এত দিনে উঠল অনশন, কেন উদাসীন ছিল কর্তৃপক্ষ?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৬ দিন অনশন করে ক্ষমতা বদলের ভীত মজবুত করেছিলেন
- Total Shares
মেডিক্যাল কলেজ একটি প্রাচীন, ঐতিহ্যমণ্ডিত কলেজ। এই মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস ছাত্রদের ছাত্রাবাসের ঘরের বণ্টন ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে হওয়া উচিৎ। যা এ ক্ষেত্রে ভীষণ ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। হস্টেলে ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্রদের অনশন আন্দোলন অবশ্য উঠল আজ ১৪ দিনের মাথায়।
তবে কলেজ কর্তৃপক্ষের এই উদাসীনতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল আগেই এমবিবিএস পড়ুয়াদের সন্তানসম দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখে তাদের সমস্যা নিরসন করা। সেখানে কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে টানা দু-সপ্তাহ ধরে অত্যন্ত উদাসীন আচরণ লক্ষ করা গেছে। অনশন আন্দোলন ভাঙার জন্য ক্রমাগত ঘৃণ্য কৌশল তারা নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গী খুব নিন্দার। মেডিক্যাল কলেজগুলির সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক আধিকারিক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা) ডাঃ দেবাশিস ভট্টাচার্যও তাঁর দায়িত্ত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।
অগত্যা মেডিক্যালের ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে। অধিকার পেতে তাই অনশনের পথ বেছে নিতে হয়েছিল মেডিক্যা ল কলেজের ছাত্রদের। মেডিক্যালের ছাত্ররা চেয়েছিলেন মাথাগোঁজার একটা আশ্রয়, কর্তৃপক্ষ ওঁদের দিলেন অবহেলা। অনশনে যখন কেটে গেছে তেরোটা দিন, তখনও উদাসীন ছিল মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। ছাত্রছাত্রীদের দাবি নিয়ে সমাধানের পথে না গিয়ে সরকারি অঙ্গুলিহেলনে নির্লজ্জ উদাসীনতায় উপেক্ষা যত বেড়েছে দাবি আদায়ের জেদে দৃঢ় হয়েছে ছাত্ররাও। লড়াইটা অসম ছিল। ছাত্রদের প্রাণের চেয়ে বড় কি এই ঔদ্ধত্য? নাকি অদৃশ্য পর্দার আড়াল থেকে কোনও এক অঙ্গুলি হেলনে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষের এ হেন আচরণ? এখন অনশন উঠেছে। তবে তার আগে আমি সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই বিষয় তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। এখানে তাঁদের মতামত প্রকাশ করলাম-
সমীর আইচ, চিত্র শিল্পী ও সমাজ কর্মী “আমার ছোট ছোট চিকিৎসক ভাইবোনদের উচিৎ মেডিক্যা ল কলেজের সামনের রাস্তা দখল করে অনশন করে লোককে জানান দেওয়া। যা ওই অনশন কক্ষে ঘটছে সবই সাধারণ মানুষের গোচরে নয়, তাই রাস্তা দখল করে অনশন চালাক অনশনকারীরা। বর্তমান সরকারের বাইরে চাকচিক্যজ ভেতরটা অন্ধকার। ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, তাই দেখেও দেখছেন না। রাস্তার দখল নিলে হেলদোল হয়ত হবে। যে দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন, তাতে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে, আমি ওদের লড়াইয়ের পাশে আছি।”
কলেজ কর্তৃপক্ষের এই উদাসীনতা অত্যন্ত নিন্দনীয়
