মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর জন্য বিভিন্ন দেশ ইসরোকে কেন ভরসা করে?
ভারতের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হয়ে ওঠার পেছনে ইসরোর বড় ভূমিকা রয়েছে
- Total Shares
সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র (ইসরো) শ্রীহরিকোটা থেকে দুটি বিদেশি কৃত্রিম উপগ্রহ সফল ভাবে উৎক্ষেপণ করে। এই পিএসএলভি সি-৪২ এমন ভাবে তৈরি করা হয় যাতে দুটি আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা যায় - নোভা এসএআর এবং এস-১ (দু'টি উপগ্রহের মোট ওজন হবে ৮৮৯ কেজির কাছাকাছি)। যুক্তরাজ্যের এম/এস সারে স্যাটেলাইট টেকনোলজিস লিমিটেড (এসএসটিএল) বাণিজ্যিক ভাবে এন্ট্রিক্স কর্পোরেশন লিমিটেড, ডিপার্টমেন্ট অফ স্পেসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগো এই কাজটি করেছে।
বনজঙ্গলের ভেতরে কোথায় কী রয়েছে, ভূমির ব্যবহার, কোন অঞ্চল ঠিক কতখানি তুষারাবৃত, বন্যা, বিপর্যয় পর্যবেক্ষণ, মাপজোপ করা, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা ও শহরের ব্যবস্থাপনা করায় এই দুটি উপগ্রহ সহায়তা করবে।
এতে ইসরোর উপার্জন হবে। মনে করা হচ্ছে যে এই বাণিজ্যিক উৎক্ষেপণের ফলে ইসরোর কোটি কোটি টাকা আয় হবে।
বাণিজ্যিক ভাবে ইসরো ১৯৯৯ সাল থেকেই অন্য দেশকে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাতো সহায়তা করে আসছে।
পিএসএলভি সি-৪২ মিশনটি তৈরি করা হয় যাতে দুটি আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা যায় - নোভা এসএআর এবং এস-১ (ছবি:স্ক্রিনগ্র্যাব/ইসরো)
এর আগে বিভিন্ন ক্রেতাদের জন্য ইসরো প্রায় ২৩৭টি কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। বেশিরভাগ উপগ্রহই ছিল ছোট ও অতিক্ষুদ্র (ন্যানো) আকারের, মোটামুটি ৫০ কেজি ওজনের। এখন এই ধরণের উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে ভারতকে অন্য দেশের উপর নির্ভর করতে হয় না বরং অন্য দেশের উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে ইসরো উপার্জন করে। বর্তমান মিশনটিকে নিয়ে এই ধরণের পাঁচটি মিশন এখনও পর্যন্ত করা হয়েছে যেখানে ক্রেতার পেলোডকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
ইতালি, ইজরায়েল, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুরের জন্য এই ধরণের উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ভাবে যতগুলো উৎক্ষেপণ হয়েছে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্য ভারত কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। যেমন - ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যথা জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং ডেনমার্ক থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়ার সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কাজাখস্তান, তুরস্ক এবং আলজেরিয়া। অন্যদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া আবার উত্তর আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা।
ভূমির ব্যবহার, কোন অঞ্চল ঠিক কতখানি তুষারাবৃত, বন্যা, বিপর্যয় পর্যবেক্ষণ, মাপজোপ করা, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা ও শহরের ব্যবস্থাপনা করায় এই দুটি উপগ্রহ সহায়তা করবে (ছবি:রয়েটর্স/ফাইল)
এই সমস্ত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সহযোগিতাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক দিক থেকে বিচার করলে চলবে না, এই দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের একটা ভূকৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটা উঠে আসে সেটা হল এইসব দেশগুলো ইসরোর থেকে এই পরিষেবা কেন নিচ্ছে? একটা জানার বিষয় হল পৃথিবীতে মোট দশটি এমন দেশ আছে যারা কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য দেশগুলিকে এই কটি দেশের উপরেই নির্ভর করতে হয়। এই দশটি দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়া এবং ইরান কিছুটা হলেও প্রাথমিক স্তরে উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম তবে এই দেশগুলির কূটনৈতিক ভাবে অচ্ছুৎ।
