গৌরী লঙ্কেশ হত্যার প্রতিবাদ করেন মুখ্যমন্ত্রী, এ রাজ্যে সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিকার নেই

হঠাৎ একদল পুলিশ মারতে শুরু করল, পুলিশ অফিসার পি কে দাম বলেছিলেন, "মার, শু**র বা*গুলোকে"

 |  4-minute read |   22-05-2018
  • Total Shares

সেদিনটাও আজকের মতো একটা সাধারণ দিন ছিল। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ভাবিনি কলকাতার রাস্তায় পুলিশের কাছে মার খেয়ে ফিরব। রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য কৃষক সংগঠনের ডাকা নবান্ন অভিযান, ঘোষিত কর্মসূচি। মূলত চারটি জায়গা থেকে শুরু হচ্ছে। গন্তব্য নবান্ন। পুলিশ তৎপর, যেমনটি হয় আর কি।

পুলিশি তৎপরতা সেদিন অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমি এসপ্ল্যানেড এলাকায় পৌঁছলাম। ডোরিনা ক্রসিংয়ে চায়ের দোকানে যেখানে আমরা চিত্রসাংবাদিকরা বসে থাকতাম, সেখানে সেদিন প্রায় সবাই হাজির। এখান থেকেও একটা মিছিল নবান্নর দিকে যাবে। নেতারা অনেকে হাজির, কর্মী সমর্থক ও বেশ জোগাড় করেছিল সিপিএম। কলকাতা পুলিশ আগে থেকেই আর আর অ্যাভিনিউ থেকে ইডেনের দিকে যাওয়ার রাস্তায় দুই স্তরের ব্যারিকেড করে রেখেছিল। মিছিল আদৌ হবে কি না সবাই আলোচনা হচ্ছে‌। আচমকা মিছিল শুরু হল উল্টো দিকে। আমরা দৌড়ে সামনের দিকে গেলাম ‌। ধাক্কাধাক্কি করে ছবি করলাম। মিছিল এসপ্ল্যানেড বাসস্ট্যান্ড হয়ে ট্রামলাইন ধরে এগোচ্ছে। কিছু যেতে দেখলাম মেয়ো রোডের মুখে পুলিশ ব্যারিকেড, প্রচুর সংখ্যায় পুলিশ উপস্থিত। বুঝলাম মিছিল এখানে শেষ, আর এগোতে দেবে না। ছবি যা করার এখানে করতে হবে। দৌড়ে পজিশন নিলাম।

body_052218064405.jpg

body1_052218064423.jpgগান্ধী মূর্তির সামনে পরপর সাংবাদিকরা ফুটপাতে কাতরাচ্ছে

উল্টোদিকে আরও অনেকে পজিশন নিয়েছে। গাছের বাঁধানো গোড়ায় বেশ কিছু টিভির ক্যামেরাপার্সন আর কয়েকজন চিত্রসাংবাদিক, ইন্ডিয়া টুডের সুবীর হালদার, টাইমস অফ ইন্রডিয়ার শুভজ্যোতিকে মনে পড়ছে। আর এর মধ্যে মিছিল এসে হাজির। সিপিএম সমর্থকরা দৌড়ে এসে স্টিলের ব্যারিকেডে লাথি মারতে লাগল। এরপর ইট, বাঁশ ছোড়া, ভাঙা টাইলস কিছু ছোড়া বাকি রইল না। পুলিশ ইট, ভাঙ্গা টাইলস পাল্টা ছোড়া শুরু করল। আমি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের পার্থ দা, এপির বিকাশ দা, রয়টার্সের রূপক দা কোনও রকমে নিজেদের বাঁচিয়ে ছবি তুলছি। সিপিএম সমর্থকরা এ বার আরও ক্ষেপে শালের গুঁড়ি নিয়ে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করছে। বালি-পাথর ছুড়ছে। মহিলা পুলিশকর্মীরা ভয়ে ব্যারিকেডের আড়াল নিচ্ছেন। একটা টাইলসের ভাঙা অংশ আমার পিঠে পড়ল। এ বার পুলিশের দিক থেকে কাঁদানে গ্যাসের সেল ছোড়া শুরু। বিক্ষোভকারীরা কিছুটা ছত্রভঙ্গ। ওখানে দাঁড়িয়ে ছবি করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। জায়গাটা কিছুক্ষণের জন্য রণক্ষেত্র। পুলিশের স্পেশাল ফোর্স স্টিলের ব্যারিকেড টপকে এপারে আসতে শুরু করল। এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জ চলছে। বিক্ষোভকারীরা প্রাণ ভয়ে দৌড়াচ্ছে। আমরাও ছড়িয়ে পড়েছি। ডোরিনা ক্রসিং থেকে পার্ক স্ট্রিট ক্রসিংয়ে পুলিশ অভিযান চলছে।

আচমকা পুলিশের দিক থেকে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট আসছে। পুরোটা শুনতে পেলাম না। মনে হল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালাতে পারে। সেফ শেল্টার কোথায়! দূরে একটা ওয়াটার ট্যাঙ্ক, ওটার আড়াল নেব। এপার থেকে দৌড়ে ওপারে যাচ্ছি মাঝ রাস্তা সরাসরি একটা শেল আমার সামনে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল করে, পরে বুঝেছি সেদিন টার্গেট ছিলাম আমারও। নিমেষে আশপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, সারা শরীরে অস্বস্তি, দম আটকে আসছে। আর এগোতে পারলাম না। চেনা বলতে আনন্দবাজারের বিশ্বনাথদাকে দেখলাম, ক্যামেরাটা ধরতে বলেছিলাম। তারপর...

