বিজয়ার সেকাল একাল: শুভেচ্ছার ঢল বাড়লেও আন্তরিকতার অভাব
সকাল থেকে বিজয়ার শুভেচ্ছা, প্রতিমা জলে পড়া পর্যন্ত তর সয় না
- Total Shares
প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’নম্বর ফটকের পাশে একটি দোকানে প্যাকেটে মোড়া নারকেল নাড়ু দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম, কারা কেনে? নারকেল নাড়ু যে প্যাকেটে করে বিক্রি হতে পারে তখন সেই ধারনাই ছিল না।
নারকেল ভেঙে কুরে, ছাঁই মেরে, গরম অবস্থায় নাড়ু পাকানোর মতো সময় কোথায়! আবার বিশেষ বিশেষ দিনে অতিথিকে নারকেল নাড়ু খাওয়ালে তৃপ্তি হয়। চাহিদার জন্যই দোকানে দোকানে এখন নারকেল নাড়ু আর ছাপা সন্দেশের জোগান।
দোকানে বিক্রি হচ্ছে গুড় ও চিনির নারকেল নাড়ু (ডেইলিও বাংলা)
তিরকাঠিতে জড়ানো সুতো ছিঁড়ে আর পূর্ণঘট সামান্য নাড়িয়ে দিয়ে বিসর্জন হয় দেবীর। বিসর্জনের পরে হলুদগোলা একটি তামার পাত্রে দেখা হয় দেবীর চরণযুগলের প্রতিবিম্ব, সেখানে দেখতে না পেলে অসুবিধা নেই, দর্পনেও দেখা চলে। মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবীর বিজয়ার পরে এটাই রীতি। অপরাহ্নে দেবীর বিসর্জনের পরে শুরু হয় শুভেচ্ছা বিনিময়।
দর্পনে প্রতিবিম্বিত দেবী (ডেইলিও বাংলা)
মণ্ডপে যখন বিজয়ার ঢাক বাজছে, তখন বাড়িতে বাড়িতে চলছে বিজয়ার প্রস্তুতি। কুচো নিমকি, কুচো গজা, নারকেল নাড়ু, নারকেল ছাপা, মালপোয়া, ঘুগনি – সকাল থেকে চলছে প্রস্তুতি। মিষ্টির দোকান থেকে আসবে সীতাভোগ আর মিহিদানা। সঙ্গে বড়জোর চন্দ্রপুলি। বিজয়াদশমীর ছবি ছিল এটাই।
বাড়িতে দুপুরের রান্না হত বটে, একটু বয়স্ক লোক ছাড়া কেউই বিশেষ খেতেন না, ছোটরা তো নয়ই। ওই সব খাবার চেখে দেখতে দেখতেই পেট মোটামুটি ভরে যেত। জায়গা যেটুকু থাকত তা রাখা হত রাতের জন্য। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেতে হবে যে।
চন্দ্রপুলি: বিজয়াদশমীর স্পেশ্যাল, বিক্রি এই সময়টাতেই
আজকাল সময় নেই বাড়িতে বসে নাড়ু বানানোর, গোলা থালার উপরে বাঁকা করে ছুরি চালিয়ে কুচো নিমকি বানানোর। তাই দোকান থেকে সে সব কিনে আনা হয়। দোকান থেকে কিনে শুধু পরিস্রমই বাঁচে না, কোনটা পুড়ে যাওয়ার বা ঠিকমতো পাক না হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
কোনটা দোকান থেকে কেনা নাড়ু আর কোনটা বাড়িতে তৈরি তা বুঝতে অবশ্য বিশেষ সময় লাগে না, আসলে দোকানের গজা-নিমকি-নাড়ুতে মা-মাসী-ঠাকুমা-দিদিমার সেই আন্তরিকতার মিশেলটা থাকে না।
একটা ব্যাপার বেশ লাগে, পর্তুগিজদের থেকে দুধ কাটিয়ে ছেনা (ছানা নয়) বানাতে শিখে বাঙালি যতই রসগোল্লার পেটেন্ট পাক আর সন্দেশ দিয়ে বাজি মাত করুক, বিজয়াদশমীতে ইউরোপ বর্জনীয়। কতদিন থাকবে তা অবশ্য বলা কঠিন।
আজকাল অনেকেরই মুখে চিনিসন্দেশ ঠিক রোচে না, তার বদলে সন্দেশই পছন্দ। মালপোয়ার জাত গেছে, রসগোল্লা এখন অভিজাত শ্রেণীর। তাই বিশেষ অভ্যাগতদের জন্য ছেনার মিষ্টি রাখতেই হচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে।
বিজয়ার সন্ধ্যায় প্রথম প্রণাম পান দেবী দুর্গা। লাল কালিতে ১০৮ বার দুর্গানাম না লিখে কাউকে প্রণাম করার জো নেই। ১০৮ বার না পারলে অন্তত ১০ বার লিখতেই হবে। তারপরে শুরু চিঠি লেখা।
যাঁরা দূরে আছেন তাঁদের কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে চিঠিতে প্রণাম জানানো রীতি হয়ে গিয়েছিল। গুরুজনরা চিঠি পেয়ে ফিরতি ডাকে আশীর্বাদ পাঠাতেন।
চিঠি লেখা এখন অতীত (একটি মণ্ডপের থিম থেকে নেওয়া)
চিঠিতে থাকত হাতের লেখার ছোঁয়া, থাকত শ্রদ্ধা ও স্নেহের স্পর্শ। ফরওয়ার্ড করা মেসেজের সঙ্গে তার তুলনা চলে না।
চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেলেও শুভেচ্ছা জানানোর ঢল এখন অনেক বেশি। প্রতিমা জলে পড়া অবধি তর সয় না অনেকে। বাসী বিছানা তোলার মতো ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়ে যায় গ্রুপে গ্রুপে শুভেচ্ছা পাঠানো, বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে শুভেচ্ছা পাঠানো। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে মুহূর্তে বার্তা পাঠানো যায়। তাড়া কী, প্রতিমা জলে পড়ুক না!
দেবীর বোধনে যেমন আনন্দ হয়, বিজয়াতেও তেমনি। বিজয়া মানে পরের বছর আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখা, তারপরে এক বছর ধরে প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করা, প্রহর গোনা।
আনন্দের আরেকটা কারণও আছে। বেশ কয়েকবছর আগে কুমোরটুলিতে এক শিল্পীকে প্রশ্ন করেছিলাম, এতদিন ধরে তাঁর তৈরি প্রতিমা ভাসান দেওয়া হল জলে। খারাপ লাগে না? তিনি বললেন, “একই প্রতিমায় বছরের পর বছর পুজো হলে আমাদের চলবে কি করে?”