উৎপত্তিগত ভাবে সিঙাড়া কি সত্যি সত্যিই বাঙালি স্ন্যাক্স?

সেই নোটিস দেখেই বাঙালি টের পায়, শীত এসে গিয়েছে

 |  6-minute read |   06-09-2018
  • Total Shares

গত বছর আন্তর্জাতিক একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম দেখে চমকে উঠেছিলাম-খাওয়ার কথা ভুলেও মনে আনবেন না, কারণ এই শিঙাড়ার তলায় চাপা পড়ে যাবেন।

প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো শিঙাড়ার মতো দেখতে কোনও পাহাড়ের কথা বলছে। কিন্তু না, ওটা পাহাড় নয় শিঙাড়াই এবং একজন নয়, বেশ কয়েকজন লোক মিলে সেটিকে খেতে হবে। জনা বারো লোক মিলে ওই বিশাল শিঙাড়া তৈরি করেছিলেন। শিঙাড়াটির ওজন দাঁড়িয়েছিল ১৫৩.১ কেজি। আর ওই প্রকাণ্ড এক শিঙাড়া তৈরি করেই খবরের শিরোনামে এসেছিল এশিয়ান স্ন্যাক্স।

body2_090618084245.jpgবিশ্বের সবচেয়ে বড় সিঙাড়া (এএফপি)

১৫৩.১ কেজি ওজনের ওই শিঙাড়া তৈরি  করাটাই এশিয়ান স্ন্যাক্সের বিশ্বরেকর্ড। ওই আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মুসলিম এইড ইউকে চ্যারিটি-র ১২ জন স্বেচ্ছাসেবী ওই বিশাল শিঙাড়া তৈরি করেন। শিঙাড়াটি ভাজা হয় পূর্ব লন্ডন মসজিদের ভ্যাটে। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের কর্মকর্তারা গোটা প্রক্রিয়ার তদারকি করে শিঙাড়াটিকে বিশ্বের বৃহত্তম শিঙাড়া বলে   স্বীকৃতি দেন। তাঁদের থেকেই জানা গেছে, এর আগের বৃহত্তম শিঙাড়াটি বানিয়েছিল ব্র্যাডফোর্ড কলেজের সদস্যরা, ২০১২ সালের জুন মাসে। তার ওজন ছিল ১১০ কেজি।  

শিঙাড়ার মাহাত্ম্য কথা দু-চার শব্দে বন্দনা করা যে যায় না তা শিঙাড়া-ভক্ত মাত্রই জানেন। নিত্য গ্যাস-অ্যাসিডে আক্রান্ত পেট রোগা মানুষটিও শিঙাড়া বললে জোর দিয়ে আপত্তি জানাতে পারেন না। শিঙাড়ার এই যে প্রভাব তা তো শুধু কলকাতাবাসীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কে যেন জোর গলায় বলেছিলেন, ভবানীপুরের দাস সুইটসের শিঙাড়া হরিহর পাড়ায় মিলবে না—ঠিকই। কিন্তু মোমিনপুর, আলিপুর, খিদিরপুর এমনকি বহরমপুরেও তো কত দাস সুইটস আছে, সেখানকার শিঙাড়া যে আবার ভবানীপুরে পাওয়া যায় না!

body1_090618082951.jpgবাঙালির নিজস্ব সিঙাড়া (ছবি -- উপস্থাপনামূলক)

শিঙাড়ার প্রভাব প্রতিপত্তি সুদূর প্রসারিত। ভবানীপুর-মোমিনপুর-আলিপুর-খিদিরপুর-বহরমপুর থেকে শুরু করে সর্বত্র বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে শিঙাড়ার স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ। বাঙালি মনে এতশত প্রভাবপ্রতিপত্তিবিস্তারকারী স্ন্যাক্সটি কিন্তু শুধুমাত্র বাংলা কিম্বা বাঙালির নয়, আদতে ভারতীয় নয় একেবারেই। এ কথায় বাঙালির মন খারাপ হওয়া একেবারেই উচিত নয় বরং স্ন্যাক্সটির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদরে খুশিই হওয়া দরকার। ত্রিকোণা স্ন্যাক্সটি বাংলা এবং বাঙালির উচ্চারণেই কেবল শিঙাড়া। বস্তু একই  কেবল নাম ‘সামোসা’ হয়ে তুমুল জনপ্রিয় ভারতের অন্যত্রও।

শিঙাড়ার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ইরানি ঐতিহাসিক আবল ফজল বেহাকির লেখা ‘তারিখ-এ-বেহাগি’ নামের বইয়ে। সেখানে অবশ্য ‘সাম্বোসা’ নামেই তার সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। জানা যায়, সেগুলি আকারে বেশ ছোট ছোট হত। কারণ, দশম শতকেও মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা স্ন্যাক্স হিসেবে সাম্বোসা নিয়ে ঘুরতেন। ঘোড়া বা উটের পিঠে রাখা তাদের ঝোলায় থাকত সেই খাবার। আমাদের দেশে শিঙাড়ার প্রথম উল্লেখ মেলে আমির খসরুর রচনায়। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বলশালী কিম্বা স্বাস্থ্যবান লোকেরা খেতেন মাংসের পুর-ভরা শিঙাড়া। আমীর খসরুর বর্ণনা থেকে তেমনটাই জানা যায় এবং সেই সময় শিঙাড়া হত ঘিয়ে ভাজা।

পরবর্তী সময়ে মরক্কো থেকে আগত পর্যটক ইবন বতুতার লেখাতেও মেলে শিঙাড়ার উল্লেখ। তবে ইবন বতুতার লেখায় তার নাম ছিল ‘সম্বুসক’। পুর হিসেবে সম্বুসকে মাংসের সঙ্গে থাকত আখরোট, পেস্তা, বাদাম ও নানা ধরনের মশলা। মহম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে সাম্বোসা কিম্বা সম্বুসক খাদ্যদ্রব্যটি পেত রয়্যাল স্ন্যাক্সের মর্যাদা। মোগল শাসনকালেও শিঙাড়ার অস্তিত্ব ছিল সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে।

‘আইন-ই-আকবরি’-তে তার উল্লেখ রয়েছে ‘সানবুসাহ’ নামে। পারস্যের নবম শতকের কবি ইসহাক আল মাহসিল তাঁর কবিতায় শিঙাড়ার গুণগান করেছেন। কবি নিশ্চয় শিঙাড়া খেয়েছিলেন এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবে, তাঁর কবিতায় ‘সামোসা’ নামটাই  পাওয়া যায়। দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকের আরবের রান্নাবান্না নিয়ে যেসব বই পাওয়া যায় সেখানে ‘সনবসাসক’, ‘সনাবাস্ক’ এবং ‘সানবাসাস’ ইত্যাদি নাম মেলে, এই শব্দগুলি ফারসি। নামগুলি যে শিঙাড়া বা সামোসা সম্পর্কিত তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তেমনি সামোসা কথাটি ‘সনবসাসক’ কিম্বা ‘সনাবাস্ক’ অথবা ‘সানবাসাস’ থেকেই যে এসেছে সেটাও বিষদ গবেষণার অবকাশ রাখে না। বরং ভাবা যেতে পারে ওই একই রুটে ইউরোপের দেশগুলিতে প্যাস্ট্রি নামটি ছড়িয়ে পড়েছিল কিনা তা নিয়ে।

শিঙাড়া বা আরব দুনিয়ার ক্রিসেন্ট আকৃতির সানবাসাজ্জ বা সানবাজাজ, আফগানিস্তানে সাম্বোসা, তুর্কি ভাষাভাষি দেশগুলিতে সামসা, আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে স্যাম্বুসা, মোজাম্বিক, পর্তুগাল এমনকি গোয়ায় চেমুকা, পাকিস্তানে সমসা, তাজিকিস্তানে সমবোসা... বাংলা ছাড়া এ দেশের সর্বত্রই সামোসা নামটিই প্রচলিত।

নামের মতোই শিঙাড়ার পুরেও ভিন্নতা রয়েছে দেশ এবং অঞ্চলগুলিতে। আরব দেশগুলিতে শিঙাড়ার পুরে মাংস ছাড়াও থাকে আখরোট, বাদাম, পেস্তা, কাজু, কিশমিশ প্রভৃতি। মোগল আমলের শিঙাড়ার পুরেও মাংস এবং দামি মশলার চল ছিল সে কথা ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকেই জানা যায়। পাকিস্তান, তুরস্ক, আফগানিস্তানের কোনও কোনও অঞ্চলের শিঙাড়ার পুরে এখনো মাংস দেওয়ার চল আছে।

এ দেশের দিল্লি, রাজস্থান, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যের শিঙাড়া বা সামোসায় কোথাও কোথাও আলু, মটর, ছাড়াও পনির এমনকি শুকনো ফলও পুর হিসেবে চলে। পাশাপাশি শিঙাড়ার সঙ্গে পুদিনা, ধনেপাতা, রসুন-কাঁচালঙ্কার চাটনিরও চল রয়েছে। অঞ্চল ভেদে নামই যে কেবলমাত্র ভিন্ন তা নয়, স্বাদও আলাদা কারণ, শিঙাড়ার পুরে ব্যবহৃত মশলাতেও রয়েছে ভিন্নতা।

হায়দরাবাদে শিঙাড়ার নাম লুখমি। এর ময়দার আবরণটি তুলনায় যথেষ্ট মোটা আর লুখমির পুরে থাকে মাংস। দক্ষিণ ভারতের বেশিরভাগ জায়গাতেই বাঁধাকপি, গাজর ও কারি পাতা দিয়ে তৈরি হয় সামোসার পুর।  গুজরাটের সামোসা ছোট্ট ছোট্ট আকারের হয়, ভিতরে থাকে ফ্রেঞ্চ বিনস ও মটরশুঁটি। গোয়ায় নাম সামুকাস। ভেতরে পাওয়া যায় নানা প্রাণীর মাংস। বাংলার শিঙাড়ায় মূলত আলুর পুর থাকে। তবে শীতের সময় ফুলকপি, কড়াইশুঁটিও জায়গা করে নেয় এর ভেতরে।

শিঙাড়া প্রসঙ্গে এসব কথা প্রয়োজনীয় তথ্য মাত্র। আসল কথা শিঙাড়া ছাড়া বাঙালিকে ভাবা যায় না। কারণ শিঙাড়াকে বাদ রাখলে বাঙালি আত্মপরিচয়হীন। তার মানে নীরোদ সি চৌধুরী কিম্বা আরও পিছিয়ে গিয়ে দীনেশ্চন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় অথবা সুকুমার সেন নামিয়ে শিঙারা আর বাঙালির সমাজ-নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক সম্বন্ধ আঁতিপাঁতি খোঁজাখুঁজি নয়।

তবে শিঙাড়া ছাড়া কিন্তু বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, মাইকেলের মেঘনাদ বধ, সত্যজিতের পথের পাঁচালি, রবিশঙ্করের সেতার কোনও কিছুই সম্ভব হত না। আবহমানে এমন কথাও শোনা যায় শিঙাড়া ছাড়া বাঙালি জাতি নাকি সৃষ্টি হত না। তার মানে কৃত্তিবাসের রামায়ণ, রবীন্দ্রনাথের নোবেল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু... এতসব ঘটতই না শিঙাড়া ছাড়া।

এসব কথা যে বা যারা আওড়েছিল তাদের বক্তব্যে যে যথেষ্ট ওজন আর ধার ছিল মানতে হবে। এইসব বাঙালির আবির্ভাব না যদি ঘটত তাহলে বাংলা কিম্বা বাঙালি কথাটাই তো থাকত না। পাড়ার তেলেভাজার দোকানের বেগুনি-ফুলুরির ডাঁই থেকে মিষ্টির দোকানের ঝুড়ি-- বাঙালির একান্ত নিজস্ব স্ন্যাক্স বলতে সেই তেকোনা পুরভরা শিঙাড়া। যুগ যুগ ধরে কত শীত-বর্ষা এল গেল শিঙাড়া কিন্তু বাঙালি জীবনে লেপ্টেই আছে, ঠিক আগের মতো। রাজা রামমোহন, প্রিন্স দ্বারকনাথ, কেশবচন্দ্র সেন, রানি রাসমনির কাল থেকে স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু, চারু মজুমদার সব কালেই শিঙাড়া ছিল বাংলা ও বাঙালির অর্থ-সমাজ-রাজনীতির অমোঘ উপকরণ। শিঙাড়া না থাকলে বাঙালি ঘরের কনে দেখা পর্বটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হত না। শিঙাড়া না থাকলে মাঠে মারা যেত উদীয়মান কবি- লেখকদের কবিতা- গল্প পাঠের আসর।

জাতি হিসেবে কবেই নিজের অস্তিত্ব হারাত বাঙালি, যদি না শিঙাড়া খাওয়ার উত্তরপর্বে অ্যাসিডিটি জানান দিত। শিঙাড়ার সেই অবদানকে ভুলে যাওয়া তো আত্মবিস্মৃতিরই নামান্তর। আর সেই আত্মবিস্মরণের কাজটি বাঙালি এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি। গত তিরিশ বছর ধরে বাংলায় অবাঙালি খাদ্যের আগ্রাসন যে ভাবে ঘটে চলেছে তাতে বাংলা সংস্কৃতিতেই অ-বাংলা আগ্রাসন টের পাচ্ছেন অনেকেই। পাওটাই যুক্তিসঙ্গত তবে বাঙ্গালির ওই খাদ্য আগ্রাসনে শিঙাড়ার মনে হয় না কিছু এসে যাবে।

রোল-চাউ-মোমোর একচেটিয়া আধিপত্যেও তো সে আগের মতোই বিরাজমান। পাতলা খোলের ভিতরে যত্নে কাটা কুচো আলুর পুর, সোনালি করে ভাজা পিরামিডাকৃতি শিঙাড়া আজও দেখি প্রায় সমস্ত মিষ্টির দোকানেই। চাটনি অথবা কোনও অনুপান ছাড়াই সে বিকোচ্ছে। শীতকালে তাতে যুক্ত হচ্ছে ফুলকপির টুকরো। দেকানের রাইরে নোটিস — ‘এখানে ফুলকপির শিঙাড়া ও নতুন গুড়ের সন্দেশ পাওয়া যায়’। সেই নোটিস দেখেই বাঙালি টের পায়, শীত এসে গিয়েছে। অনেকে সেই নোটিস দেখে ঘরে গিয়েই বের করে ফেলছেন লেপ-কাঁথা। ক্রিসমাসের কেকের আগে, দার্জিলিংয়ের কমলালেবুর আগে সেই তো এখনো বাঙালির শীত-সিম্ফনির প্রিলিউড।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TAPAN MALLICK CHOWDHURY TAPAN MALLICK CHOWDHURY

The writer is a journalist.

Comment