যখন জ্ঞানে ফিরল, আমার মাথাটা জলের কলের নীচে আর ক্যামেরা মাটিতে। সিএনের আরেক সাংবাদিক আমার মুখে ফুঁ দিয়ে আমায় সুস্থ করার চেষ্টা করছে। মাঝে প্রায় দশ মিনিট কেটে গেছে আমার কিছু জানা নেই। আবার উঠে ছবি তুলছি, দেখলাম মাঠের মধ্যে একটা মেয়েকে ঘিরে সাত আট জন পুলিশ পেটাচ্ছে। এনডিটিভির মণিদীপাদি প্রশ্ন করতেই পুলিশ আমাদের উপর রেগে গেল। আমরা না কি বেছে বেছে পুলিশ অভিযানের ছবি তুলছি অনেক পুলিশ আহত সেটা দেখাচ্ছি না। এক কনেস্টবল তো আমার ক্যামেরার ছবি দেখতে চাইলে ওখান থেকে সরে গান্ধী মূর্তির দিকে গেলাম। দেখলাম পরপর সাংবাদিকরা ফুটপাতে কাতরাচ্ছে। ছেলে মেয়ে না দেখে সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ চলছে।

body2_052218064504.jpg

body3_052218064520.jpgকলকাতা পুলিশ মনের মতো করে সাংবাদিক পিটিয়েছে সেদিন

অনুপম, পৃথার আঘাত গুরুতর। শরমিন, দেবযানীদিরা হসপিটালে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইঞ্জিনিয়ারস ক্লাবের সামনে একজন ফোনে নিউজ ব্রিফ করছিল এমন সময় এক কনেস্টবল সেই সাংবাদিককে চড় মারল, পুরোটা রেকর্ডেড। আমরা প্রতিবাদ করতে সে পালিয়ে ক্লাবে ঢুকে পড়ে, আমরা ঢুকতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশ অফিসার মুরলীধর জানান, অভিযুক্ত ক্ষমা চাইবে প্রকাশ্যে। সেটা তো হলই না বরং অভিযুক্তকে পোশাক বদলে পালাতে সাহায্য করল পুলিশ। প্রতিবাদে সাংবাদিকরা পার্ক স্ট্রিট যাওয়ার রাস্তা অবরোধ করল। এবার আরেক পুলিশ অফিসার অপরাজিতা রাই আলোচনার নামে জোর করে ধাক্বিয়ে অবরোধ তুলে দিল। সাংবাদিকরা বিচারের দাবিতে প্রেসক্লাবের দিকে যেতে শুরু করলে পুলিশ আবার বাধা দেয় ‌। বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক সামনে ছিলেন। মুরলীধরের নেতৃত্বে পুলিশ আমাদের ঠেলা শুরু করল। আচমকা পিছন থেকে একদল পুলিশ মারতে শুরু করল। পুলিশ অফিসার পি কে দাম বলেছেন, "মার, শু**র বা*গুলোকে"। পুলিশ চারদিক থেকে ঘিরে, রাস্তায় ফেলে মারল। আমি আর আনন্দবাজারের শৌভিক লাঠিচার্জের ছবি তুলছি। আমায় ঘিরে ফেলেছে ওরা। ক্যামেরা বাঁচাতে হবে, হাত ওপরে তুলে দিলাম। সজোরে পলিমারের লাঠি পড়ল। বাকিরা রাস্তায় কাতরাচ্ছে, হাত, পা, মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। রাস্তায় পুলিশের ভাঙ্গা লাঠি, বুমের উইন্ডসিল্ড, ভাঙ্গা ক্যামেরা, রিস্টওয়াচ এদিক ওদিক পড়ে আছে।

কলকাতা পুলিশ মনের মতো করে সাংবাদিক পিটিয়েছে সেদিন। কলকাতার রাস্তায় পঞ্চাশের অধিক সাংবাদিক মার খেলেন। লালবাজার থেকে ঘটনা "দুঃখ জনক" বলা হল। পরদিন স্বতঃস্ফূর্ত মৌন মিছিল লালবাজার পৌঁছাল। পুলিশ কমিশনার আশ্বস্ত করলেন দোষীদের শাস্তি হবে। কোথায় বিচার ? একটা বছর কেটে গেছে কেউ শাস্তি পায়নি। কেউ আর বিচার আশা করে বলে জানা নেই। এরপরও মূখ্যমন্ত্রী তার গৃহপালিত সাংবাদিকদের নিয়ে গৌড়ি লঙ্কেশ হত্যার বিচারের দাবীতে মিছিল করেন ! রাজ্যে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন !

এটা লজ্জার। এবং দ্বিচারিতা।

(লেখক একজন সাংবাদিক। মতামত নিজস্ব, তাই এব্যাপারে পুলিশের বক্তব্য নেওয়া হয়নি।)

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TANMOY BHADURI TANMOY BHADURI @tanmoy_pj

Independent Photojournalist @TR_Foundation Contributor @pulitzercenter Fellow @TRF_Media Alumni @HuffPost Columnist @childcommission Award Winning Journalist

Comment