কোনও বিপর্যয়ে মোকাবিলা ব্যবস্থাই নেই, মানুষের জীবন খেলা করছে কলকাতা মেট্রো
৪২ জন যাত্রী আহত বা অসুস্থ, গুতর অবস্থায় সাত জন হাসপাতালে
- Total Shares
গত বছর বর্ষাকালের একটি ঘটনা। সেদিন দুপুর থেকে কলকাতায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যে নাগাদ বৃষ্টি কিছুটা ধরলে এক সহকর্মীর সঙ্গে রওনা দিলাম সবচেয়ে বেশি কাছের মেট্রো স্টেশনের উদ্দেশ্যে। সহকর্মীর স্মার্টকার্ড ছিল। তাই তিনি ভূগর্ভে নেমেই রওনা দিলেন সিকিউরিটি গেটের দিকে। আমি গেলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। লম্বা লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
বিড়ম্বনা শুরু মিনিট পনেরোর বাদে। দেখলাম লাইন এক চুলও এগোচ্ছে না। লাইনের সামনে দাঁড়ানো কয়েকজন বাইরে যাওয়ার রাস্তা ধরেছেন। কী হল ব্যাপারটা? কৌতূহল নিবারণের জন্য আমি কাউন্টারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। কাউন্টারে বসা মেট্রো আধিকারিককে জিজ্ঞেস করলাম, "লাইন এগোচ্ছে না কেন? মানে, আপনি টিকিট দিচ্ছেন না কেন?" ভদ্রলোক জবাব দিলেন, "মেট্রো বন্ধ। যতক্ষণ না পর্যন্ত চালু হওয়ার কথা ঘোষণা হচ্ছে ততক্ষন আমি টিকিট দিতে পারব না।"
ভদ্রলোকের কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে আমি উপরে (রাস্তায়) উঠে এলাম বাস ধরব বলে। সহকর্মীকে ফোন করে তাঁর খোঁজ করলাম। কারণ, মেট্রো না চললে তাঁকেও বাস ধরতে হবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার সহকর্মীটি জানালার, "মেট্রো তো চলছে। আমি তো মেট্রো ধরে অনেকখানি এগিয়ে এসেছি।" সেই সময় বেশ কয়েকজন যাত্রীকে দেখতে পেলাম আমার মতোই মেট্রো স্টেশন থেকে নেমে আসছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম কবি সুভাষগামী একটি মেট্রো থেকে তাঁরা এই মুহূর্তে নামলেন।
প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে টিকিট কাউন্টারে বসে থাকা ওই আধিকারিককে 'দেখে নেবো' গোছের মরণপণ সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার। কিন্তু লাইন তখনও একচুলও এগোয়নি। টিকিট কাউন্টারের সামনে লেখা 'কাউন্টার বন্ধ'।
এবার এই অদ্ভুত পরিস্থিতির কারণ খুঁজতে শুরু করলাম। মেট্রো রেখে কর্মরত আমার পরিচিতিদের ফোনে ধরলাম। তাঁরা যে কারণটি জানালেন তাতে আমি হতবাক। দেখলাম মেট্রো কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে তাঁরাও খুশি নন। মেট্রো কর্তৃপক্ষের উপর তাঁরাও যারপরনাই ক্ষিপ্ত।
মেট্রো রেলে বিপর্যয় মোকাবিলার কোনও ব্যবস্থাই প্রত্যক্ষ করা যায়নি [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
ঠিক কী হয়েছিল সেদিন?
অবিরাম বৃষ্টিতে বেশ কয়েকটি ট্রেন বাতিল করতে হয় মেট্রোকে। এদিকে বৃষ্টি বন্ধ হতেই স্টেশন চত্ত্বরে লোকে লোকারণ্য। যারা আগে থেকে আটকে পড়েছিল তারা তো ছিলই, বৃষ্টি বন্ধ হতেই অনেকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হতে মেট্রো স্টেশনগুলোতে উপস্থিত হয়েছেন। এত ভিড় দেখে 'ভয়' পেয়েছে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাদের স্মার্ট কার্ড আছে তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। আর, ভিড় না কম অবধি নতুন করে টোকেন বিক্রি করা চলবে না। আর এই হাস্যকর সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা মেট্রো আধিকারিক জানালেন, "আসলে পরিস্থিতি সামান্য জটিল হয়ে পড়লে কী করতে হবে যে বিষয়ে কোনও দিনও নিজেকে তৈরি করে না মেট্রো কর্তৃপক্ষ। প্ল্যান বি পরিস্থিতি জটিল হলে তবেই ঠিক করতে হয়। আর মেট্রো কতৃপক্ষের প্ল্যান বি একটাই - এক হয় পুরোপুরি না হয় আংশিক পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হোক।"
সেদিন থেকেই ভাবছিলাম যে একদিন বড় ধরণের অঘটন ঘটে গেলে মেট্রো কর্তৃপক্ষ বা আধিকারিকরা কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে।
বৃস্পতিবার বিকেলে দেখা গেল মোকাবিলা করার কোনও ক্ষমতায় নেই মেট্রো কর্তৃপক্ষের। অঘটন ঘটলে মেট্রো কর্তৃপক্ষের ঠুঁটো হাত জগন্নাথ।
কী হয়েছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলায়?
বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টে ৫৬ মিনিট নাগাদ দমদমগামী একটি এসি মেট্রো রবীন্দ্রসদন স্টেশন ছেড়ে ময়দানের দিকে রওনা দেয়। প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে সুড়ঙ্গে ঢোকামাত্রই ট্রেনটির প্রথম এবং দ্বিতীয় কামরার তলা থেকে বীভৎস আওয়াজ আসতে থাকে। সেই শব্দ কিসের তা বোঝার আগেই যাত্রীদের নজরে আসে, কামরার দু’দিকের তলা থেকে লাল আগুনের শিখা বেরোচ্ছে।তার মধ্যে দিয়েই ছুটে চলে মেট্রো। মুহূর্তের মধ্যেই ওই দুই কামরা ধোঁয়ায় ভরে যায়।
ভরা অফিস টাইম। অফিস যাত্রীদের ভিড়ে সেই মেট্রোর রেকগুলোতে দাঁড়ানোই দায়। ওই অবস্থাতেই সুড়ঙ্গের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে মেট্রো। আলো নিভে যায়। প্রত্যেকটা কামরায় টিম টিম করে জ্বলতে থাকে ইমারজেন্সি লাইট। প্রথম দু’টি কামরার বাইরে দেখা যাচ্ছে আগুনের শিখা। সকলে তত ক্ষণে চালকের কেবিনের দিকে এগোতে শুরু করেন। ভিড়ের আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যাত্রীরা হুড়োহুড়ি শুরু করে দেন। অনেক যাত্রীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
খবরের প্রকাশ, এই পরিস্থিতিতে কয়েক জন যাত্রী মিলে মেট্রোর সামনের দিকের কামরার জানলার কাচ ভাঙার চেষ্টা করেন। কোথাও কিছু না পেয়ে তাঁরা লাথি মেরে জানলার কাচ ভাঙেন। ভাঙা জানলা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়েন কয়েক জন যাত্রী। এর পর, তাঁরাই ওই জানলা দিয়ে কয়েক জনকে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে গোটা মেট্রোয় বহু যাত্রী অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। সকলেই বাইরে বেরনোর জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু, ভিড়ে ঠাসা মেট্রো থেকে বেরনোর কোনও উপায় তাঁরা পাননি।
ঘটনার খবর পেয়ে শেক্সপিয়র সরণি এবং পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ কর্মীরা ময়দান স্টেশনে পৌঁছন। দমকলের তিনটি ইঞ্জিনও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। শেষে সন্ধ্যা ৫টা ২২ মিনিট অর্থাৎ প্রায় ২৬ মিনিট পর যাত্রীদের চালকের কেবিনের দিক দিয়ে সুড়ঙ্গপথে প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা হয়।
দুর্ঘটনা ঘটটেই পারে। দুর্ঘটনা থেকে সকল যাত্রীদের উদ্ধার করতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ২৬ মিনিট কেন তার চাইতে ঢের বেশি সময়ে লাগতে পারে। কিন্তু এই ২৬ মিনিট, মানে দুর্ঘটনা ঘটে আর উদ্ধারকার্য শেষ হওয়ার আগের মুহূর্ত অবধি, মেট্রো কর্তৃপক্ষ কী করছিলেন।
যাত্রীদের প্রথম অভিযোগ, হেল্পলাইনে বহুবার ফোন করার চেষ্টা করা হলেও কেউই তা তোলেনি। মারাত্মক অভিযোগ। এর কারণ দর্শাতে হবে মেট্রো রেলকে। কিন্তু মেট্রো কতৃপক্ষ এ বিষয় কতটা মুখ খুলবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
অভিযোগ দুই, উদ্ধার হওয়ার পরে মেট্রো কতৃপক্ষের তরফ থেকে কোনও ফার্স্ট এড বা স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করা হয়নি। নিদেনপক্ষে, কোনও মেট্রো আধিকারিক যাত্রীদের উদ্দেশ্যে এক বোতল জলও এগিয়ে দেননি। যে কোনও বিপর্যয়ে মোকাবিলার প্রাথমিক পাঠের মধ্যে পড়ে এই ছোটখাট বিষয়গুলো। তার মানে, মেট্রো কতৃপক্ষ কি তাদের স্টেশনে কাজ করা আধিকারিকদের এই প্রাথমিক পাঠটুকুও দিতে পারে না? নাকি, দিলেও আধিকারিকরা সেই পাঠ ভুলতে বসেছে।
এ সবের পরেও সংবাদমাধ্যমকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। মেট্রো রেলের মুখ্য জন সংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘রবীন্দ্রসদন ও ময়দান স্টেশনের মধ্যে মেট্রোয় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন আমাদের কর্মীরা। যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েকজন সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তবে, এখন এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কী কীরণে আগুন লেগেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
৪২ জন যাত্রী হাসপাতালে গিয়েছিলেন, সাতজনকে ভর্তি করা হয়েছে [ছবি: এএফপি]
মুখ্য জনসংসযোগ আধিকারিকের 'কয়েকজন' যাত্রী 'সামান্য' অসুস্থ হয়ে পড়ার নমুনাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যেবেলা জানিয়েছেন যে মোট ৮২জন যাত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। এদের মধ্যে সাত জন অবস্থা ভালো ছিল না বলে তাঁদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জনসংযোগ। আর, সেখানেও ব্যর্থ মেট্রো কর্তৃপক্ষ।
কলকাতা মেট্রো খানিকটা অংশ মাটির উপর দিয়ে এলেভেটেড করিডোরের উপর চলে। আর কিছুটা অংশ ভূগর্ভ দিয়ে। অর্থাৎ সারফেসের সঙ্গে এই মেট্রোর যোগ খুব সামান্যই। এই পরিস্থিতি বিচার করলে মেট্রো কর্তৃপক্ষের বিপর্যয়ে মোকাবিলার উপর আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত। কিন্তু তা আর হচ্ছে কৈ?
ঘটনার পরে রাজ্যের দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু জানিয়েছেন, "মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে ছেলেখেলা করা চলবে না।"
কিন্তু কলকাতা মেট্রো যে ভাবে চলছে তা তো ঠিক 'ছেলেখেলা' নয়। মানুষের জীবন নিয়ে খেলা।

