হত্যার তদন্ত করতেই বেরিয়ে এল সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার কালো দিক
লাতুরের ২৫০টি কোচিং সেন্টারের বার্ষিক আয়ে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা
- Total Shares
বছর দু'য়েক আগে তীব্র জলসঙ্কটের জন্য খবরের শিরোনামে চলে এসেছিল মহারাষ্ট্রের লাতুর। সেই শহরেই ৩৪ বছরের প্রাইভেট টিউটর অবিনাশ চ্যবন 'স্টেপ বাই স্টেপ' নামক একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২৫ জুন অবিনাশকে হত্যা করা হয়।
পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছে যে শহরের অন্য এক কোচিং সেন্টারের মালিক চন্দনকুমার শর্মা পেশাগত শত্রুতার জন্য ২০ লক্ষ টাকা দিয়ে পেশাদার খুন নিয়োগ করে অবিনাশকে হত্যা করেছিলেন। 'কুমার ম্যাথস ক্লাস' নামের একটি কোচিং সেন্টারের কর্ণধার ছিলেন শর্মা।
শর্মা আদতে একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর বাড়ি বিহারে। লাতুর থেকে উঠে আসা মেধা তালিকার উপরের দিকের ছাত্রদের কথা ও শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলোর মোহে আকৃষ্ট হয়ে শর্মা ২০০৯ সালে বিহার থেকে এই শহরে চলে আসেন। শহরের এক নামকরা কলেজে বছর দু'য়েক শিক্ষকতা করে শর্মা তাঁর কোচিং সেন্টারটি খোলেন। এই কোচিং সেন্টারে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ুয়াদের অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়ানো হত।
শুরুর দিকে অবিনাশ শর্মার সঙ্গেই কাজ করতেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি শর্মার সঙ্গ ত্যাগ করে নিজের ব্যবসা শুরু করে দিলেন। তাঁর কোচিং সেন্টারে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা ও অঙ্ক করানো হত আর তিনি প্রতিটি বিষয়ের জন্য ৩,০০০ টাকা করে নিতেন। সেই সময় বাকি কোচিং সেন্টারগুলোতে প্রতি বিষয়ের জন্য ২০,০০০ টাকা নেওয়া হত। দ্রুত অবিনাশ শহরে তাঁর কোচিং সেন্টারের পাঁচ পাঁচটি শাখা খুলে ফেলেন। এমনকি পড়ুয়াদের সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে তিনি প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয় করে পুরস্কার বিতরণ করতেন।
নিবিড় শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা শুধুই কাগজে কলমে হয়েছে
অবিনাশ লাতুর শহরে আরও একটি ব্যাপারের জন্য বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। মার্চ মাসে তাঁর জিম 'অ্যাডল্ফের' উদ্ঘাটন করেন বিখ্যাত বলিউড অভিনেত্রী সানি লিওন। পুলিশ সুপার শিবাজিরাও রাঠোর জানিয়েছেন যে অবিনাশের এই উত্থানকে ঈর্ষা করতেন শর্মা।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহারাষ্ট্রর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঘিরে কালো দিকগুলো প্রকাশ্যে চলে এল। লাতুরের জনসখ্যা পাঁচ লক্ষ। গত এক দশকে এই শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার গজিয়ে উঠেছে।
প্রতি বছর লক্ষাধিক ছাত্র লাতুরে আসে এই কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি হবে বলে। প্রশাসনের আনুমানিক হিসেব, লাতুরের ২৫০টি মতো কোচিং সেন্টার রয়েছে, একত্রে যাদের বার্ষিক আয়ে ১,০০০ কোটি টাকা। কোচিং ফি ছাড়াও এরমধ্যে থাকা-খাওয়ার খরচও রয়েছে।
রাজ্যের অন্য জায়গাতে ছবিটা অনেকটা একই রকম। শিক্ষাবিদরা এই পরিস্থিতি জন্য নিবিড় শিক্ষা ব্যবস্থাকেই দায়ী করছে।
এই ব্যবস্থায়, একটি কোচিং সেন্টারের কোনও না কোনও কলেজের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা রয়েছে। কোনও পড়ুয়া যদি সেই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয় তা হলে সেই পড়ুয়া কলেজে না গেলেও তাকে কলেজের ক্লাসেও উপস্থিত দেখিয়ে দেওয়া হয়।
মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সগুলোতে যোগ্যতা নির্ধারণ নম্বর নিয়ে এতটাই কঠোর মনোভাব দেখান হয় যে অভিভাবকরা এই কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হন। তাঁদের মতে, এই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলে পড়ুয়াদের সময় ও এনার্জির অপচয় কম হয়।
মুম্বাইয়ের মনোজ গুপ্তে তাঁর কন্যা রাধিকাকে পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করিয়ে এই কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছেন। দশম শ্রেণীর ফাইনালে সে ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে এখন ডাক্তার হওয়া স্বপ্নে বিভোর। তাকে এখন দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিট পাস করতে হবে। তবেই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারবে। গুপ্তে জানালেন, "রাধিকা যে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে সেটি নিটের জন্য সেরা। মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি এই টাকা খরচ করতে রাজি।"
এই নিবিড় শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু, তা শুধুই কাগজে কলমে।
সৌজন্য: মেল টুডে, লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে