ফসিল থেকে ডাকটিকিট: নেশা যখন সুন্দরবন

সুন্দরবনের সভ্যতার ধারাবিবরণীর উজ্জ্বল সংগ্রহ

 |  4-minute read |   23-02-2019
  • Total Shares

সুন্দরবন এই নামটাই কানে শুনে প্রথম  আগ্রহ তৈরি হয় । আমাজনের জঙ্গল  বা পৃথিবীর আর পাঁচটা বিখ্যাত জঙ্গলের মতো সুন্দরবনও বিখ্যাত আর আমার বাড়ি হল এর একেবারে কাছেই, বড় জোর ১০০ কিলোমিটার। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য, এই জঙ্গলের বাঘ ছাড়াও কুমির-হরিণের নানা কথা শুনেছি। আর পাঁচজনের থেকে আমার ধারনার মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না।

তবে স্কুলে পড়ার সময়ই শুরু হয় সুন্দরবনের বিভিন্ন গ্রামে ছুটে যাওয়া। কারণ শুনতে পাই যে এই সব গ্রামে নাকি ইতিহাসের সব জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে।

ujj-terra_022319070023.jpgধঞ্চির জঙ্গল থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন বারামূর্তি। (সংগ্রহ: লেখক)

আমি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জাদুঘর দেখি। সেখানে পুরনো হাঁড়ি, মাটির জিনিসপত্র, মুদ্রা প্রভৃতি দেখেছি। সেগুলো দেখে ধারনা জন্মায় যে এগুলোও তো সুন্দরবনের বিভিন্ন গ্রামগুলোতে পাওয়া যায়। তখন একটা একটা করে গ্রাম ঘুরতে শুরু করি, বিশেষ করে বিভিন্ন নদীর পাড় – বিশেষ করে মাতলা, ঠাকুরাণ প্রভৃতি।

এই সমস্ত নদীর পাড় যখন ভেঙে যায় তখন সেখান থেকে বিভিন্ন জিনিস পেতে শুরু করি, কখনও ভাঙা, কখনও গোটা, কখনও বা স্রেফ খোলামকুচির মতো জিনিস পেতে শুরু করি। তখন নিজের মধ্যেই একটা ভালোলাগা তৈরি হয় যে সুন্দরবনের মতো একটা জায়গার শত শত বা হাজার হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমার কাছে আছে! তখন থেকেই একটা অনুভূতি তৈরি হয়। এখান থেকেই পথ চলা শুরু।

বিভিন্ন জায়গায় যেতে যখন শুরু করলাম তখন এমন মোবাইল ফোন ছিল না, থাকলেও আমার হাতে ছিল না। তাই কানে কোনও একটা গ্রামের নাম শুনলে সেখানে কী ভাবে পৌঁছাতে হয় সে কথা জেনে নিয়ে তবেই সেখানে যেতে পারতাম। খুঁজে খুঁজে যেতে হত। গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতাম কোনও পুরনো জিনিস সেই গ্রাম থেকে পাওয়া গেছে কিনা বা কোনও মাটির কোনও ভাঙা জিনিস সেখান থেকে পাওয়া গেছে কিনা।

ujj-seal_022319070111.jpgমাটির ফলক। (সংগ্রহ: লেখক)

মূলত মাটির জিনিসপত্র দিয়েই সংগ্রহ শুরু। কারণ ভাঙাচোরা মাটির জিনিসপত্রে সাধারণ গ্রামবাসীর আগ্রহ খুব কম থাকে। তবে পরবর্তী কালে আমি সেই সমস্ত গ্রাম থেকেই সংগ্রহ করতে পারলাম পাথরের মূর্তি, বিভিন্ন সময়ের অলঙ্কার, হাতিয়ার, মুদ্রা। এগুলো অবশ্য অনেক পরের দিকে সংগ্রহ করেছি। তবে গ্রামের লোকও কোনও না কোনও ভাবে তাঁদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা এসে বলেছেন যে, “বাবু, আমার কাছে এই রকম একটা ভাঙা মাটির পাত্র রয়েছে। এটা নিতে চান।”

আমি দেখলাম সেটা প্রাচীন। পরে কোনও জাদুঘরে তেমন একটা পাত্র দেখলাম যেখানে লেখা আছে ‘খ্রিস্টীয় প্রথম শতক’। সেটা দেখে আমারও মনে ধারনা হল যে আমার কাছে থাকা পাত্রটিও তা হলে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক বা তার আশপাশে।

এর পরে পাথরের বিষ্ণুমূর্তি, সূর্যমূর্তি, তাম্রমুদ্রা (মৌর্য যুগের) প্রভৃতি পেতে শুরু করি। একই সঙ্গে পেতে থাকি টেরাকোটার বিভিন্ন মূর্তি (এর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য হল যক্ষ ও যক্ষীর মূর্তি), পুঁতি প্রভৃতি। তবে এই প্রতিটি প্রত্নদ্রব্যের কোনওটিরই সেই অর্থে বৈজ্ঞানিক ভাবে কালনির্ণয় করা হয়নি (যেমন কার্বন ডেটিং)। এর কারণ অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত অক্ষমতা।

ujj-book_022319070140.jpgঅন্য সুন্দরবন। (সংগ্রহ: লেখক)

তবে আমার সংগ্রহের কথা আমি প্রথম লিখিত ভাবে জানাই (২০০৫ সাল) আমাদের মহকুমার তথ্যক আধিকারিককে। ডিরেক্টরেট অফ আর্কিয়োলজির প্রতিনিধিররা এসে সরেজমিনে আমার সংগ্রহ দেখেন। তার ভিত্তিতেই পঞ্জীকরণ ও সরকারি অনুমতি লাভ। তখন সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রত্ন নিদর্শনের একটি তালিকা তৈরি করছিল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, সেই তালিকায় আমার সংগ্রহও স্থান পায়। পরে বাড়িতে নিজের মতো করে সেগুলি প্রদর্শিত করি।

আমার  প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সবটাই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা থেকে সংগ্রহ। এই জেলার একটা অংশ সুন্দরবন হলেও পুরোটা সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত নয়।  পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকের বেশ কিছুটা অংশ সুন্দরবন লাগোয়া বলে আমাদের বর্তমান প্রদর্শনীতে শুধুমাত্র সেই সমস্ত অঞ্চল থেকে পাওয়া নিদর্শনগুলি দেখাচ্ছি।

হতে পারে প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে আমার সংগ্রহের কোনও গুরুত্ব নেই, কিন্তু আমার কাছে এর আলাদা মূ্ল্য রয়েছে। আমার মনে হয়, নিতান্ত শখের বশে করলেও দেশের প্রেক্ষিতে একটি আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আমার অবদান কোথাও না কোথাও থাকতে পারে।

ujj-case_022319070219.jpgপ্রাপ্তিস্থান সুন্দরবন। (সংগ্রহ: লেখক)

তা ছাড়া বিক্ষিপ্ত ভাবে পাওয়া এই সব নিদর্শন যদি ঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তা হলে এই উপসংহারে আসা যেতে পারে যে এখানে কোনও না কোনও দিন কোনও প্রাচীন সভ্যতা ছিল, সেই ইঙ্গিতটুকু অন্তত পাওয়া যাচ্ছে। ইতিহাসের ছাত্র হিসাবেও সেই কাজ আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। গ্রাম-লোকালয় থেকে জেলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই ভূমিকা তো আমরা নিতেই পারি।

ভালোবাসার জায়গা থেকেই সুন্দরবনের পরবর্তী ইতিহাস  ও সুন্দরবন সংক্রান্ত সংগ্রহের দিকে নজর দিই। এর মধ্যে এই সংক্রান্ত পত্রপত্রিকা, ডাকটিকিট – সবই সংগ্রহ করতে শুরু করি এবং করতে পেরেছি।

ujj1_022319070249.jpgডাকটিকিটে সুন্দরবন। (সংগ্রহ: লেখক)

ব্রিটিশ যুগে যখন সুন্দরবনে নতুন করে বসতি তৈরি হচ্ছে সেই সময়ের দলিল, চিঠি, দস্তাবেজ এবং পত্রপত্রিকা আমি সংগ্রহ করি। সেগুলিও আমি দেখাতে সক্ষম হয়েছি আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।

সেই সব নিয়েই আমার সংগ্রহের মালা গাঁথা – যেখানে ফসিল থেকে আধুনিক ডাকটিকিটের একটি মালা তৈরি করেছি। সুন্দরবন নিয়ে সবকিছুতেই আমার আকর্ষণ রয়েছে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

UJJWAL SARDAR UJJWAL SARDAR

Research Scholar, Assam University & Antiquities and Manuscript Collector, member of Editorial Board of Sudhu Sundarbon Charcha

Comment