বলতে রীতিমতো বেগ পেতে হয় জুকেরবার্গকে। কোনওরকম তিনি গুগল, অ্যামাজন ও মাইক্রোসফটের নাম বলেন। প্রশ্নকর্তা তখন চাপে ফেলতে অন্যভাবে প্রশ্নটি করেন। তিনি জুকেরবার্গকে এই সংস্থাগুলোর একটি প্রোডাক্টের নাম বলতে বলেন যা সরাসরি ফেবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী। উত্তর দিতে পারেননি জুকেরবার্গ।
একই ভাবে যখন ফেসবুকের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ ওঠে জুকেরবার্গ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
জুকেরবার্গকে কী জিজ্ঞেস করা হয়নি
জুকেরবার্গকে আরও অনেক প্রশ্নই করা যেত। কিন্তু করা হয়নি।
২০১৮ তে তথ্যচুরির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরেই ফেসবুক এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য গোপন রাখবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। সংস্থার কর্তৃপক্ষ গায়ের জোরে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করবার চেষ্টাও করেছেন।
ক্রিস্টোফার ওয়াইলি, যিনি সর্বপ্রথম তথ্যচুরির খবর প্রকাশ্যে আনেন, তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার বিরুদ্ধেও আদালতে দ্বারস্থ হওয়ার হুমকি দিয়েছিল ফেসবুক। অনেকেই ভেবেছিলেন যে সেনেট সদস্যরা এই নিয়ে ফেসবুক সিইওকে প্রশ্ন করবেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি।
আরও একটি বিষয়ের উপর প্রশ্নের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন ফেসবুক সিইও - যে ব্যবহারকারীরা এখন ফেসবুক ব্যবহার করছেন না তাঁদের তথ্যের বিষয়টিও যেন ফেসবুক কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখেন। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা অন্য যে সব সাইট ব্যবহার করেন, সেই সব সাইটের ব্যবহারের উপরেও নজর রাখে ফেসবুক।
Interesting distinction to dig into imo: Zuckerberg says that you own the content and data you put onto the site. But what if the company can glean information about you from the actions you take on the site without disclosing anything yourself? What about that data's ownership?
— Alp Ozcelik (@alplicable) April 10, 2018
It's not data you can take back. It's not content you can remove. It's just data being put together looking at the way you're spending time on Facebook. One would argue that's Facebook's data on you and your habits cause they put it together in the first place.
— Alp Ozcelik (@alplicable) April 10, 2018
এই অনুসন্ধানের তথ্য সংগ্রহ করে তা ফেসবুক কী ভাবে তা ব্যবহার করছে? জনৈক টুইটার ব্যবহারকারী আল্প ওৎসেলিক এই প্রশ্নটি তুলেছেন।
বিজ্ঞাপন নজরদারি প্রযুক্তি পিক্সেল নিয়েও ফেসবুক সিইওকে কোনও প্রশ্ন করা হয়নি। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে তথ্য গোপন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেনেট সদস্যদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই।

