পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ সমস্যা এখন কোন জায়গায়

অসমের মতো এ রাজ্যেও প্রকৃত ভারতীয় বাছাই শুরু হলে কী হবে

 |  6-minute read |   03-08-2018
  • Total Shares

আইন, সংসদে আনা বিল এবং এনআরসির কথা থাক। কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাক অসমের কথাও। এ রাজ্যে উদ্বাস্তু সমস্যা এখন কোন জায়গায়? একটা কালিম্পং কিংবা একটা হাড়দহের কথা থাক। দেখা যাক এ রাজ্যে সামগ্রিক ভাবে উদ্বাস্তু সমস্যা ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

body1_080318064026.jpgরোহিঙ্গারা নগন্য ছাড়াও এ রাজ্যে অনুপ্রবেশ সমস্যা দীর্ঘদিনের

২০১১ সালের সেই দিন

মনে করা যাক ২০১১ সালের বিজয়াদশমীর কথা। তখন সদ্য ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। কয়েক শত বছরের প্রথা মেনে সেদিনও ইছামতীর দু-পাড় থেকে শুরু হয়েছিল বিসর্জন। প্রথমে দুই পাড়ের, পরে দুই বাংলার প্রথা মেনে সেই বিসর্জন কেন বন্ধ হয়েছিল সে কথা এখনও মনে করতে পারেন টাকি-হাসনাবাদ-বসিরহাটের মানুষ।

সেই রাতে বাংলাদেশি বিশাল বিশাল নৌকা ভারতের জলভাগে নোঙর করেছিল। তারপরে পিলপিল করে ঢুকেছিল বাংলাদেশি। স্থানীয়রা বলছেন অন্তত দেড় লক্ষ, তবে খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী হাজার দশেক। অভিযোগ, তার আগে নাকি ওপার থেকে মাইকে বেশ কিছু ঘোষণা হয়েছিল। যাঁরা সেই ঘটনার সাক্ষী তাঁরা বলছেন সেই রাতে অন্তত দেড় লক্ষ লোক ঢুকেছিল। তারপর? সারা রাত ম্যাটাডোর ও অন্য গাড়ি করে তারা বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়।

কেন বিএসএফ-পুলিশ আটকায়নি কাউকে? নিতান্ত পরিচিত এক পুলিশকর্তা বলেছিলেন, “কিছু করতে পারব না, ওপর থেকে নির্দেশ আছে।” তাই সেই রাতের কোনও ছিনতাই চুরি এবং একাধিক ধর্ষণের কোনও অভিযোগ হয়নি থানায়।

এখন কী অবস্থা

উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক উত্তর ২৪ পরগনার কথা। রাজ্যের বনগাঁ ও বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে ঢোকা অনুপ্রবেশকারী, যারা ধরা পড়ে, তাদের সংখ্যা মোটামুটি শ-আড়াই। আর যারা ধরা পড়ে না, তাদের সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে মনে করেন ওই সব এলাকার মানুষজন। তাও এটি বর্তমান হিসাব, মানে কড়াকড়ি হওয়ার পরের হিসাব। উত্তরবঙ্গেরও অনেক জায়গাতেই কারাগারগুলোয় থাকা বেশিরভাগ বন্দিই এখন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।

body2_080318064104.jpgদুদেশের সীমান্তের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে নদী (গুগলম্যাপ)

১৯৪৭-৪৮ বা ১৯৭১-এর হিসাব অন্য। একটি দেশভাগের সময়, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধের সময়। কিন্তু চিরকালই দেশের পূর্বদিকের রাজ্য দিয়ে কোনও বৈধ নথি বা অনুমোদন ছাড়াই যে এ রাজ্যে লোক ঢুকে চলেছে, তার প্রমাণ হল ধরা পড়ার তালিকা আর সীমান্তের জেলাগুলোতে জনবিস্ফোরণ। উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলাতেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, এক তো বটেই, কোনও ক্ষেত্রে একাধিক দেশের সঙ্গে। প্রতিটি জেলাই বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত। এই সব রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিত্যদিনের ঘটনা।

কী ভাবে অনুপ্রবেশ

ভারত ও প্রতিবেশী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে যে সীমান্ত তার কিছুটা জঙ্গল, কিছুটা নদী বাকিটা সমতল। সমতলের পুরো অংশটি বেড়া দেওয়া নয়, এখনই বেড়া দেওয়া সম্ভবও নয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, দক্ষিণ দিনাজপুরের হাড়িপুকুরের কথা। কাঁটা তারের বেড়া রয়েছে, কিন্তু বেড়ার ওপারে থাকেন ভারতীয়রাও। তাঁরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে এপারে ঢোকেন, ওপারেও যান। কারণ কারও বাড়ি ওপারে জমি এপারে, কারও উল্টোটা। এখানে একাংশ ভাগ হয়েছে জনবসতির উপর দিয়ে। তাই বেড়া দেওয়ার উপায় নেই। কোনটা কোন দেশ, বোঝারও উপায় নেই। এখন ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে খুব উপকার হয়েছে, এ কথা বলা মুশকিল।

বাকি অংশে সীমান্ত পারাপার করার জন্য দালাল আছে। জনপিছু মোটামুটি ২০,০০০ টাকা করে নেয়। সাত-আট জনের দল হলে তখন ৮০-৯০ হাজার টাকায় রফা হয়। তারপরে রাতের বেলা পার করা হয় যে অংশ অন্ধকার, সেখান দিয়ে। প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে যোগসাজস না থাকলে যে তা অসম্ভব, সে কথা মানছেন অনেকেই। তবে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর থেকে, মোটামুটি ২০১৫ সাল নাগাদ কড়াকড়ি শুরু হয়েছে, তাই এখন অনুপ্রবেশ কমেছে।

কত লোক ঢুকেছে

কত লোক ঢুকেছে? এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। তবে একবার যদি পশ্চিমবঙ্গেও আসল ভারতীয় খোঁজা শুরু হয় তা হলে ফল কী দাঁড়াবে?

উত্তরবঙ্গ নিয়ে ভালোমতো ধারণা রয়েছে এমন এক ব্যক্তি বললেন, “ধরুন মালদহ আর দুই দিনাজপুরে ঠিকমতো খোঁজা হলে ৫০ শতাংশ লোক দেখা যাবে ১৯৭১ সালের পরে এসেছেন। তাঁদের সকলের ভোটার ও আধার কার্ড রয়েছে, কেউ সরকারি চাকরি করেন। দেখবেন হয়তো দু’একজন জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন।”

body_080318064141.jpgবহু মানুষকেই নিয়মিত সীমান্ত পার হতে হয়

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় জমির দাম কী হারে বেড়েছে তা দিয়েও আন্দাজ করা যেতে পারে। নতুন করে রেল পাতা হবে বলে বালুরঘাট স্টেশনের জন্য যখন জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল, সে জন্য ১৯৯৮ সালে যে ধানী জমির দাম ছিল ২০,০০০ টাকা বিঘা, এখন তার দাম বেড়ে হয়েছে ৬-৭ লক্ষ টাকা। কী শহর কী গ্রাম, সর্বত্র বেড়েছে জমির দাম। গজিয়ে উঠেছে বস্তি।

কেন ঢুকছে

মূলত চারটি কারণে এ দেশে লোক অবৈধ ভাবে প্রবেশ করছে। প্রথমত রোজগারের জন্য। এরা শ্রমিকশ্রেণী। বেশিরভাগই কেরল ও মুম্বইয়ে যায় কাজ করতে। সাত-আটমাস কাজ করার পর বেশিরভাগই নিজের দেশে ফিরে যায়। একাংশ থেকে যায় এ দেশে।

এ রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায়। অনেকে চিকিৎসা করাতে এ দেশে আসেন, এঁরা মোটামুটি সকলেই চিকিৎসার পরে ফিরে যান। এখনও চিকিৎসার জন্য আধার কার্ড আবশ্যিক হয়নি, তাই কোনও রকম পরিচয়পত্র দাখিল না করেই তাঁরা নিখরচায় চিকিৎসা করিয়ে ফেলেন। তাতে সীমান্ত পারাপারে যা খরচ হয়, তা পুষিয়ে যায়।

নিয়মিত সীমান্ত পারাপার করেন তাঁরাই যাঁদের অন্যপারে আত্মীয়রা আছেন। এঁদের কারও পাসপোর্ট নেই বা করানোর সামর্থ্য নেই। কারণ শুধু পাসপোর্ট করালেই হবে না, প্রকৃত কারণ উল্লেখ করে ভিসা পেতে হবে, যা খরচসাপেক্ষ।আর একদল লোক ঢোকে এ দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে যাবে বলে। মূল সমস্যা তাদের নিয়েই। একেবারে সপরিবার তারা ঢুকে আসে এ দেশে।

অনুপ্রবেশ রুখতে

দুই বাংলার সীমান্তের যা বর্তমান অবস্থা, তাতে অনুপ্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করা আগামী কয়েকদশকে যে সম্ভব নয়, তা মোটামুটি ভাবে স্পষ্ট। খরচ তো আছেই, সেই সঙ্গে রয়েছে সীমান্তের ঘরবাড়ি। কাঁটাতারের বেড়া দিতে গেলে দেখা যাবে এপারে ঘর, ওপারে রান্নাঘর! কারও বাড়ি ভেঙে তার উপর দিয়ে বেড়া দিতে হবে।

আপাতত একটি পন্থা চালু হয়েছে। বছর তিনেক হল বিএসএফ একটি বুলেট ব্যবহার করছে, যেটি গায়ে লাগার পরে তা থেকে রং ছিটকে যাচ্ছে। সেই রং সহজে উঠবে না, যেমন ভোটের কালি। অনুপ্রবেশকারীদের কোনও কারণে বিএসএফ পাকড়াও করতে না পারলেও, পুলিশের পক্ষে তল্লাশি করে তাদের খুঁজে পাওয়া সহজ হচ্ছিল।

 

কিছুদিন এই পদ্ধতিতে কাজ হলেও, পাচারকারী বা অনুপ্রবেশে সাহায্যকারীরা দ্রুত ওই ব্যক্তিদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এলাকা থেকে। রং উঠলে তবেই তারা অন্যত্র যাচ্ছে। তাই তাদের চিহ্নিত করা মুশকিল হচ্ছে। দিনে দিনে বাড়ছে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা। সমস্যা কোথায়

একটি প্রত্যক্ষ ও একটি পরোক্ষ সমস্যা রয়েছে। ধরা যাক সেই কান্দাহারের বিমান ছিনতাইয়ের কথা। এ রাজ্যের বসিরহাট থেকেই ধরা পড়েছিল অন্যতম অভিযুক্ত আব্দুল বেলাল। আল কায়েদার চর বলে অভিযুক্ত মনোতোষ দে ধরা পড়েছিল সীমান্তবর্তী জেলায়। তাই প্রথম সমস্যা হল দেশের নিরাপত্তা। বাংলাদেশ সীমান্ত পার করে মিয়ানমারের নাগরিক ঢোকার ঘটনাও এ রাজ্যে ঘটে চলেছে অন্তত ২০০৮ সাল থেকে। তাই এই ভাবে দেশে রোহিঙ্গারা ঢুকছে না, এমন কথা হলফ করে বলা যাবে না।

আরেকটি হল পরোক্ষ প্রভাব। রোহিঙ্গা বলে চিহ্নিত লোকের সংখ্যা যদি এখন ৪০,০০০ হয়, তা হলে কত রোহিঙ্গা এখন এ দেশে আছে? বলা যাবে না। যদি ১৯৭১ সাল থেকেই মাসে গড়ে ৫০০ জন করে অনুপ্রবেশ করে থাকে, তা হলে প্রায় চল্লিশ বছরে কত লোক শুধু পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে এ দেশে ঢুকেছেন? সরল পাটিগণিতের হাসাবে দু’লক্ষের কাছাকাছি। তার সঙ্গে ২০১১ সালের ওই দেড় লক্ষ যোগ করলে হচ্ছে সাড়ে তিন লক্ষ। এই সাড়ে তিন লক্ষ অনুপ্রবেশকারীর পরিবার বেড়েছে। সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে হিসাব করুন। এরা সকলেই প্রয়োজনে দু-টাকা কিলো চাল পাচ্ছে আমাদের করের টাকা থেকে, প্রয়োজনে বিনা খরচায় চিকিৎসা পাচ্ছে আমাদের করের টাকা থেকে। আমাদের রাজ্যের, দেশের সম্পদে ভাগ বসাচ্ছে।

এখন উপায়

সত্যি কথা বলতে কি, এখন কিছুই করার নেই। তবে কোনও দিন যদি এ রাজ্যে অসমের মতো প্রকৃত ভারতীয় খোঁজা শুরু হয়, তা হলে দেখা যাবে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। আর এ রাজ্যে কাজটি অসমের মতো সহজ নাও হতে পারে।

প্রথমত অসমে ১৯৭৯ সাল থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০৫ সালে সংসদে যে অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলেছিলেন, সংসদে সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এ রাজ্যের ভোটার তালিকায় ঢুকে পড়ছিলেন বাংলাদেশিরা। নাম না করে সংসদে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী।

এ রাজ্যে অসমের মতো পরিস্থিতি হলে ধর্মীর বিষয়টি প্রাধান্য পাবে বলে এখন থেকেই আশঙ্কা করা যায়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment