আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কতটা সম্ভব

এখনও বিজ্ঞানসম্মত কোনও যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি, তবে অন্য উপায় আছে

 |  4-minute read |   06-07-2018
  • Total Shares

ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা পাওয়া কি সম্ভব? ভারতীয় আবহাওয়া  দপ্তরের কাছে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই। তবে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত একাধিক গবেষণা রিপোর্ট কিন্তু বলছে, আংশিক হলেও সম্ভব। তবে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলের উপঅধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, এখনও পর্যন্ত এমন কোনও যন্ত্র বা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি, যা ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারে।

এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন পরিবেশবিদ সুজীব কর।  তাঁর মতে, বেশ কয়েকটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি রয়েছে, যার সাহায্যে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা পাওয়া যেতে পারে। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সেই তর্কে না গিয়ে এটুকু বলা যেতেই পারে, সুজীব করের দাবি যদি আংশিক ও সত্যও হয়, তা হলেও তো  ঝড়-বৃষ্টির মতই  ভূমিকম্পের  আগাম সতর্কবার্তা পাওয়ার সম্ভাবনা আরও জোরালো হয়। 

body2_070618053327.jpgমহারাষ্ট্রের লাতুরে ভূমিকম্পের পরে

সালটা ছিল ১৯৯৩, তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর।  রাতের অন্ধকারে কেঁপে উঠেছিল  মহারাষ্ট্রের লাটুর।  রিখটার স্কেলে কম্পন মাত্রা ছিল ৬.২। সেদিন রাতের অন্ধকারে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছিল একটা গোটা শহর।  কিছু বুঝে ওঠার আগেই, ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে ছিল হাজার হাজার মানুষ।  তখন বৈদ্যুতিন মাধ্যম, সংবাদমাধ্যমের রমরমা আজকের দিনের মতো এতটা ছিল না।  তবে পরের দিন সকালে সমস্ত  সংবাদপত্রের শিরোনাম থাকা সংবাদ, এককথায় বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল  সমস্ত ভারতবাসীকে। 

ভূমিকম্পের ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে সেদিন আঁতকে  উঠেছিল প্রত্যেকেই।  মৃতের সংখ্যা  পৌঁছেছিল দশ হাজারের কাছে। এদেশের মানুষের স্মৃতিতে সেদিনের সেই ভূমিকম্প আজও একটা দগদগে ঘা।  প্রকৃতির কাছে মানুষ যে বড়ই অসহায়।

চোখের নিমেষে ভেঙে পড়া বহুতল।  ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে থাকা অগণিত নিথর দেহ।  যে কোনও বড় ভূমিকম্পের পরের চিত্র এটাই।  যদি ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যেতে পারে, যদি  বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়া যেতে পারে, তবে ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে কেন কোনও পূর্বাভাস পাওয়া যাবে না? বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত একাধিক গবেষণার রিপোর্ট বলছে, ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা পাওয়া যেতেই পারে।

body_070618053307.jpgবিহারের মধুবনীতে ভূমিকম্প (পিটিআই)

কিন্তু কী ভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে জানতে হবে ভূমিকম্প সৃষ্টির কারণ। ভূমিকম্পের কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার জায়গা এটা নয়। তবে ভূমিকম্পের কারণ সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা অন্তত থাকা প্রয়োজন।  ভূপৃষ্ঠের  নীচের অংশে সব সময় তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ (electromagnetic wave) ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ চলাচল করে। বাংলায় একে বলা হয় পরিচলন স্রোত। এই স্রোতের ফলেই ভূ-পৃষ্ঠের নীচে একাধিক তরঙ্গ তৈরি হয়। এর মধ্যে  রয়েছে তির্যকচ্যুত তরঙ্গ ও সংকোচনশীল তরঙ্গ।  এই দুটি তরঙ্গের অক্ষ মাটির নীচে যে জায়গায় মিলিত হয়, সেখান থেকেই তৈরি হয় ভূমিকম্প।  সহজ ভাষায় বলা যায়, এই পরিচলন স্রোতই  হলো পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড, আর এটা কোনও ভাবে বিঘ্নিত হলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প।

সুজীব করের  দাবি, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে মাটির উপরের অংশ  অত্যধিক উত্তপ্ত হয়ে উঠছে যা আগে হত না।  ফলে পৃথিবীর মাটির উপরের তাপমাত্রা ও নিচের তাপমাত্রার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফলে সক্রিয় হয়ে উঠছে পরিচলন স্রোত আর বাড়ছে ভূমিকম্পের প্রবণতা।  তাই গবেষণা রিপোর্ট বলছে, কোনও জায়গায়  দিনের আর রাতের তাপমাত্রা অত্যধিক তারতম্য থেকে সেখানে ভূমিকম্পের আশঙ্কা অনুমান করা যেতেই পারে।   তবে এই পদ্ধতি কতটা বিজ্ঞানসম্মত বা কার্যকরী তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে মতপার্থক্য থাকতেই পারে।

body1_070618053346.jpgনেপারে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরের দিন (রয়টার্স)

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে র‍্যাডন গ্যাসের ভূমিকার কথাও রয়েছে  বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে।  ভূমিকম্পের সময় ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রচুর পরিমাণে রেডন গ্যাস বের হয়ে  বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ার স্তরের মধ্যে প্রবেশ করে।  এর ফলে কমতে থাকে আয়োনোস্ফিয়ারের ঘনত্ব।  বায়ুমণ্ডলে আয়োনোস্ফিয়ার এই তারতম্য অতি সহজেই উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়ে।  অর্থাৎ কোন জায়গার উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়া আয়োনোস্ফিয়ারের তারতম্য থেকে  সেখানে ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পাওয়া  যেতেই পারে— এমনই দাবি সজীব করের।

এ বিষয়ে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের অবস্থান কিন্তু অনেকটাই আলাদা। কলকাতা আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলের উপঅধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা দেওয়ার বিজ্ঞানসম্মত কোনও পদ্ধতি এখনও অজানাই ।  তাঁর মতে, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে  তিনটি বিষয় মাথায় রাখা অত্যন্ত  প্রয়োজন।  প্রথমত, ভূমিকম্পের তারিখ ও সময়, দ্বিতীয় প্রয়োজন হল সঠিক স্থান নির্ধারণ করা, আর তিন নম্বর বিষয়টি হল, রিখটার স্কেলে  ভূমিকম্পের তীব্রতা কত হবে সেটা বলতে পারা।  তাঁর মতে, এই তিনটি বিষয় সঠিক ভাবে  বলা না হলে সেই  পূর্বাভাস অর্থহীন। না মেলার সম্ভবনাই  বেশি। 

আবহাওয়া দপ্তরের থেকে ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস জানানো হয় নিয়মিত। অবশ্যই তা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির উপর ভিত্তি করেই তৈরি।  তা হলে কেন ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস একশো শতাংশ সঠিক হবে না ?   তা হলে কি  আবহাওয়া দপ্তরের পক্ষ থেকে ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস জানানো বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ? নাকি ভুলের কারণগুলো  শোধরাবার চেষ্টা করা, যাতে আরো নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া যায়।   ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই চেষ্টার খুব প্রয়োজন। ভূমিকম্পের পরে তার উৎসস্থল আর রিখটার স্কেলে তীব্রতার মাপ জানানোটাই সব কিছু হতে পারে না। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টায় নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। সুজীব করের মতো অনেকেই গবেষণায় বেশ খানিকটা সাফল্য আসার দাবিও করছেন। তবে যে কোনও গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা ও উদ্যোগ সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন। এখন দেখার, এই অপেক্ষার রজনীর শেষ কবে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000
Comment