চন্দননগরের মণ্ডলবাড়িতে দেবীপক্ষে আসে শুভাশুভ আত্মা

এখানে নবপত্রিকা দুর্গা নন, সত্যিই গণেশের বউ

 |  4-minute read |   18-10-2018
  • Total Shares

ঋষি জরৎকারু কেন শেষ পর্যন্ত মত বদলে বিবাহ করেছিলেন সে কথা অনেকেই জানেন, বিবাহ না করলে সন্তানের জন্ম হবে না আর সন্তান না হলে পিতৃপুরুষরা জল পাবেন না। হিন্দু ধর্মমতে মহালয়ার দিন শেষ হয় পিতৃপক্ষ, পুর্বপুরুষরা মর্তে আসেন উত্তরপুরুষদের হাত থেকে জল গ্রহণ করতে। তাই তাঁদের উদ্দেশে তর্পণ করা বিধেয়।

পিতৃপক্ষে উত্তরপুরুষের জল পেয়ে মর্ত্যলোক থেকে আবার নিজলোকে ফিরে যায় পিতৃপুরুষের সেই সব বিদেহী আত্মা। আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে ওঠে আলোকমঞ্জির। শুরু হয় দেবীপক্ষ, ষষ্ঠীতে বেলতলায় হয় দেবীর বোধন।

candan-embed1_101818023932.jpgএখানে দেবী দুর্গার বোধন হয় প্রতিপদে (নিজস্ব চিত্র)

চন্দননগরের মণ্ডলবাড়িতে অবশ্য বোধন হয় প্রতিপদে। তখন থেকেই প্রতিদিন দেবীর পুজো হয়, রোজ হয় সন্ধ্যারতি। সকালে ভোগ, রাতে শীতল। বাড়ির নিয়ম তেমনই। তবে ব্যতিক্রম শুধুমাত্র পুজো শুরুর তিথিতে নয়, মণ্ডলবাড়ির পুজোয় এমন অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যা বিরল। এমন রীতি আমার অন্তত জানা ছিল না।

চন্দননগরের ফরাসি উপনিবেশ নিয়ে ছোট একটি কাজ করার সময় স্থানীয় ইতিহাসবিদ অজিত মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে আলাপ হয় নেলিন মণ্ডলের সঙ্গে, মণ্ডলবাড়ির গৃহবধূ। আদপে তিনি ফরাসি, তবে পাসপোর্ট বেলজিয়ামের। বিবাহসূত্রে এই বাড়িতে আগমন এবং তারপরে এমন দুর্গাপুজো দেখে কৌতূহল শুরু। এই পুজোর অনন্য বৈশিষ্ট্য দেখে তা নিয়ে খোঁজখবর-পড়াশোনা শুরু করে দেন। কর্মসূত্রে পৃথিবীর বড় অংশে ঘুরে বেড়ানো নেলিন দেখতে পান এই পুজো শুধুমাত্র দেশীয় রীতিতে হয় এমন নয়, এর পরতে পরতে মিশে রয়েছে বহু বিদেশি রীতিও। এই বাড়ির পুজোয় তখন তিনি আমন্ত্রণও জানিয়ে রেখেছিলেন।

chandan_embed4_101818024053.jpgপুজোয় অনেক রীতিই অনন্য (নিজস্ব চিত্র)

নেলিন জানালেন এই পুজো নিয়ে নানা কথা। বাড়ির ইতিহাস জানতে তিনি ফ্রান্সের মহাফেজখানায় পর্যন্ত গিয়েছেন, তাতে এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাকালও জেনেছেন।

১৭৪১ সালে তৈরি হয় মণ্ডলবাড়ি। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই আঙিনা, সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দালান, তা পেরিয়ে ঠাকুরদালান। এখানেই দেবীপক্ষে টানা দশ দিন পুজিতা হন দেবী দুর্গা, পুজো শুরু হয় প্রতিপদ থেকে। নেলিনের কথায়, “পুজো আগেও হত, তবে এই ভাবে প্রতিমা পুজো শুরু হয় ১৮২৫ সালে। তার আগে হত ঘটপুজো। সেই হিসাবে এই পুজো ১৯৩ বছরের পুরোনো। এই পুজো মোটেই ৩০০ বছরের পুরোনো নয়।” তিনি জানালেন এই রাজ্যে সবমিলিয়ে দশটি বাড়িতেও প্রতিপদে পুজো শুরু হয় না। এক সময় এই বাড়ির পুজোয় এক হাজার পুরোহিত আসতেন। পুজোর ব্যাপ্তিও ছিল ব্যাপক। সময়ের সঙ্গে সেই জৌলুস কমেছে। সময় বোঝানের জন্য একটি তথ্য দিয়ে রাখা দরকার: ১৭৩০ সালে চন্দননগরের গভর্নর নিযুক্ত হন যোশেফ ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে।

chandan_embed2_101818024148.jpgমণ্ডলবাড়ির পুজোয় ছাদ থেকে দড়িতে করে ফল ঝোলানো থাকে (নিজস্ব চিত্র)

মণ্ডলবাড়িতে ঢোকার মুখে জানলার দিকে তাকালে চোখে পড়বে দাড়িওয়ালা মুখ – বাড়িটিতে ইউরোপের একাধিক দেশের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য নজর কাড়ে। জৌলুস ও ঔজ্জ্বল্য হারালেও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে এই বাড়ির। স্বাতন্ত্র্য রয়েছে পুজোরও।

মূল আঙিনায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালে দেখা যাবে দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নানা ধরনের ফল, ফলের থোকা। এমন রীতি আগে কখনও দেখিনি। এমন কেন? নেলিন মণ্ডল শোনালেন এই রীতির নেপথ্যকথা:

এই পুজোর কয়েকটি সঙ্গে মিল রয়েছে মধ্য এশিয়ার নানা অঞ্চলের, এমনকি আবিসিনিয়া (সাবেক ইথিয়োপিয়া সাম্রাজ্য) এবং অধুনা আফগানিস্তানের প্রাচীন কয়েকটি রীতির। তারই মধ্যে একটি হল এই ফল ঝুলিয়ে রাখা। এই সময় অনেক আত্মা মর্ত্যে নামে, অশুভ আত্মাকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, তাই আগেই খাবার দিয়ে দেওয়া হয়। যদি দড়ি থেকে কোনও ফল পড়ে যায় তা হলে ধরে নেওয়া হয়, আত্মা সেই ফল গ্রহণ করেছে, ফল বেঁধে নতুন করে সেই জায়গায় তা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আর শুভ আত্মার জন্য তো নানাবিধ ভোগের আয়োজন করা হয়েই থাকে। সব আত্মাকে ফেরালে চলবে কেন!

chandan_embed5_101818024239.jpgবাড়ির পুজোয় নেলিন মণ্ডল (নিজস্ব চিত্র)

মহাসপ্তমীর পুজোর সময় এই বাড়িতে জ্বলে হোমাগ্নি, তা নির্বাপিত হয় মহানবমীতে, এটাই রীতি।

সাধারণ ভাবে নবপত্রিকা, মানে যাকে কলাবউ বলা হয়, তিনি হলেন দেবী দুর্গা। তবে এই বাড়িতে নবপত্রিকাকে যে নিয়মে পুজো করা হয়, তাতে তিনি দেবী দুর্গা নন, তিনি গণেশের স্ত্রী, মানে দেবী দুর্গার পুত্রবধূ। এটিও এই বাড়ির পুজোর আরেক বৈশিষ্ট্য।

chandan_embed3_101818024328.jpgসন্ধ্যারতি শুরু হয়ে যায় প্রতিপদ থেকেই (নিজস্ব চিত্র)

গৃদেবতাদের এই সময়ে দোতলার ঠাকুরঘর থেকে নামিয়ে আনা হয় একতলার ঠাকুরদালানে। সেখানেই কদিন তাঁদের পুজো হয়। নামানো হয় গৃহদেবী লক্ষ্মী ও নারায়ণকে। শালগ্রাম শিলার পাশাপাশি এখানে নারায়ণের পুজো হয় পানিশঙ্খেও, এমন  রীতিও সচরাচর দেখা যায় না। নারায়ণের হাতে শঙ্খ থাকে ঠিকই, তবে পানিশঙ্খে তাঁকে স্নান করানোই রীতি, পানিশঙ্খের পুজো আমি অন্তত কোথাও দেখিনি।

ফরাসিরা চন্দননগরে আসার পরে এই বাড়ির প্রতিষ্ঠা। প্রশ্ন থেকে যায় কেমন করে এশিয়ার নানা জায়গার প্রথা এসে মিশে গেল এই বাড়ির পুজোয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment