যে হাওড়া ছিল শেফিল্ড অফ দি ইস্ট, এখন সেখানেই অবৈধ অস্ত্র কারখানা

সাম্প্রদায়িক দূরত্ব বাড়ছে, তার উপরে অস্ত্র কারখানার কথায় হাওড়া শহরের লোকজন শঙ্কিত

 |  5-minute read |   27-12-2018
  • Total Shares

তখন ইস্কুলে পড়ি। ভূগোলের শিক্ষক অশোক বাবু স্যার (আমাদের স্কুলে শিক্ষকের নামের পরে বাবু স্যার বলার চল ছিল, যদিও নামের ইনিশিয়ালও ব্যবহার করা হত, যেমন অশোক সাহাকে বলা হত এএস স্যার) পড়িয়েছিলেন দেশের প্রথম কাপড় কারখানা স্থাপিত হয়েছিল হাওড়ার ঘুসুড়িতে।

নবম শ্রেণীর ভুগোলে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের পরিচয় দেওয়া ছিল, তার মধ্যে হুগলি শিল্পাঞ্চলও ছিল। তবে ছোট বেলা থেকেই দেখে এসেছি বন্ধ কারখানার সারি। তখন পড়েছি, কী ভাবে পাটশিল্প সঙ্কটে পড়েছে। প্রথম কারণ পাট চাষ হত যে অংশে, দেশ ভাগ হওয়ার পরে সেই লম্বা আঁশওয়ালা পাটের ক্ষেতগুলি পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে। পরবর্তী কালে পাটের চাহিদাও কমে যায়। ফলে পাট শিল্প চরম সঙ্কট দেখা যায়।

burn_122718041418.jpgদীর্ঘদিন বন্ধ বার্ন স্ট্যান্ডার্ড (ডেইলিও)

অনেক পরে হাওড়ার বালি এলাকায় বিভিন্ন কারকাখায় ঢুকেছি, সেখানে বেশিরভাগ শ্রমিকই বিহার-উত্তরপ্রদেশের। তাঁদের দুর্দশা দেখেছি। দুর্দশার কারণ একটাই, কারখানায় তেমন কাজ নেই। কোনও কারখানা বন্ধ। সেই সব কারখানায় ভিতরে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে কঙ্কালসার অচল কলগুলো।

ছোট বয়সে যখন কাউকে রেমিংটন, বার্ন কোম্পানি, গেস্ট কিন উইলিয়ামসে চাকরি পেতে শুনতাম, তখন বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বইত। তারপরে একে একে সে সব কারখানা বন্ধ হতে শুর করল। হাওড়া পেরিয়ে হুগলির হিন্দমোটরের বিরাট কারখানাও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারল না। হাত বদল হয়েও শেষ পর্যন্ত বাঁচল না ডানলপের সাহাগঞ্জ কারখানা।

ডানলপ কারখানায় গিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে, এক প্রাক্তন সহকর্মীর সঙ্গে। কারখানার শ্রমিকদের কথা শুনছিলাম। তখনও সরকারি ভাবে কারখানা বন্ধের ঘোষণা হয়নি। তবে ইতিহাস আর বর্তমানের তুলনা করে বুঝতে পারছিলাম যে বন্ধ হওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এই সব কারখানার উপরে নির্ভর করত কয়েক লক্ষ পরিবার। ঠিকই বলছি, কয়েক লক্ষ। এই সব কারখানার যে সব অনুসারী শিল্প ছিল, তাদের কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহণে নানা ধরনের গাড়ি নিযুক্ত ছিল, নিরাপত্তা কর্মী এমনকি কারখানা ও অনুসারী শিল্পোৎপাদন কেন্দ্রগুলির আশপাশে গজিয়ে ওঠা চা ও জলখাবারের দোকান, ভাতের হোটেল... বড় কারখানা বন্ধের পরে সেই শ্রমিকদেরই খোঁজ আমরা রাখতে পারি না, আর অনুসারী শিল্পের খোঁজ কে রাখে, চায়ের দোকানের মালিক-কর্মীর কথাই বা কে শুনতে চায়!

হাওড়ার থাকার সুবাদে একাধিক কারখানায় ঢুকেছি, কারখানা সংলগ্ন অফিসে সময় কাটিয়েছি। কারখানা বন্ধের পরে দেখেছি আমাদের গ্রামে লোকজন ফিরে ক্ষেত-খামারে কাজ করছেন। কিন্তু যাঁরা শহুরে তাঁদের অবস্থা কী?

worksreu_122718041450.jpgবন্ধ হয়েছে হাওড়ার বহু কারখানা (উপস্থাপনার জন্য, ফাইল ছবি/রয়টার্স)

একবার ভোটের আগে হাওড়া শিল্পাঞ্চলে বড় বড় চাবির কাটআউট ঝুলল। তিনি সাংসদ হলে ও কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হাওড়ার সব বন্ধ কারখানা খুলবে বলে প্রচার শুরু হল। হাওড়া সদর কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে সাংসদ হলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। তিনি কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কারখানা খোলেনি। পরের বার ভোটে হেরেছিলেন। তারপর আর হাওড়া থেকে নির্বাচনে লড়াই করেননি।

