কলকাতা কি চিরকালই জতুগৃহ থাকবে? কেন?

লোকে সচেতন হলে ভালো, তা না হলে অন্য উপায়ও আছে

 |  4-minute read |   25-01-2019
  • Total Shares

একটি নামী প্রতিষ্ঠানে আমার একবার সৌভাগ্য হয়েছিল আগুন লাগলে কী করা উচিত সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নেওয়ার। সার্ভার রুমে আগুন লাগলে কী রঙের শিখা হয়, কম্পিউটারের মনিটরে আগুন লাগলে কী রঙের ধোঁয়া হয়, অফিসের বিভিন্ন জায়গায় থাকা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলি কী ভাবে ব্যবহার করতে হয় প্রভৃতি বিস্তারিত শেখার পরে প্রশ্ন করলাম, ফায়ার এগজিট কেন বাইরে থেকে বন্ধ থাকে?

এই প্রশ্নের উত্তর ছিল না দমকলের ওই কর্মীর কাছে। তার পরে অন্তত তিন মাস ধরে বারে বারে বলার পরেও সেই দরজা খোলা হয়নি।

বছর পাঁচেক আগের কথা। রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি তেল কোম্পনি এবং তৈল শোধনাগারগুলির বেশ কয়েকজন কর্তা কলকাতায় এসেছিলেন একটি আলোনাচক্রে যোগ দিতে। তার দিন কয়েক আগেই ইন্ডিয়ান অয়েলের একটি কেন্দ্রে আগুন লেগেছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করতে একন্তে এক তেল-সংস্থার কর্তা বলেন, ওই কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও কিচ্ছু হবে না গোছের মনোভাবের জন্যই এত দুর্ঘটনা ঘটে।

kolkata_fire_pti_012519051951.jpgসম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতায় একটি শাড়ির দোকানে অগ্নিকাণ্ড। (ফাইল ছবি: পিটিআই)

সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতায় একটি নামী শাড়ির দোকানে আগুন লাগার কারণও তাই। কিচ্ছু হবে না এবং আগে হোক, তারপরে দেখা যাবে গোছের মানসিকতা। কলকাতা শহরে বাগরি মার্কেট, স্টিফেন কোর্ট, আমরি হাসপাতাল, সরকারি হাসপাতালের ক্যান্টিন আবার শহরতলির বাজার ও বস্তিতে আগুন লেগেছে। তাতে বিপুল সম্পত্তিহানি হয়েছে। এর সঙ্গে মানুষের প্রাণের দাম যোগ করলে অঙ্কটা কোথায় যাবে বলা মুশকিল। বিয়োগব্যথার কথা না হয় বাদই দেওয়া হল!

তারপরে তদন্ত হয়, সরকারি চিঠি যায়। শুধুমাত্র কাজেরকাজ কিছু হয় না। প্রায় প্রতিবারই একটি তত্ত্ব উঠে আসে – প্রোমোটারির জন্য এই কাজ করা হয়েছে। না হয় এর নেপথ্যে রয়েছে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার দ্বন্দ্ব।

ব্যক্তিসমস্যা ও প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি

অন্য অগ্নিকাণ্ডের কথা থাক। ধরা যাক স্টিফেন কোর্টের কথা। একেবারে কলকাতা শহরের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ পার্ক স্ট্রিটের এই বাড়িটিতে তিন দিনের বেশি সময় ধরে আগুন জ্বলতে দেখেছেন পথচারীরা। তারপরে তাঁরা কি করেছেন? কপালকে দোষ দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়েছেন, সম্ভাব্য পথদুর্ঘটনাকে পাত্তা না দিয়ে।

চেন্নাইয়ে এক বন্ধুর গাড়িতে শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। একটু এগোনোর পরেই আমাকে সিটবেল্ট বেঁধে নিতে বলল। স্বাভাবিক ভাবেই আমি প্রশ্ন করলাম যে চেন্নাইয়ের পুলিশ খুব বেশি ‘কেস দেয়’ কিনা। সে বলল, “এটা ঠিক জানি না। কারণ আমি নিরাপত্তার কথা ভেবেই সিটবেল্ট লাগিয়ে নিই।”

কলকাতা ও শহরতলিতে লোকে হেলমেট পরেন ‘স্রেফ কেস খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে’। এই সব ব্যক্তিই যখন কোনও প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন তখনই যত সমস্যা! তাঁরা ধূমপান করে জ্বলন্ত সিগারেট ছুড়ে ফেলেন, রোজই ফেলেন। কখনও কিছু হয় না। কোনও একদিন সমস্যা হয় এবং সেই দিন লোকের প্রাণ যায়।

kolkata_news_2010032_012519052050.jpgস্টিফেন কোর্টে অগ্নিকাণ্ড। (ফাইল ছবি: পিটিআই)

এই সব লোক কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই দিনের পর দিন সব ঠিক আছে বলে শংসাপত্র পাঠিয়ে যেতে থাকেন। যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে সেদিন শর্ট সার্কিট হয়েছে বলে দায় সারেন।

এই সব ব্যক্তি যখন কোনও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকেন তখন তাঁর মানসিকতার দায়ভার বহন করতে হয় প্রতিষ্ঠানকে।

প্রোমোটারি তত্ত্ব

শুধু কলকাতা শহর কেন, শহরতলিতেও অত্যন্ত দামি জায়গায় এমন অনেক বাড়ি রয়েছে যেটি ১০০ বছর আগে ৫০ টাকায় কোনও ব্যক্তি ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁর উত্তরসূরীরা এখন সাব-টেন্যান্ট রেখে ৫০ হাজার টাকা রোজগার করছেন। বাড়ির মালিক পাচ্ছেন বড় জোর ৫০০ টাকা।

এ দেশে মামলার পাহাড়। কবে নিষ্পত্তি হবে জানা নেই। তাই উঠে আেসে প্রোমোটারি তত্ত্ব – বাড়ির মালিক নিজেই ষড়যন্ত্র করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন জমিটি প্রোমোটারকে দেবেন বলে। এমন তত্ত্বও শোনা যায় যে জমিটি পেতে প্রোমোটারই এ কাজ করেছে।

বাড়িগুলির অবস্থা

মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে এবং ঝুলের মতো পাকিয়ে ঝুলে রয়েছে তার – বিদ্যুতের তার, টেলিফোনের তার, টেলিভিশনের কেবল... আরও কিছু থাকতে পারে। কার উৎস কোথায় বোঝা দায়, কোন তার কোথায় গিয়েছে তা বোধহয় বিশ্বকর্মা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবেন না। এই সব অবিন্যস্ত তার কোনও দিনও সুবিন্যস্ত হবে কিনা কেউ জানে না।

এমন বাড়ির সংখ্যা কলকাতায় কম নকয়। এই ধরনের বাড়িতে আগুন না লাগা পর্যন্ত কারও সম্বিৎ ফেরে না। যদি বলা হয় সাত দিন বাড়িতে সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে কাজ করা হবে, কেউই হয়তো রাজি হবেন না। এটাই বড় সমস্যা।

kolkata-bagri-fire-p_012519052132.jpgবাগরি মার্কেটে আগুন (ফাইল ছবি: পিটিআই)

প্রশাসনের সমস্যা

প্রশাসনের কতটা কী করার আছে তা নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কলকাতায় হাজার হাজার বাড়ি, লক্ষ ব্যবসায়ী – সামান্য কয়েকজন সরকারি কর্মী কী করবেন? তাঁদের পক্ষে কি সম্ভব প্রতিটি ক্ষেত্রে নজরদারি করা? এক কথায় উত্তর, সম্ভব। পুলিশের পক্ষে যদি হেলমেট পরানো সম্ভব হয়, তা হলে দমকল ও পুর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে একাজও অনেকাংশে সম্ভব। কীভাবে?

কেউ ব্যবসা সংক্রান্ত নথি নবীকরণ করতে গেলে তাঁকে অগ্নিনির্বাপন নিয়ে মুচলেকা দিতে হবে। একটি প্রতিলিপি থাকবে দমকলের কাছে। দমকল সব জায়গায় না পারুক বেশ কয়েকটি জায়গায় আচমকা পরিস্থিতে দেখতে যেতে পারে। তারা সন্তুষ্ট না হলে ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করবে পুরসভা।

সচেতন না হলেও ব্যবসার ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে ন্যূনতম ব্যবস্থা করতে বাধ্য হবেন ব্যবসায়ীরা। তাতে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা কমবে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Comment