হিপ প্রতিস্থাপন মামলা: ভারতের রোগীরা কেন সহজেই প্রতারণার শিকার হয়
বহুজাতিক সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে আইন মানে, ভারতে মানে না
- Total Shares
ক্রেতাদের ঠকিয়ে বড় বড় বহুজাতিক সংস্থার পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছুই নয়। তা সত্ত্বেও, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও সংবাদমাধ্যমকে উপেক্ষা করে এই ধরণের ঘটনা নিয়মিত ঘটলে তা সত্যি সত্যিই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি জনসন অ্যান্ড জনসনের হিপ প্রতিস্থাপন যন্ত্রের মামলাটি আরও একবার প্রমাণ করে যে কর্পোরেট জালিয়াতি রুখতে আমাদের দেশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো ঠিক কতটা ব্যর্থ, প্রশাসনিক দায়িত্ব কতটা দুর্বল এবং বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা নির্লজ্জের মতো ব্যবসায়িক ও চিকিৎসার নৈতিকতা ভুলে যেতে পারে। এই ধরণের ঘটনায় আমাদের দেশের চিকিৎসকদের যে পরোক্ষ সম্মতি রয়েছে এবং ক্রেতা বা রোগীদের মধ্যে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই মামলাটি।
এই মামলায় যে ভাবে রোগীদের অধিকার খর্ব করা হল তাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির উচিৎ অনতিবিলম্বে এমন একটি পরিদর্শন ব্যবস্থা চালু করা যাতে ওষুধ বা চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রস্তুকারক সংস্থাগুলো ভবিষ্যতে এই ধরণের ঘটনার কথা মাথায় রাখে।ভাবতে অবাক লাগে যে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে বিশ্ববাজারে পণ্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পরেও, পরবর্তী দু;'বছর (অর্থাৎ ২০১২ শাল অবধি) জনসন অ্যান্ড জনসন তাদের সেই ত্রুটিপূর্ণ হিপ প্রতিস্থাপন যন্ত্র ভারতে আমদানি করে ভারতের বাজারে তা অবলীলায় বিক্রি করে যাচ্ছিল।
রোগী অধিকার খর্ব করা হচ্ছে [ছবি: রয়টার্স]
নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা কেন্দ্রীয় ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (সিডিএসসিও) সেই সময়ে কোনও পদক্ষেপই করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তরফ থেকে নিয়োগ করা বিশেষজ্ঞ কমিটি জানিয়েছে যে জনসন অ্যান্ড জনসনের ভারতীয় শাখা তাদের যন্ত্র দিয়ে হিপ প্রতিস্থাপন করলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে বিষয়ে তথ্য গোপন করে ভারতের বাজারে তাদের যন্ত্র বিক্রি করে গেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, যে সব । সেই বিশেষজ্ঞ কমিটি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে মত দিলেও, জনসন অ্যান্ড জনসনের তরফ থেকে ৪,৭০০ জন রোগীর তালিকা দেওয়া হয়নি যাদের ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হিপ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। ঠিক কতজন রোগী তাদের যন্ত্র ব্যবহার করে তার হিসেবে সংস্থাটির তরফ থেকে সিডিএসসিওকেও জানানো হয়নি।
বিশেযজ্ঞ কমিটির তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি এতটাই উদাসীন ছিল যে কমিটির সদস্যরা এখন আর ৪,৭০০ রোগীদের মধ্যে ৩,৮০০ জনেরও বেশি রোগীর আর খোঁজই পাচ্ছেন না।
এতো আর শুধুই কর্পোরেট জালিয়াতির মামলা নয়। এই মামলায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে চিকিৎসা সংক্রান্ত নৈতিকতাগুলোকেও কী ভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই মামলায় সরকারি দপ্তরগুলোর দায়িত্ব পালনের দায়বদ্ধতাও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।বর্তমানে প্রচুর রোগী হিপ প্রতিস্থাপন করাচ্ছেন। দেশে হিপ প্রতিস্থাপনের চাহিদা বাড়ার প্রধান কারণ সংবাদমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করে চলেছে যে এই চিকিৎসায় রোগীদের সুস্থতার হার উল্লেখযোগ্য। চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলোও কারণে অকারণে রোগীদের হিপ প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়ে চলেছে (অনেকটা সিজার করে সন্তানের জন্ম দেওয়ায় মতো) এবং যাদের পকেটে পয়সা রয়েছে তারা সাত-পাঁচ চিন্তা না করেই প্রতিস্থাপন করিয়ে নিচ্ছে।
চিকিৎসকরা সবকিছুই জানেন, রোগী আর তাদের পরিবারবর্গ কিছুই জানেন না [ছবি: রয়টার্স]
গবেষণাতেও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাতে যে অনৈতিক ধারার সূচনা হয়েছে তা সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
এই ধরণের অনৈতিক পরিবেশ (যেখানে চিকিৎসকের কাছে সমস্ত তথ্য রয়েছে অথচ রোগী বা তাদের পরিবারবর্গ কিছুই জানে না) চিকিৎসা ব্যবস্থার সর্ব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। আর, এখানেই নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর দায়িত্ব গুরত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণ না থাকলে জালিয়াতি ও অপরাধ বৃদ্ধি পেতে বাধ্য।
নব্বইয়ের দশকে উদার অর্থনীতি সূচনার পর ও ২০০৫ সালে ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ব্যবসা সংক্রান্ত মেধা সম্পদ অধিকার অনুমোদন করে ফেলার পর বহুজাতিক সংস্থাগুলোর চিকিৎসা যন্ত্র ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলেছিল। শিল্পমহলের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের চিকিৎসা যন্ত্রের বাজারের পরিমাণ নয় নয় করে ৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা প্রতিবছর (সিএজিআর) ১৫.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরে এই ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি উদার করা হয়েছে যাতে বিদেশী সংস্থাগুলো বেশি করে বিনিয়োগ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে বিশাল পরিমাণের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ লক্ষ করা গিয়েছে।
চিকিৎসা যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ করতে কোনও রকম সরকারি অনুমতির প্রয়োজন নেই। ব্যবসাপ্রক্রিয়া সরল করার জন্যে লাইসেন্স প্রক্রিয়াও অনেক সরল করে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা যন্ত্র আমদানির ক্ষেত্রেও আমদানি শুল্ক অনেকটাই কম লাগে, কিছু কিছু যন্ত্রের উপর তো আমদানি শুল্ক লাগেই না।
দেশে যে পরিমাণ চিকিৎসা যন্ত্র বিক্রি হয় তার ৮০ শতাংশই আমদানি হওয়া। দেশীয় সংস্থাগুলো মূলত কম দামি পণ্য উৎপাদন করে থাকে।
বহুজাতিক সংস্থাগুলো খুব ভালোভাবেই জানে যে ভারতে তাদের পণ্যের চাহিদা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তারা বছরে প্রচারের জন্যে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে। এই প্রচার খরচের মধ্যে ঘুষের খরচও ধরা থাকে যাতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আধিকারিকদের সহজেই কিনে নেওয়া যায়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে ২০১৫ সালের জাতীয় চিকিৎসা যন্ত্র নীতি নিয়ে সব পক্ষই বেশ উদাসীন।
সবচেয়ে খারাপ বিষয়, এই বহুজাতিক সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ একেবারে আইন মোতাবেক কাজ করে। অথচ ওই সংস্থাগুলো ভারতে আইনের কোনও তোয়াক্কাই করে না। জনসন অ্যান্ড জনসন শেষ পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের রোগীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটা টাকা খরচ করে চলেছে। শুধু জনসন অ্যান্ড জনসনই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে জালিয়াতি মামলায় জড়িয়ে পড়ে আরও কিছু বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাকে মোটা টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই ধরণের অসৎ আচরণের বাড়বাড়ন্তের আরও একটি কারণ রয়েছে। উন্নত দেশেগুলোর মতো চিকিৎসা প্রযুক্তির মূল্যায়ন করার মতো পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে ভারতে।এখন সকলেই জানে যে কিছু টাকাপয়সা বা সুযোগসুবিধার বিনিময় চিকিৎসকরা জোর করে ওষুধ বা চিকিৎসা-যন্ত্র রোগীদের নিতে বাধ্য করে। এর পিছনে অবশ্য কারণ রয়েছে। আইন অনুযায়ী চিকিৎসা যন্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো সরাসরি তাদের পণ্য গ্রাহকদের কাছে প্রচার করতে পারবে না।
আমরা সকলেই জানি যে জনসন অ্যান্ড জনসন মামলাই শেষ মামলা নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাব থাকবে ততদিন অবধি ভারতের রোগী ও তাদের পরিবারবর্গের দুঃখ দুর্দশার শেষ থাকবে না।