এখন যিনিই আসুন না কেন, কারখানা খুলবে এমন দুরাশা কেউ কষ্টকল্পনাতেও করেন না। বামফ্রন্ট যে সব কারখানা বন্ধ করেছে সেই কারখানার জমিতেই শিল্প হবে বলে ঘোষণা করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু তা হয়নি। বিজেপি উন্নয়নের কথা বলে, কিন্তু তারা ক্ষমতায় এলে হাওড়া শিল্পাঞ্চলের কারখানা খুলবে এমন কথা অন্তত হাওড়ায় থেকে কখনও শুনিনি।

যে সব বন্ধুর নিজের কারখানা রয়েছে হাওড়ায় এখন তারাও নিজেদের কাজের ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন। হতাশ না হলেও চিন্তিত তো বটেই। তবে হাওড়ার কারখানা নিয়ে ইতিবাচক বা নেতেবাচক – কোনও খবরই দীর্ঘদিন শোনা যাচ্ছিল না। মাঝে কয়েক বছর আগে হাওড়ার মাঝারি উদ্যোগীদের কথা ভেবে বি-টু-বি (বিজনেস টু বিজনেস) মেলা করেছিল বণিকসভা সিআইআই।

তার পরে সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, এই হাওড়াতেই অস্ত্র কারখানার হদিশ মিলেছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, টিকিয়াপাড়ার কাছে ৭৪ গঙ্গারাম বৈরাগী লেনে অস্ত্র কারখানার হদিশ পাওয়া গেছে। কারখানাটি চালাত মহম্মদ সোহেল আলম, মহম্মদ আনোয়ার ও মহম্মদ নীরজ আনসারি, প্রত্যেকেরই বয়স ৩৮ বছর করে।

হাওড়ার ওই কারখানার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেই বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় যে কোনও কারখানাই – বড় বাড়ি, বহু পরিবার সেখানে বাস করেন, মালিক মৃত বা সেটির একাধিক মালিক, মালিক অন্যত্র থাকেন, একতলায় কারখানা, সারাদিন লেদ চলছে, প্রচুর লোহালক্কড় রয়েছে... প্রভৃতি। সেখানে কী তৈরি হয় সে ব্যাপারে ওই বাড়ির বাসিন্দা ও এলাকার লোকজনের কোনও মাথাব্যথা থাকে না। তা ছাড়া কোনটি অস্ত্রের যন্ত্রাংশ তা তাঁদের বোঝারও কথা নয়।

gkw_122718041516.jpgহাওড়ায় গেস্ট কিনস ইউলিয়ামসের ফটক (ফাইল চিত্র)

যে দিন খবরটা প্রকাশিত হল পরের দিন সকালে বাসস্ট্যান্ডে সেটাই ছিল আলোচনার বিষয়। একই সময়ে যাঁরা একই রুটের বাস ধরি তাঁদের মধ্যে আলোচনার প্রসঙ্গ ছিল এটাই। কারণ অস্ত্র তৈরি হচ্ছে বাড়ির পাশে। তা হলে কি আমরাও আর নিরাপদে নেই!

১৯৯২ সালে যখন অযোধ্যায় করসেবকদের আক্রমণে সৌধ ভাঙা হয়েছিল তখন পরপর কয়েকদিন কার্ফু জারি ছিল। তবে এই এলাকায় অতি কাছাকাছি তিনটি অংশে বহু মুসলমান পরিবারের বাস হলেও কোনও রকম ধর্মীয় উত্তেজনা ও আশঙ্কা ছিল না। তবে এখন সেই পরিস্থিতি আছে কিনা সন্দেহ। গত কয়েক বছর ধরে ভোর বেলায় নিয়মিত ভাবে ধর্মীয় কারণে মাইক ব্যবহার করায় অনেকেই বিরক্ত বলে মনে হয়েছে, বিশেষ করে রাস্তা আটকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার জন্য যান চলাচল সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়াকে অনেকে ভালো ভাবে নিচ্ছেন না, এগুলি কোনও দিনই এলাকার সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল না, বড় জোর তিন-চার বছর শুরু হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে অতিসম্প্রতি চৌমাথার নামও বদলে গেছে এবং চুপিসারে, কাউকে না জানিয়ে। এই বদলকে লোকে তৃণমূল সরকারের তোষণনীতির অঙ্গ বলে মনে করছেন। অস্ত্র কারখানার সন্ধান পাওয়ায় তাই এলাকার লোকজন উদ্বিগ্ন। আগে যে সব ব্যাপার শুধুমাত্র খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের খবরে সীমাবদ্ধ ছিল, বাড়ির কাছে ধূলাগড়িতে হামলার পরেও যারা চুপ ছিল, জেলার উলুবেড়িয়ার তেহট্টে সরস্বতী পুজো জোর করে বন্ধ করে দেওয়ার পরেও যারা চুপ ছিল এবার তারা মুখ খুলতে শুরু করেছে এবং পথেঘাটে।

প্রশ্ন হল এই অবস্থায় কী করা উচিত।

স্থানীয় প্রশাসনের এখনই পদক্ষেপ করা দরকার যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোনও ভাবে নষ্ট না হয় এবং যে সব কারণে আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে সেগুলিও দূর করা দরকার। সরকার হয়তো আগামী সিকি শতকেও হাওড়ার শিল্পের সেই হারিয়ে যাওয়া গৌরব উদ্ধার করতে পারবে না, কিন্তু সাম্প্রদায়িক যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেই পরিস্থিতি আলোচনার মাধ্যমে অবশ্যই দূর করতে পারে সরকার।

খরগোসের মতো মুখ লুকিয়ে যদি আমরা মনে করি যে আমি চোখ বুজে আছি বলে আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, তা হলে সমস্যা মিটবে না।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment