মানস জাতীয় উদ্যান: চোরাশিকারী আটকাতে স্থানীয়দের সচেতন ও পর্যটন বাড়াতে হবে

সম্ভবত তৃণমূল স্তরের বনকর্মীরা চোরাশিকারী ও চোরাকারবারিদের সঙ্গে যুক্ত

 |  4-minute read |   26-11-2018
  • Total Shares

সকাল দশটা হবে। একদল লোক গভীর জঙ্গলে হেঁটে চলেছে। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যাবে যে এরা সকলেই স্থানীয় বাসিন্দা। এঁদের হাতে কয়েকটি বিদ্যুৎ চালিত করাত আর একটি ছোট হ্যান্ড জেনারেটর। যে এলাকাটির কথা বলছি তার চার দিকে ১০ কিলোমিটার ঘিরে যদি একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি করা হয় তা হলে দেখবেন এই বর্গক্ষেত্রটির মধ্যে কোনও লোকালয় নেই, এলাকাটি এতটাই প্রত্যন্ত। তাহলে, কী উদেশ্যে এদের এত গভীর জঙ্গলে প্রবেশ?

আসলে এরা গাছের গুঁড়ির চোরাকারবারি। গাছের গুঁড়ি চুরি করে পাচার করাটাই এদের মূল উদ্দেশ্য। গভীর অরণ্যে প্রশাসনকে একেবারে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ চালিত করাত দিয়ে এরা দিনের পর দিন গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করে দিচ্ছে। পুরোটাই দিনের আলোয়। এরপর রাতের অন্ধকারে মোষের গাড়িতে তুলে এই সব গাছের গুঁড়ি নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী সঙ্কোশ নদীর তীরে। নদীতে এই গাছের গুঁড়ি ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

নদীর স্রোতে এই গাছের গুঁড়ি কাকভোরে পৌঁছে যায় বক্সা জাতীয় উদ্যানে। এই অঞ্চলে দু'টি আছে গ্রাম বারোবিশা ও কুমারগ্রাম। নদীর ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য এই গুঁড়িগুলো স্রোতে ভেসে এসে এই দুটি গ্রামের লাগোয়া নদীর তীরে এসে ভেড়ে। সেখান থেকে সেই গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা এই গুঁড়িগুলোকে লরিতে তুলে দেয়। সড়ক পথে এবার সেই গুঁড়িগুলো পাচার হয় শিলিগুড়ি, কলকাতা ও পাটনায়।

body_112618014543.jpgজঙ্গলে চোরাশিকারীদের কেটে যাওয়া গাছের গুঁড়ি

বুঝতেই পারছেন এই পাচারের পিছনে একটি নেটওয়ার্ক কাজ করছে, যারা মানুষের সাহায্য ছাড়াই শুধুমাত্র নদীর স্রোতের উপর ভর করে পাচার সামগ্রী এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। পাঠাবার সময়ে নিজেদের মধ্যে বার্তা আদানপ্রদানও করে নিচ্ছে। বার্তার কিছু অংশে অবশ্য সাঙ্কেতিক ভাষায় আদানপ্রদান করা হয়।

২০১৭ সালের মে মাস থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস অবধি আমি কর্মসূত্রে মানস জাতীয় উদ্যানে কাটিয়েছে। আইইউসিএনের তত্ত্বাবধানে আরণ্যক নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে চোরাকারবারিদের নিয়ে কাজ করতাম। আমার কাজটা ছিল অনেকটা গোয়েন্দাদের মতো। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে, তাদের বন্ধু হয়ে তাদের কাছ থেকে চোরাকারবারি ও চোরাশিকারীদের সম্পর্কে খবর বের করতাম। তার পর সেই খবর দিতে হত এসএসবি, সিআরপিএফ, অসম রাইফেলস ও বনদফতরের আধিকারিকদের।

মানস জঙ্গলে বিভিন্ন প্রান্তে এই সব আধা সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি এঁদের দায়িত্ব ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের অমূল্য সম্পত্তি রক্ষা করা।

