ডিআরএস চালু হয়েছিল ভুল সিদ্ধান্ত কমাতে জন্য, আজ তা স্ট্র্যাটেজির অঙ্গ হয়ে উঠেছে
দলের সেরা ব্যাটসম্যান আউট হলেই রিভিউ আবেদনের প্রবণতা বাড়ছে
- Total Shares
ডিকি বার্ড থেকে শুরু করে স্টিভ বাকনার - বিশ্ব ক্রিকেটে এমন অনেক আম্পায়ার রয়েছেন যাঁরা ক্রিকেট ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেই আমি বলছি যে আধুনিক ক্রিকেটের চাপ তাঁদের কোনও দিনও নিতে হয়নি। তাঁদের বড়জোর বিপক্ষ দলের ফিল্ডারদের, বিশেষ করে বোলারদের অ্যাপিলের চাপ সামলাতে হয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির সাহায্যে তাঁদের সিদ্ধান্ত কাটাছেঁড়া কোনও দিনও হয়নি।
সেই অর্থে, ক্রিকেট আম্পায়ারদের প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯২ সালে। সেই বছর নভেম্বর মাসে ডারবানে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ম্যাচ বসেছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের জন্য তৃতীয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে কোনও ব্যাটসম্যানকে রান আউট ঘোষণা করা হয়েছিল সেই ম্যাচে। ব্যাটসম্যান ছিলেন আমাদের অতি প্রিয় সচিন তেন্ডুলকর।
এই তৃতীয় আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বেশ কিছুকাল অবধি শুধুমাত্র স্ট্যাম্প আউট রান আউট বা হিট উইকেট অবধি সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে অবশ্য তৃতীয় আম্পয়ারকে আরও অনেক বেশি কাজ করতে হয়।
অধুনা ক্রিকেটে আম্পায়ারিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে ডিআরএস বা ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এই ব্যবস্থাটি আদতে সিদ্ধান্ত মূল্যায়নের প্রক্রিয়া। ক্রিকেট মাঠে অনেক ক্ষেত্রেই আম্পয়ারদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হতে হয় ব্যাটসম্যানদের। আর সেই ভুল সিদ্ধান্তগুলো যতটা সম্ভব কমানোর জন্যেই নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা, নানান প্রযুক্তির ব্যবহারের পরে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে চাপে থাকেন অধুনা ক্রিকেটের আম্পায়াররা
আইনানুযায়ী দুই ধরণের ডিআরএস হতে পারে। একটি হল আম্পায়ার ডিসিশন রিভিউ। অর্থাৎ আম্পায়ার নিজে থেকেই তৃতীয় আম্পায়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রযুক্তির সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ক্লিন ক্যাচের ক্ষেত্রে বল মাটিতে বাম্প করে উঠেছে কিনা বা ফিল্ডারের হাতে পৌঁছানোর আগে বল মাটি ছুঁয়েছিল কিনা তা জানতে আম্পায়ার এই ব্যবস্থার শরণাপন্ন হতে পারেন।
দ্বিতীয় ব্যবস্থাটিকে বলা হয় প্লেয়ার ডিসিশন রিভিউ। আম্পায়ারের কোনও সিদ্ধান্ত যে দলের বিরুদ্ধে যাবে সেই দল মনে করলে সিদ্ধান্ত পুনর্মূ্ল্যানের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে এই রিভিউ জানানোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। টি-২০ ও একদিনের ক্রিকেটে প্রতি ইনিংসে একটি দল মাত্র একবার রিভিউ জানাতে পারবে। টেস্ট ক্রিকেটে প্রতি ৮০ ওভারে দু'বার রিভিউ জানাতে পারবে।
ডিআরএস এখন স্ট্র্যাটেজির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে
এই রিভিউ নষ্ট হওয়ারও কিছু শর্ত রয়েছে। যদি আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রমাণিত হয় তাহলে এই রিভিউ গণ্য (নষ্ট) হবে না। আরও একটি ক্ষেত্রে রিভিউ নষ্ট হবে না। এলবিডব্লিউর ক্ষেত্রে দল রিভিউ করলে যদি দেখা যায় অল্পের জন্য ব্যাটসম্যান আউট হয়েছেন, রিভিউ করার সিদ্ধান্তটা ঠিক, সে ক্ষেত্রেও রিভিউ নষ্ট হবে না।
এই মুহূর্তে আম্পায়ারদের সমস্যা অন্য জায়গায় হচ্ছে। আগেই বলেছি, এই ডিআরএস ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল ভুল সিদ্ধান্তগুলো কমানোর জন্য, কিন্তু এখন ক্রিকেটাররা এটাকে স্ট্র্যাটেজির অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছেন।
শেষ আইপিএল করাতে গিয়ে আমি এটা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করাতে পেরেছি। টি-২০টি মাত্র একটি রিভিউ পাওয়া যায়, আর দলের সেরা ব্যাটসম্যানকে এলবিডব্লু দেওয়া মানেই কোনও কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই রিভিউ চেয়ে নেওয়া হচ্ছে। একই ঘটনা ঘটছে শেষ ওভারে। যদি দেখা যায় ব্যাটিং দল তখনও অবধি রিভিউ নেয়নি তা হলে শেষ ওভারে ব্যাটসম্যান এলবিডব্লু হলেই অবধারিত রিভিউ করতে চাইবেন। আম্পয়ারের সিদ্ধান্ত ঠিক সে ব্যবপারে ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত হয়েও রিভিউ চাওয়া হয়। স্ট্রাটেজিটা বেশ পরিষ্কার, যদি ১ শতাংশ সম্ভাবনাও সত্যি হয় তা হলে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা সুযোগটা কাজে লাগিয়ে শেষ কয়েকটি বল খেলা যাবে। কই, শেষ বলে আউট হলে তো রিভিউ চাওয়া হয় না?
ভারত ইংল্যান্ড ম্যাচের শেষ দিনের আগে আমি বন্ধু বান্ধবদের বলেছিলাম যে বিরাটকে কেন্দ্র করে রিভিউ হবেই হবে। আমার পর্যবেক্ষণই সত্যি হল। দু'বার রিভিউ চাওয়া হল। প্রথমবার ইংল্যান্ডের অ্যাপিল গ্রাহ্য না করে নটআউট দিয়েছিলেন অনফিল্ড আম্পায়ার। ইংল্যান্ড রিভিউ চাইল। রিপ্লেতে দেখা গেল আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত সঠিক। এর পর আবার ইংল্যান্ডের অ্যাপিলে সাড়া দিয়ে আম্পয়ার বিরাটকে আউট দিলেন। ভারত রিভিউ চাইল। এ ক্ষেত্রেও দেখা গেল আম্পয়ারের সিদ্ধান্ত একেবারে সঠিক ছিল। বিরাটকে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হল।
একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের মার্চ অবধি দেখা গিয়েছে যে প্লেয়ার রিভিউর মাত্র ২৬ শতাংশ খেলোয়াড়দের পক্ষে গিয়েছে। অর্থাৎ, ৭৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে আম্পয়ারের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল।
একটি এলবিডব্লুর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দু'ভাবে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে। প্রথমত বল ব্যাটে লেগেছিল কিনা। যতই প্রযুক্তি থাক না কেন, এ কথা ব্যাটসম্যান নিজেই সব চেয়ে ভালো বুঝতে পারেন। দুই, বলটা কী শেষ পর্যন্ত স্টাম্পে লাগত? তা বেশি ভালো আন্দাজ করতে পারেন উল্টোদিকের (রানার্স এন্ডের) ব্যাটসম্যান। এর পরে যদি সন্দেহের অবকাশ থাকে তবেই রিভিউ করা উচিত।
কিন্তু রিভিউর হার যে পরিমাণে বেড়েছে তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার। সন্দেহের অবকাশ আছে বলে নয়, স্ট্রাটেজির অঙ্গ হিসেবেই রিভিউ করেন খেলোয়াড়রা।