কৌশিক সেন, অভিনেতা “আমি ব্যা ক্তিগত ভাবে ভীষণ লজ্জিত। আমি সরকারকে দায়ী করছি না, দোষী আমরাই। আমাদের উচিৎ ছিল তীব্র প্রতিবাদ করা। আমি ভীষণ হতাশ। স্বতস্ফূর্ত সামাজিক আন্দোলন একসময় প্রচণ্ড আলোড়িত করত সবাইকেই, আজ সেই পরিস্থিতিই মৃতপ্রায়। আমি লজ্জিত আমাদের কৃতকর্মে। আমাদের অবস্থানে। তৃণমূলকে দায়ী করছি না, তার কাছে এটাই অভিপ্রেত। এর বিরুদ্ধতাতে আমাদের অবস্থান নিয়ে আমি হতাশ।”
মন্দাক্রান্তা সেন, কবি ও সমাজকর্মী“ওদের দেখতে গিয়ে ভালো থেকো বলবার স্পর্ধা আমার হয়নি। কারণ ওরা ভালো থাকবার জায়গায় নেই। ওরা লড়াইয়ে আছে, খারাপ থাকবে জেনেই, ওদের দেখতে গিয়ে ভালো থেকে বলতে আমার দ্বিধা হয়েছে। একটা সঙ্গত দাবি যা অতি সহজেই মিটিয়ে নেওয়া যায়। হস্টেলের মাথার উপর ভেঙে পড়ছে ছাদ তার বিরুদ্ধে ভালো থাকবার দাবি জানিয়েছে ওরা, যা অত্যকন্ত সঙ্গত। সরকারের এই ভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকার মানসিকতা ভীষণই প্রতিহিংসাপরায়ণ।”
সিদ্ধার্থ রায়, চিকিৎসক (ক্যাকটাস ব্যান্ডের সিধু) “হস্টেল ভীষণ দরকার। বাইরের ছেলেমেয়ে পড়তে এসেছে। আস্তানা প্রয়োজনই। এটা ন্যাতয়সঙ্গত দাবি। কর্তৃপক্ষ সময় চেয়ে নিতে পারেন, কিন্তু দাবি অস্বীকার করা ভীষণরকম অন্যাতয়।”
মিরাতুন নাহার, প্রাক্তন অধ্যাপিকা ও সমাজকর্মী
“আমি দু’দিন গেছি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করতে। দু’ধরণের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে ওখানে গিয়ে। তার ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্তে এসেছি তা মর্মান্তিক। এক ধরণের ভৌতিক চাপ রয়েছে কর্তৃপক্ষের উপর। যার ফলে আমি দেখা করতে গেলে অপমানসূচক আচরণ করে প্রিন্সিপ্যা ল আমাকে বলেন ওদের রাজনীতি করতে নিষেধ করুন এবং ভীষণ ঔদ্ধত্যোর সঙ্গেই আচরণ করেন। পরে আরেকদিন আমি গিয়েছিলাম। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ছিলেন বিনয়ী। দেখা করেন, কথাও বলেন কিন্তু ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাচ্ছিল অসহায়তা। সমগ্র বিষয়টি অঙ্গুলিহেলনেই ঘটছে, কিন্তু যার সঞ্চালনা তিনি মেডিক্যা লের কর্তৃপক্ষ নন। কর্তৃপক্ষ নতিস্বীকার করেছেন দলীয় নেতাদের কাছে। ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে গেছে। যা অত্যষন্ত লজ্জাজনক ও ভীতির কারণ।”
পল্লব কীর্তনীয়া, চিকিৎসক ও গায়ক
“সরকার আন্দোলন কারীদের বাজিয়ে দেখতে চাইছে, কিন্তু লাভ হবে না। ছাত্রদের হার না মানা জিদের কাছে মাথা নোয়াতেই হবে। জিতবে ছাত্ররাই। এরই মধ্যে যদি কোনও অঘটন ঘটে তার দায় সরকারের। মানুষ তাদের ছেড়ে দেবে না।”
প্রদোষ পাল, চিত্রশিল্পী
“আশ্চর্য লাগছে, প্রায় দশ বারো দিন হয়ে গেল, হস্টেলের দাবিতে অনিকেতরা অনশন করছে অথচ সরকার কোনও রকম পাত্তা দিচ্ছে না! যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৬ দিন অনশন করে ক্ষমতা বদলের ভীত মজবুত করেছিলেন, মাত্র সাত বছরে এতটাই হৃদয়হীন হয়ে পড়েছেন, কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মৃতপ্রায়, তিনি এখানে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছেন, উপঢৌকন বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন অথচ একবারও ছেলেগুলোকে দেখতে আসতে পারলেন না? কয়েকজন প্রতিনিধিকেও তো পাঠাতে পারতেন! ক্ষমতা কী এই, যা চেটে খেতে খেতে এতটাই হৃদয়হীন হয়ে যায় মানুষ? যদি সত্যিও কোনও অঘটন ঘটে যায়, নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন তো!”