শুধুমাত্র গোয়েন্দাগিরি নয়, আমার আরও একটি কাজ ছিল -- এই চোরাশিকারের সমস্যা কী ভাবে সমস্যা করা যাবে তার সম্ভাব্য সমাধানগুলো খুঁজে বের করা।

body1_112618014646.jpgজঙ্গলে টহলরত আধাসামরিক বাহিনী

মানস জাতীয় উদ্যানের পশ্চিম দিকটা, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বারোবিশা থেকে অসমের শ্রীরামপুর হয়ে একদম বরপেটা অবধি বিস্তৃত অঞ্চলটি ছিল আমার কর্মক্ষেত্র। এই পুরো এলাকাটা অসমের কোকরাঝাড় আর চিরাং জেলার অন্তর্গত। পুরো এলাকাটাই বরোল্যান্ডের অধীনে।

শুধু গাছের গুঁড়ি নয়, এই অঞ্চলে বিশাল ধনেশ (গ্রেট হর্নবিল), ভোঁদড় ও সোনালি লেঙ্গুরও চোরাশিকারিদের হাত থেকে সুরক্ষিত নয়। এই তিনটে প্রজাতির প্রাণীকেই পোষ্য হিসেবে বিক্রি করা হবে বলে ধরা হয়। তবে কয়েকটি দেশে ওষুধ তৈরির জন্য ভোঁদড়ের চামড়া এবং ধনেশের মাথার হাড়জাতীয় বস্তু বা শিং বিক্রি হয়ে থাকে।

এ জঙ্গল বিভিন্ন ধরণের প্রজাপতির স্বাভাবিক বাসস্থান, স্বভাবতই প্রজাপতিও মারা হয়। এই প্রজাপতিগুলোর স্টাফড তৈরি করা হয় যা বিভিন্ন সাজিয়ে রাখার সরঞ্জাম কিংবা গিফট আইটেমে ব্যবহৃত হয়। মেঘালয়ে গেলে বুঝতে পারবেন ঘর সাজানো জিনিসের মধ্যে এই স্টাফড প্রজাপতি কী ভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বছরের পর বছর ধরে এই অরণ্যে চোরাশিকারের সমস্যা রয়ে গিয়েছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? দুটি উপায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এক, স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করে তোলা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়েই এই চোরাশিকারগুলো করানো হয়ে থাকে। এঁরা অত্যন্ত গরিব। সামান্য কয়েকটি পয়সার লোভে তারা এই চোরাকারবারে তাঁরা রাজি হয়ে যান।

body2_112618014723.jpgলেখকের কর্মভূমি এই এলাকাতেই বিস্তৃত ছিল

দুই, এঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এর সবচেয়ে সহজ উপায় এই লোকালয়গুলোর আশেপাশের জঙ্গল এলাকাগুলোতে পর্যটন শিল্প তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্পে এঁদের কর্মসংস্থান করা যেতে পারে। পর্যটকদের গাইড করে দেওয়া যেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের যাঁরা জঙ্গলটা সবার চেয়ে ভালো চেনেন। আবার রান্না বা থাকার জায়গায় (হোটেল বা হোমস্টে) হাউস কিপিং বিভাগে এঁদের নিয়োগ করা যেতে পারে। পর্যটকরা যদি গাড়ি করে জঙ্গল ঘুরতে চান তাহলে স্থানীয়দের সেই গাড়িগুলোতে চালক হিসেবে নিয়োগ করা যেতে পারে।

ভারতের অনেক অভয়ারণ্যেই এই ব্যবস্থা আছে। তবে পর্যটন শিল্প বিকাশ করতে হলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে বনাঞ্চল যেন কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এর প্রভাব যেন বন্যপ্রাণীদের উপর না পড়ে।

এ ছাড়া সতর্ক থাকতে রাজ্যের বনদফতরের অফিসগুলোকে। এখানে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে বনদফতরের একশ্রেণীর তৃণমূল স্তরের কর্মী (রেঞ্জার অবধি) এই চোরাকারবারি ও চোরাশিকারীদের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের কাছে সব খবর থাকে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে তাঁরা অধিকাংশ সময়েই হাত গুটিয়ে বসে থাকেন।

আমি এখন জঙ্গল থেকে অনেক দূরে কংক্রিটের জঙ্গল কলকাতায় বসে আছি। কিন্তু আমার মন পড়ে রয়েছে সেই জঙ্গলেই। বসে বসে ভাবছি এই চোরাশিকারী ও চোরাকারবারিদের ঠেকাতে না পারলে ভারতের প্রতিটি জঙ্গলই কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে উঠবে একদিন।

আমরা কি এই পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার কোনও চেষ্টাই করব না?

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

RATHIDRA NATH DAS RATHIDRA NATH DAS

The writer is a conservationist.

Comment