বর্তমানে সচেতন ভাবে যাদের থেকে উৎক্ষেপণ পরিষেবা নেওয়া যেতে পারে সেগুলি হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান ও চিন। যদিও ভারত এই বাজারে মাত্র কয়েকদিন হল প্রবেশ করেছে তবে তুলনামূলক ভাবে ভারতের উপরে অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় বারত থেকে উৎক্ষেপনে অনেক কম খরচ বলে ইতিমধ্যেই ভারত এই বিষয়ে নজর কেড়েছে।
পোলার স্যাটেলাইট ভেহিক্যাল (পিএসএলভি) কে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরশীল উৎক্ষেপণ পদ্ধতি বলে মনে করা হয় (ছবি: ইসরো)
পোলার স্যাটেলাইট ভেহিক্যাল (পিএসএলভি) কে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরশীল উৎক্ষেপণ পদ্ধতি বলে মনে করা হয়। এখন ইসরো বেসরকারি সংস্থাকে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা করছে যাতে এই সব সংস্থাগুলিকে ইসরো তাঁদের উৎক্ষেপণ পরিষেবা ভাড়া দিতে পারেন। ফলে ইসরো গবেষণার দিকে আরও বেশি মনোবনিবেশ করতে পারবে।
বেশ কয়েক বছর হল ইসরোর বিশ্ব জোড়া নাম ও খ্যাতি হয়েছে। আর তার চেয়েও বড় যে ব্যাপার সেটা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স এবং ইজরায়েলে উৎক্ষেপণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তারাও ইসরোর উপরেই নির্ভর করে।
তাই ভারতের অন্যতম বড় অসামরিক শক্তিকেন্দ্র হয়ে উঠতে ইসরোর একটা বড় অবদান রয়েছে। যে সব দেশ অসামরিক শক্তির অধিকারী তারা অন্যান্য দেশের পছন্দ-অপছন্দের উপরে কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অন্য দেশগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করাই নয় অন্য দেশগুলির সঙ্গে নিজের শর্তকে বজায় রেখে চুক্তি করার জায়গায় পৌঁছে গেছে।
বর্তমানে এমন বহু দেশ আছে যারা ইসরোর সাফল্যকে সম্ভ্রমের নজরে দেখে। চন্দ্র এবং মঙ্গল গ্রহের মিশনের সাফল্যের পর আমরা বিশ্বের নজর কেড়েছি। এছাড়াও পর পর ১০৪টি কৃত্রিম উপগ্রহের উৎক্ষেপণ করে আমরা নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছি।
মহাকাশে উৎক্ষেপণের দিক দিয়ে বিচার করলে ভারত অন্যতম। তবে দুর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলি এই বিষয় এখনও পর্যন্ত ভারতকে খুব একটা নেক নজরে দেখে না এবং তারা উৎক্ষেপণের জন্য ইউরোপ এবং চিনের উপরেই নির্ভর করে। এমনকি অনেক খোশামোদ করার পর এই দেশগুলি অবশেষে কৃত্রিম উপগ্রহের যে সাউথ এশিয়ান প্রোগ্রামে যুক্ত হয়েছে।
পর পর ১০৪টি কৃত্রিম উপগ্রহের উৎক্ষেপণ করে আমরা নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছি (ছবি:পিটিআই)
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের বহু দেশ অনেক উন্নতি করেছে। যদিও এমন বহু দেশ আছে যারা রকেট সায়েন্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখনও একেবারেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করে না। যেই দেশ মহাকাশ প্রযুক্তিতে যতটা উন্নত সেই দেশ তত বেশি শক্তিশালী এবং তার সম্মানও অনেক বেশি। যেসব দেশের হাতে পরমাণু শক্তি আছে সেই দেশ সামরিক শক্তির অধিকারী আর যেই দেশ মহাকাশ প্রযুক্তিতে উন্নতি করেছে তারা অসামরিক শক্তির অধিকারী।
বেশ কয়েক দশক ধরে এই প্রযুক্তি ভারতের মতো বহু দেশের আর্থসামাজিক বিষয়সূচির নির্ধারক হয়েছে। এমনকি হার্ড পাওয়ার তৈরির পেছনে যে প্রধান হল সৈন্য, তার উপরেও প্রভাব ফেলেছে।
বর্তমানে ইসরো স্যাটেলাইট লঞ্চ বাণিজ্যিক মডেলের মাধ্যমে মহাদেশগুলি এবং তার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য কাজ করছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে হোক বা টেলিফোন যোগাযোগের ক্ষেত্রেই হোক অথবা ব্যবসার ক্ষেত্রেই হোক ইসরো সর্বত্র নিজের পদচিহ্নিত রেখেছে।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন

