কলকাতায় কী ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল এশিয়ার প্রথম মনঃসমীক্ষা প্ৰতিষ্ঠা?
মানসিক সমস্যার প্রতিকারে পুরো মহাদেশেই পথিকৃৎ, আজও প্রাসঙ্গিক
- Total Shares
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'মন' প্রবন্ধে এক জায়গায় লিখেছেন:
"কোনো কৌতুকপ্রিয় শিশু দেবতা যদি দুষ্টামি কোরিয়া ঐ আতাগাছটির মাঝখানে কেবল একটি ফোঁটা মন ফেলিয়া দেয়, তবে ঐ সরস শ্যামল জীবনের মধ্যে কী এক বিষম উপদ্রব বাধিয়া যায়।... তখন সমস্ত দিন এক পায়ের উপর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিতে থাকে, 'আমার কেবল কতগুলো পাতা হইল কেন, পাখা হইল না কেন।... আমি আছিও বটে, নাইও বটে, এ প্রশ্নের যতক্ষণ না মীমাংসা হয়, ততক্ষণ আমার জীবনে কোনো সুখ নাই।" (মন, সংকলন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ)
তাহলে বুঝে দেখুন যদি এক ফোঁটা মনে আতাগাছটির এরূপ অবস্থা হয়, তবে সমগ্র ভাবে মনের দ্বারা পরিচালিত মানুষের অবস্থা কী রূপ হবে, আমাদের মনুষ্য-জাতির পক্ষে মন নামক বস্তুটি যে অনেক সময় কি বিষম বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা আজ যাঁর সম্বন্ধে আলোচনা করছি, তিনি মানব মনের এই বিড়ম্বনার হাত থেকে মানুষকে স্বস্তিদানের জন্যে তাঁর বহুমূল্যমান জীবনের অধিকাংশ ব্যয় করেছিলেন। ভারতবর্ষে মনোচিকিৎসা ও মনোসমীক্ষার ক্ষেত্রে গিরীন্দ্রশেখরের অবদান তুলনাহীন। বস্তুত এ ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন আজও হয়নি। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও বিশাল কর্মকাণ্ডের পরিচয় এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা শুধু বিশেষ কয়েকটি দিক তুলে ধরব।
গিরীন্দ্রশেখরকে ভারতবর্ষের মনঃসমীক্ষার জনক বলা হয়
গিরীন্দ্রশেখরের জন্ম সম্ভবত ৩০শে জানুয়ারি, ১৮৮৭ সালে। আমরা সম্ভবত শব্দটি ব্যবহার করছি কারণ জন্ম সালটি বিবাদিত। তাঁর জন্মসালের এই অনিশ্চয়তা থেকেই বোঝা যায় আমরা গিরীন্দ্রশেখরের প্রতি কতটা উদাসীন ছিলাম। গিরীন্দ্রশেখর মজা করে বলতেন, "আমি মাথা উঁচু করেই এ জগতে প্রবেশ করেছিলাম।" অর্থাৎ, তিনি 'ব্রিচ বেবি' ছিলেন। পা দুটি আগে এবং মাথা পরে অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়ে ছিলেন। এর যথেষ্ট প্রতিদানও তাঁকে দিতে হয়েছিল। এর একটি পা অন্য পায়ের তুলনায় একটু ছোট ছিল।
তিনি নিজের শৈশব সম্বন্ধে আরও একটি গল্প বলতেন যে তিনি পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের স্তন্যপান করেছিলেন এবং গর্বভরে বলতেন এর ফলে তাঁর কোনও নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়নি। বরং, তাঁকে অত্যন্ত সার্থক ব্যক্তিত্ব দান করেছিল।
গিরীন্দ্রশেখর তাঁর পিতা চন্দ্রশেখর বসুর তৃতীয় পত্নী লক্ষ্মীমণি দেবীর ন'টি সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। চার ভাই - শশিশেখর, রাজশেখর (যিনি পরশুরাম ছদ্মনামে লিখতেন), কৃষ্ণশেখর ও গিরীন্দ্রশেখর - প্রত্যেকেই অত্যন্ত কৃতী ছিলেন। এদের মধ্যে রাজশেখর বসুর সঙ্গেই তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। গিরীন্দ্রশেখরের প্ৰতিষ্ঠিত লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল রাজশেখর বসুর প্রদত্ত জমির উপরই তৈরি হয়েছিল।
পিতা চন্দ্রশেখর দ্বারভাঙ্গার রাজার দেওয়ান ছিলেন। বিচক্ষণতা, সততা ও ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রে, বিশেষ করে বেদান্ত চর্চায়, তাঁর কয়টি ছিল। মাতা লক্ষ্মীমণি প্রখর বুদ্ধিশালী ও কল্পনাপ্রবণ ছিলেন। তাঁর পড়াশোনার পরিধিও যথেষ্ট বিস্তৃত ছিল। এই রূপ পারিবারিক পরিবেশে গিরীন্দ্রশেখর বড় হয়েছিলেন। পিতা কর্মসূত্রে দ্বারভাঙ্গায় থাকার কারণে গিরীন্দ্রশেখরের শৈশবও উত্তর বিহারে কেটেছিল।
অবসর গ্রহণের পর চন্দ্রশেখরও দ্বারভাঙ্গা থেকে কলকাতায় আসেন। বাহ্ম পাড়া বলে পরিচিত পার্সিবাগান লেনে একটি বাড়ি তৈরি করেন ও সেখানেই বসবাস শুরু করেন। কঠোর রুক্ষণশীল নদিয়ার ব্রাহ্মণ সমাজ চন্দ্রশেখরের বেদান্তচর্চা সুনজরে দেখতেন না তিনি কুলীন-কায়স্থ ছিলেন বলে। তাই, চন্দ্রশেখর ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত ছিলেন।
শশিশেখর বসুর 'যা দেখেছি যা শুনেছি' গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, "তিনি বিলক্ষণ ব্রাহ্ম মনোভাবাপন্ন ছিলেন। নিয়মিত সমাজে উপাসনায় যেতেন। কারণ কিন্তু মূলত ধর্ম নয়, তৎকালীন নদিয়ার কট্টর ব্রাহ্মণ বর্গ চন্দ্রশেখরের বেদ-পুরাণের অপার জ্ঞানতৃষ্ণায় বাধা দিতেন বলেই এই ব্রাহ্ম সক্তি। ব্রাহ্মরাও যে গিরীন্দ্রশেখরকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করে ছিলেন তা নয়। তাঁরা বসু পরিবারের রক্ষণশীলতা, গুরুভক্তি, কুলদেবতা, ইষ্টদেবতার প্রতি নিষ্ঠা প্রভৃতি সহজ মনে গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু চন্দ্রশেখর ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি যথেষ্ঠ নিষ্ঠাবান ছিলেন। এমনকি তাঁর ছেলেদেরও উপাসনায় যোগদানের জন্যে নিয়ে যেতেন। পার্সিবাগনে অনেকেই তাঁদের ব্রাহ্ম বলেই মনে করতেন।
আমরা গিরীন্দ্রশেখর শৈশব সম্বন্ধে অল্পই জানি। পিতার স্নেহপূর্ণ শাসন, ভারতীয় দর্শনে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য আর মাতা লক্ষ্মীমণির রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের গল্পের রজোময় পরিবেশে তাঁর মানস পরিপুষ্ঠ হয়ছিল।
গিরীন্দ্রশেখর দ্বারভাঙ্গা থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯০৩ সালে কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে এফ.এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯০৪ সালে ১৭ বছর বয়েসে ইন্দুমতী দত্তের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁদের দুটি কন্যা - দুর্গাবতী ও কমলাবতী। দুর্গাবতীর বিবাহ ব্যারিস্টার রবীন্দ্রচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে ও কমলাবতীর বিবাহ চিকিৎসক কৃষ্ণকিশোর দত্তের সঙ্গে হয়। ১৯০৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন ও শরীরবিদ্যায় দু'টি বিষয়েই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯১০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবি পাস করেন ও মেডিক্যাল প্র্যাক্টিস শুরু করেন। অগ্রন্থিত গিরীন্দ্রশেখর গ্রন্থে গিরীন্দ্রশেখর বসুর ভাইপো চিকিৎসক বিজয়কেতু বসুর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ বসু জানাচ্ছেন প্রতিদিন সকালে গিরীন্দ্রশেখর একটি ফ্রি আউটডোর চালাতেন। আসে পাশের পাড়ার বস্তির অনেক রোগীর তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন। পাড়ার প্রায় সব পরিবারের তিনি পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। আউটডোর পরিচালনায় অনেক অল্পবয়েসী চিকিৎসক তাঁকে সাহায্য করতেন।
বেলা দশটার পরে তিনি রোগী দেখতে বেরোতেন। এই রোগীদের মধ্যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুও ছিলেন। দেখা যাচ্ছে, একদিকে তিনি যেমন দুঃখী ও গরিব মানুষদের চিকিৎসা বিনামূল্যে করতেন, তেমনি যাঁদেরকে নেটিভ প্রিন্স বলা হয়, তাঁদেরও চিকিৎসা করতেন।
মনঃসমীক্ষা ও মনো চিকিৎসার জগতে গিরীন্দ্রশেখরের পরিবেশ ফ্রয়েডের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পূর্বে ঘটেছিল। তিনি নিজের মতো করে মানসিক চিকিৎসা করতেন। নানান মৌলিক পদ্ধতি প্ৰয়োগ করে রোগীদের নিরাময় করবার চেষ্টা করতেন। সে সময় মানসিক চিকিৎসার অর্থ 'লুন্যাটিক অ্যাজাইলামে' রোগীদের ভর্তি করা। মানসিক রোগীকে পরিবারের সদস্য রূপে গ্রহণ করে, তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে তাদের অংশীদার করার ভাবনার মধ্যে ছেদ পড়েছিল। গিরীন্দ্রশেখর তাঁর এই চিকিৎসার মাধ্যমে স্বভাবী ও অস্বভাবী মনের এই দ্বৈতভাব দূর করবার চেষ্টা করতেন। তিনি মানসিক রোগীদের খুব অল্প ওষুধ দিতেন। কথাবার্তা বলা ও অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি তাদের সুষ্ঠ করে তোলার চেষ্টা করতেন। এই প্রসঙ্গে লক্ষ্য করবার বিষয় হল গিরীন্দ্রশেখর কিন্তু তখনও ফ্রয়েডের লেখার সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। অর্থাৎ, মনচিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু কিছু মনঃসমীক্ষণের প্ৰয়োগ ভারতবর্ষে ফ্রয়েডের প্রভাব ছাড়াই শুরু হয়েছিল গিরীন্দ্রশেখরের মাধ্যমে।
৯৬ বছর পরেও এই সমিতি আজও মানসিক রোগগ্রস্থ ব্যাক্তিদের সাহায্য করে চলেছেন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর যখন ফ্রয়েডের কিছু রচনার ইংরেজি অনুবাদ ভারতে আসতে শুরু করল তার পূর্বেও মনোবিদ্যায় সম্যক জ্ঞানলাভের গিরীন্দ্রশেখর মনোবিদ্যা পড়তে চেয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিদ্যা বিভাগ প্রবর্তন করেন। বিশেষ অনুমতি নিয়ে গিরীন্দ্রশেখর এক বছরে মনোবিদ্যায়ে এমএ পরীক্ষা দিয়ে ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে মনোবিদ্যা বিভাগের আংশিক শিক্ষকরূপে নিযুক্ত করা হয়। এই বিভাগে ১৯২৯ সালে বিভাগীয় প্রধান হন এবং ১৯২৩ সালে প্রফেসর পদে উত্তীর্ণ হন। চিকিৎসক থেকে মনোচিকিৎসক হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবার পথে তার দ্বিতীয় কৃতিত্ব হল প্রয়োগিক মনোবিদ্যায় মৌলিক গবেষণার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি পাওয়া। এই থিসিসের সঙ্গে মনঃসমীক্ষার জগতে প্রবেশ করলেন গিরীন্দ্রশেখর। ভারতের মনোবিদ্যা জগতে এই থিসিসকে যুগান্তকারী বলা হয়। গিরীন্দ্রশেখর এই থিসিসে অবদমনের একটি নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা ফ্রয়েডের অবদমনের তত্ত্ব থেকে পৃথক।
গিরীন্দ্রশেখর যখন এই তত্ত্ব তৈরি করেন তখন তখনও ফ্রয়েডের লেখার সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচিতি ঘটেনি। জার্মান ভাষা তখনও তিনি শিখতে শুরু করেননি। পত্রিকা প্রকাশিত টুকরো টুকরো ইংরেজি অনুবাদ ছাড়া ফ্রয়েডের আর কোনও লেখাই তাঁর পড়ার সুযোগ ছিল না। তাই, গিরীন্দ্রশেখরকে ভারতবর্ষের মনঃসমীক্ষার জনক বলা হয়।
১৯২১ সাল থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত ফ্রয়েডের সঙ্গে গিরীন্দ্রশেখরের পত্রাচার চলে। ১৯২২ সালের ১ জানুয়ারি ভারতীয় মনঃসমীক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্লয়েড ও জোনসের অনুকূল্যে এটি খুব শীঘ্রই আন্তর্জাতিক মনঃসমীক্ষা সংস্থার সদস্য রূপে স্বীকৃতি লাভ করে। সেই সঙ্গে ফ্রয়েড ও অন্যান্য সমীক্ষকদের মতো গিরীন্দ্রশেখরও স্বীকৃত সমীক্ষক রূপে স্বীকৃতি পেলেন।
গিরীন্দ্রশেখর তাঁর নিজ বাসভবনের এক তলায় এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ৯৬ বছর পরেও এই সমিতি আজও সেই স্থান থেকেই মানসিক রোগগ্রস্থ ব্যাক্তিদের সাহায্য করে চলেছে।
সুতারং, বলা যেতেই পারে যে এশিয়ার সর্বপ্রথম মনঃসমীক্ষা সমিতি শুধুমাত্র ভারতবর্ষের মানসিক চিকিৎসার পথিকৃৎই নয় আজকের দিনেও তা সমান যুগোপযোগী।

