রিও ফেস্টিভ্যালের থেকে শারদোৎসব কোনও অংশে কম নয়, বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার দাবিদার
খোলা আকাশের নীচে শিল্পকর্ম দেখানোর এত বড় মঞ্চ আর কোথায় আছে?
- Total Shares
আন্দিজের সেই বিমান দুর্ঘটনার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? ১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর বরফে আবৃত আন্দিজ পর্বতমালার উপর ভেঙে পড়েছিল ছোট একটি বিমান। মোট ৪৫ জন যাত্রী ছিল সেই বিমানে। অবশেষে ৭২ দিন ধরে ওই বরফে ঢাকা পাহাড়ে তীব্র যন্ত্রণার পর বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন সেই বিমানটির মাত্র ১৬ জন যাত্রী। শোনা যায় তাঁরা নাকি খিদের জ্বালায় মৃত সহযাত্রীদের মাংস পর্যন্ত খেয়েছিলেন।
বেঁচে ফেরা যাত্রীদের মধ্যে একজনের নাম গুস্তাভো জার্বিনো। ২০১৭ সালে এই গুস্তাভো জার্বিনো কলকাতায় এসে ছিলেন শহরের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো প্রত্যক্ষ করতে। এখন তিনি তাঁর নিজের দেশ উরুগুয়েতে কলকাতার দুর্গাপুজোর প্রচার করেন। মানে সে দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের দুর্গাপুজোর সময় কলকাতায় আসার জন্য প্রচার করেন।
এর ঠিক এক বছর আগেকার ঘটনা। অর্থাৎ, ২০১৬ সালের ঘটনা। শহরের বিখ্যাত পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে অন্যতম ভবানীপুরের অবসর পুজো কমিটির দুর্গা প্রতিমা (২০১৫ সালের) পাড়ি দিল স্পেনে। মাদ্রিদের বিখ্যাত জায়গা পুয়ের্তা দে তোলেদোতো বেশ কয়েকদিন এই দুর্গা প্রতিমা সাধারণ মানুষদের দেখার জন্য রাখা ছিল। বর্তমানে এই প্রতিমাটি মাদ্রিদের জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।
আরও বছর তিনেক আগের কথা। ২০১৩ সালে কানাডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রেইস হিবার্ট কানাডার সংসদ ভবনে বসে কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে তথ্যচিত্র দেখে যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছিলেন। আর ঠিক তার আগের বছরেই (২০১২ সালে) ফ্রান্সের সরকারি টিভি চ্যানেল - ফ্রান্স টু টিভিতে - কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে আধ ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে।
কলকাতার দুর্গাপুজোতে গুস্তাভো জার্বিনো
অবাক হচ্ছেন তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীবিখ্যাত তথ্যচিত্র পরিচালক থেকে শুরু করে উরুগুয়ের বিশ্বকাপার ফুটবলার, ভ্রমণ লেখক লেখিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের পর্যটন দপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা দুর্গাপুজোর সময়ে কলকাতায় এসেছেন। শহরের শারদোৎসব চেটেপুটে উপভোগ করার পাশাপাশি এই সকল বিদেশি অতিথিরা নিজেদের দেশে ফিরে দুর্গাপুজোর গুণগান করেছেন, যার ফল আমরা এবার পাচ্ছি।
ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, উরুগুয়ে স্পেন, ফ্রান্স ও কানাডার মতো দেশগুলোতে ইতিমধ্যেই দুর্গাপুজো সংক্রান্ত প্যাকেজগুলোকে সরকারিভাবে প্রমোট করা হচ্ছে। এই নভেম্বরে কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রকও তাদের ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার প্রকল্পে দেশের সেরা দশটি উৎসবের মধ্যে দুর্গাপুজোকে স্থান দিয়েছে। ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট খুললেই সেরা দশটি উৎসবের এক নম্বরে রয়েছে কলকাতার দুর্গাপুজোর কথা।
আমার মতে বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে কলকাতাকে তুলে ধরতেই হবে। ঠিকমতো তুলে ধরতে পারলে, মানে প্রচার করতে পারলে, দেশের এমনকি বিশ্বের অনেক জনপ্রিয় উৎসবকে ছাপিয়ে যাবে। আর ঠিক এই চেষ্টাই করা হচ্ছে।
বিদেশি পর্যটকদের কাছে এ দেশের মাত্র তিনটে জায়গা জনপ্রিয় - সোনালি ত্রিভুজ (আগ্রা, দিল্লি ও জয়পুর), কেরল এবং গোয়া। আর, কিছুটা হলেও আন্দামান। এই বাংলায় বিদেশি পর্যটকদের সিংহভাগ আসেন মাদার টেরেসার টানে। সেই ফাঁকে তাঁরা সুন্দরবন বা শৈল শহরে দার্জিলিং ঘুরে নেন। আমার স্থির বিশ্বাস একদিন না একদিন কলকাতার দুর্গাপুজো সমস্ত ভারতীয় উৎসবকে জনপ্রিয়তার দিকে দিয়ে ছাপিয়ে যাবে।
দুর্গাপুজোর টানে কলকাতায় বিদেশিরা
বিশ্ব দরবারে দুর্গাপুজোর জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এক, শিল্পকর্ম দেখানোর এত বড় ওপেন এয়ার খোলা মঞ্চ বিশ্বের আর খুব বেশি উৎসবে হয় না। এ বছরে থেকেই আন্তর্জাতিক জুরি দিয়ে শ্রেষ্ঠ দুর্গাপুজোগুলোকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। পুজো কমিটিগুলোর অনুরোধে যাতে সেরা ক্লাব বাছাই করতে কেউ যেন পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ না করে।
এই সেরা পুজো বাছাই করতে গিয়ে বেহালার একটি পুজো কমিটির থিম দেখে যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছিলেন বিদেশি বিচারকেরা। এ বছর সে পুজোর থিম ছিল আন্দামানের প্রাচীন মানব জাতি জারোয়াদের উপর।
দুই কলকাতার দুর্গোপূজো যত বেশি পুজো ঠিক ততটাই উৎসব। এ শহরের পুজোগুলি সত্যিকারের সর্ব ধর্ম সম্মেলন। জাত পাত ধর্মীয় হানাহানি এমনকি আর্থিক অবস্থার কথা ভুলে সকল ধর্মের মানুষ এই পুজোতে অংশগ্রহণ করে। এই পুজোগুলোর মধ্যে একটি অঞ্চলের প্রতিবেশীদের মধ্যে মিলমিশটাই বেশি চোখে পড়ে। কারণ সকলেই একজোট মানে এককাট্টা হয়ে আয়োজন করি।
আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় বসে আছি যেদিন রিও ফেস্টিভ্যালের মতো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা শারদোৎসবের সময় কলকাতায় আসবেন।
আবার অবাক হচ্ছেন তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সে দিনটি বেশি দূরে নেই।

