কলকাতার বাতাস এখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত, একটি তুলনা
১৩৬৬ বঙ্গাব্দের চৌঠা অঘ্রান ছিল কলকাতার ইতিহাসে বিশেষ দিন...
- Total Shares
বন্যপ্রাণী দেখতে নয়, শুধুমাত্র বন দেখতে কখনও বনে গিয়েছেন? গাছের ফাঁক দিয়ে যখন রোদ এসে পড়ে, তখন বোঝা যায় বনাঞ্চল কতটা মুক্ত। মুক্ত, মানে দূষণমুক্ত।
সূর্যের আলো যখন পাতার ফাঁক দিয়ে মাটিতে এসে পড়ে, তখন সেই আলোকস্তম্ভগুলোতে যে টুকু ধুলো উড়তে দেখা যায়, সে আপনার ওই গাড়ি থেকে ওড়া ধুলো। সেখানে বুক ভরে দম নেওয়া যায়।
ছেলেবেলায় গ্রামে থেকেছি। মফস্বল হাওড়া শহরের সঙ্গে পার্থক্যটা বুঝতে পারতাম। এখানে ছ’টা ঋতু আলাদা ভাবে বোঝা যেত। হেমন্তকালে হিম পড়ত, শরৎ আর শীতের মাঝের পার্থক্য বেশ বোঝা যেত। আজকাল কতটা বোঝা যায়, সন্দেহ আছে।
বাতাসে বিষ, তাই কলকাতায় আর হাওয়া খাওয়া যায় না (মূল ছবি: রয়টার্স)
কলেজে ভর্তি হওয়ার সূত্রে কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু। বিকেলের দিতে কলকাতায় চোখ জ্বালা করত। দূষণের জন্য যে চোখ জ্বালা করে, সে কথা কোনও একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম, কিন্তু সেই অনুভূতি প্রথম হল কলকাতায়। আরেকটা ব্যাপারও অনুভব করা যায়, তাপমাত্রায় বদল।
ধর্মতলা থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি বড়জোর ৫০-৫৫ কিলোমিটার। তবে ঠান্ডাটা এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যায়। গ্রামের ঠান্ডা ছিল একেবারে হাড়কাঁপানো। প্রতি বছর জগদ্ধাত্রীপুজোর সময় পশমের পোশাক নিয়ে যেতে হত, অথচ শহরে ঠান্ডা নেই।
সম্প্রতি দূষণে কলকাতা যে দিল্লিতে ছাড়িয়ে গেছে, তা রাতারাতি যে ঘটেনি, এই সব ঘটনা থেকেই সেটা বোঝা যায়।
আমার এক পিসেমশাইয়ের কাছে (বেঁচে থাকলে বয়স হত ৯০-এর বেশি) শুনেছি যখন তিনি কলকাতায় এসেছিলেন তখন পাঁচ-সাত মিনিট অন্তর একটা করে মোটরগাড়ি যেতে দেখে অবাক হয়েছিলেন। আর এখন? ট্রাফিক আইন মেনে ধর্মতলায় রাস্তা পার হতে গেলে পাক্কা ২৮ মিনিট সময় লেগে যাবে। গাড়ির সংখ্যা ভীষণ ভাবে বেড়েই চলেছে কলকাতা শহরে। লোক বাড়ার থেকে বেশি হারে।
শহরের সৌন্দর্যায়নের জন্য যে সব গাছ লাগানো হয়েছে, সেই সব গাছের নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়, তবে একটু উঁচুতে থাকা কোনও পাতা পেড়ে নিলে দেখা যাবে তার উপরে কী বিপুল পরিমাণে ধুলো জমেছে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়লার উনুন জ্বালানো নিষেধ হলও খিদিরপুরের দিকে একটু এগলেই দেখা যাবে রাস্তার ধারে উনুন জ্বলছে, ফুটপাথে রান্না চলছে। সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই সূর্য মিলিয়ে যায় ধুলোয়, অস্তরাগ যে কী তা শরৎকালে কদাচিৎ দেখা যায়। আকাশ আর আজকাল লাল হতে দেখাই যায় না। তার কারণও সেই ধুলো, ধোঁয়া।
কলকাতায় আগে অবশ্য হাওয়া খাওয়া যেত, অন্তত ১৯৫৮ সালেও। পরেশচন্দ্র দত্ত ট্যাক্সিতে উঠে সর্দারজিকে তো তাই-ই বলেছিলেন। পরশপাথর ছবি তৈরির সময়েও কলকাতায় হাওয়া খাওয়া যেত। এখন আর যায় কি?
পরশপাথর ছবিতে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন পরেশচন্দ্র দত্তের ভূমিকায় তুলসী চক্রবর্তী (স্ক্রিনগ্র্যাব)
একেবারে যায় না এ কথা ঠিক নয়। বাবুঘাট যতই ধুলোয় ঢেকে থাকুক না কেন, মিলেনিয়াম পার্কের পরিবেশ অনেকটাই অন্যরকম। তবুও সে জায়গাও তো কলকাতার বাইরে নয় যে প্রাণ ভরে মুক্ত বাতাস নেওয়া যাবে। মুক্ত বাতাস নেই বলেই ট্যাক্সিতে হাওয়া খেতে খেতে ঘোরা যায় না। লালবাতিতে গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। তাই এখন কলকাতা দেশের সবচেয়ে ধূলিধুসরিত মহানগর।
সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট অনুযায়, বিটি রোডের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল—শহরের এই দুই জায়গাতেই দূষণের মাত্রা দিল্লির সবচেয়ে দূষিত এলাকাকে ছাড়িয়ে গেছে।
বায়ু দূষণের প্রধান সূচকগুলি হল ভূমিতে ওজোনগ্যাসের মাত্রা, বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা, বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা। এগুলির মধ্যে কোনও একটির মাত্রা বেড়ে যাওয়াই স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ। এগুলির মধ্যে আবার সবচেয়ে খারাপ হল বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন কণা ও ভূমি-লাগোয়া জায়গায় ওজোন গ্যাসের মাত্রা।
শুধু বাতাস নয়, জলও দূষিত (ছবি: রয়টার্স)
১৫ নভেম্বর বিশ্বভারতীতে বায়ু দূষণের মাত্রা বা এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স (ওকিউআই) ছিল ৩৮১ (অত্যন্ত খারাপ) এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে ছিল ৩১০.৭৫ (অত্যন্ত খারাপ) – দিল্লির সবচেয়ে দূষিত অশোক বিহারে এই সূচক ছিল ২৯২.২৫। এই সূচক ০-৫০ এর মধ্যে থাকলে সবচেয়ে ভালো, ৫১-১০০ পর্যন্ত হল সহনশীল। ১০১ থেকে ২০০ পর্যন্ত যাঁরা পুরো সুস্থ নন তাঁদের পক্ষে সমস্যার। ১৫১ থেকে ২০০ হল অস্বাস্থ্যকর। এই মাত্রার ব্যাখ্যায় বোধহয় আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কলকাতা শহরের বাতাসের অবস্থা কী, তা এটুকুতেই বোঝা যায়।
বাংলার ১৩৬৬ সালের চৌঠা অঘ্রানের কথা আবার মনে পড়ে গেল। (এখন বাংলার ১৪২৫ সাল)। পরেশচন্দ্র দত্তর সহকারী প্রিয়তোষ যখন পরশপাথর হজম করে ফেললেন... কলকাতার ইতাহাসে বিশেষ দিন... সোনা লোহা হয়ে গেল। কলকাতার বাতাসেরও সেই অবস্থা। পরশপাথর হজম করে ফেলেছি... বাতাসে এখন শুধুই বিষ।

