সিবিআই নয়, নোবেল চুরির তদন্ত রাজ্য পুলিশ বা সিআইডির হাতে থাকা উচিৎ ছিল

শান্তিনিকেতনে সিবিআই-এর কিছুই ছিল না, না লোকাল সোর্স, না স্থানীয় ক্রিমিনালদের রেকর্ড

 |  6-minute read |   29-03-2018
  • Total Shares

সেদিন রামচন্দ্র বনে গেলে আজ ফিরে আসতেন।

কিন্তু চোদ্দো বছর কেটে গেলেও ‘সে’ আর ফিরে এল না।

নোবেল পদক চুরির চোদ্দো বছর পর এমন কথা বলাই যায়। ‘জাতীয় শোকের দিন’ ২৫ মার্চ ২০০৪ থেকে ২০১৮ – এ তো কম সময় নয়। এই সুদীর্ঘ সময়ে সারা বিশ্বের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক নানা পরিবর্তন হলেও, শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণের সংগ্রহশালা থেকে চুরি যাওয়া নোবেল পদক আজও ‘অধরা-মাধুরী’।

কী হয়েছিল ঠিক চোদ্দো বছর আগে?

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। মঙ্গলবার অর্ধদিবস আর বুধবার সাপ্তাহিক ছুটির পর কাজে ফিরছে বিশ্বভারতী। একটু আগেই ঘড়ির কাঁটা ১০টা পেরিয়েছে। হঠাৎ জানা গেল উত্তরায়ণের বিচিত্রা বাড়ির সংগ্রহশালায় চুরি হয়ে গেছে। উত্তরের জানলা ভেঙে চুরি হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক। সেই সঙ্গে কবিগুরুর সোনার পকেট ঘড়ি, সামুরাই তরবারি, মৃণালিনী দেবী ব্যবহৃত জরির কাজের বালুচরি শাড়ি, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার হাতল দেওয়া ছড়ি সহ ৫২টি সামগ্রী। সেদিন সংবাদ মাধ্যমে হুহু করে চুরির খবর ছড়িয়ে পড়তেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক কেউ চুরি করতে পারে – ভাবনা তো দূরে থাক, এমন দুঃস্বপ্ন কেউ কোনওদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। চুরি যাওয়া সামগ্রীর বস্তুগত ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম।

যেমন চুরি যাওয়া বেশির ভাগ সামগ্রী সোনার তৈরি। নোবেল পদক, ‘ওঁ’ লেখা সোনার আংটি, সোনার পকেট ঘড়ি, সোনার হাতল দেওয়া ছড়ি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত দশ পাপড়ির সোনার পদ্ম, বিভিন্ন সোনার মেডেল, সোনার জরি দেওয়া মৃণালিনী দেবীর বিয়ের বালুচরি শাড়ি, সোনা দিয়ে বাঁধানো নোয়া।

body_032918120646.jpg চোদ্দো বছর কেটে গেলেও সে আর ফিরল না

চুরি যাওয়া সামগ্রীর ঐতিহাসিক মূল্য

এশিয়া মহাদেশে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পদক, ফলে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। রবীন্দ্রনাথের সোনার পকেটঘড়ির মূল্য ঐতিহাসিক। ঘড়িটি বিশ্বভারতীর স্থাপনের পরে আর্থিক অনটনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লাহোর নিবাসী বন্ধু অক্ষয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী দেবীর কাছে বিক্রি করেন। পরে ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিয়ের সময় ওই ঘড়িটি উপহার দেন ওই দম্পতি। প্রশান্ত পালের ‘রবিজীবনী’র পঞ্চম খণ্ডে এর উল্লেখ আছে। ওই ঘড়িটি রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করতেন বলে রথীন্দ্রনাথ ১৯৪২ সালে উদয়ণ বাড়িতে সংগ্রহশালায় রেখে দিয়েছিলেন, পরে ১৯৬১ তে গড়ে ওঠা বিচিত্রায় বড় সংগ্রহশালায় ওই ঘড়িটি স্থান পায়।

সামুরাই যোদ্ধাদের ব্যবহৃত কারুকার্য খচিত দীর্ঘ ওই তরবারিটি ছিল রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাঁকে ওই তরবারিটি উপহার দিয়েছিলেন জাপানের শিল্প ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ওকাকুরা কাকুজো। রবীন্দ্রনাথের এক বছর আগেই মারা যান সুরেন্দ্রনাথ। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তরবারিটি সংগ্রহশালায় রাখেন। ১৯০২ সালে জাপান-ভারত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরির লক্ষে ওকাকুরা কলকাতায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে এবং প্রাচ্য ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে। তিনি পরে ভগিনী নিবেদিতার প্রেরণায় ভারতের বৈপ্লবিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ দিন তিনি কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে ছিলেন, সেই সম্পর্কের নিদর্শন হিসাবে তিনি তরবারিটি উপহার দেন সুরেন্দ্রনাথকে।

কী কারণে চুরি, বস্তুগত লোভ না ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সেই সব সামগ্রী বিক্রি করে অর্থ লাভ? সে তো চোর ধরা পড়লে জানা যাবে...

তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। কবে হবে, আদৌ হবে কি না, সে কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না। আজও শবরীর প্রতীক্ষায় রবীন্দ্রপ্রেমীরা...

তদন্তের টুকিটাকি

তদন্তের গতিপ্রকৃতি আর তার এখনও সফলতা না পাওয়া নিয়ে একটু কথা বলার আগে একটা গল্প বলা যাক। গল্প হলেও সত্যি। নোবেল চুরির তদন্ত তখন দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এর হাতে। একটা সামান্যতম সুত্র খুঁজতে তন্নতন্ন করে ছুটে বেড়াচ্ছেন তদন্তকারীরা। সেই সময় একদিন তাঁরা এক মহিলার ফোন পেলেন। ফোনে জানানো হল কে নোবেল চুরি করেছে ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, সেটা তিনি জানেন। হাতে চাঁদ পেলেন তদন্তকারী দল।

দীর্ঘ কথার পর ঠিক হল নানুর-কাটোয়া বাস রুটের একটি গ্রামের বাসস্টপে ডাকা হবে সেই ‘নোবেল চোর’কে। মহিলাই চিহ্নিত করে দেবেন তাকে। সেই মত নির্দিষ্ট দিনে ধরা পড়ল ‘নোবেল চোর’। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দফায় দফায় জেরা চলল। অবশেষে তদন্তকারী দল নিশ্চিত হলেন – ওই মহিলার সাথে এই যুবকের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ওই যুবককে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন মহিলা, আর যুবক নিজে স্বাবলম্বী হবার জন্য আরও একটু সময় চাইছিলেন। তাই তাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেবার জন্যই সিবিআইকে দিয়ে নোবেল চোর সাজাবার পরিকল্পনা করেন মহিলা।

এই রকম ঘটনা একটা নয়, বহু হয়েছে তদন্তকারীদের সঙ্গে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে ২৫ মার্চের সকাল থেকেই এই ঘটনার সাক্ষী থাকার সুযোগ হয়েছিল। রাজ্য পুলিশ, সিআইডি, সিবিআই – পর্যায়ক্রমে তদন্ত করেছে। সফলতা কি আসেনি? ‘না’ কি করে বলি? যেমন রাজ্য পুলিশ বীরভূম জেলার দুবরাজপুর এলাকা থেকে একজনকে ধরেছিল যার হাতের তালুর ছাপ মিলে গিয়েছিল ঘটনাস্থলে পাওয়া ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে। অন্যদিকে, সিবিআই তদন্ত শুরু করার দিনই সন্ধ্যায় উত্তরায়ণ চত্বরের পিছন থেকে উদ্ধার করে চুরি যাওয়া হাতির দাঁতের তৈরি বেশ কিছু সামগ্রী। তদন্ত শুরুর দিনের এই সাফল্য উৎসাহ জুগিয়েছিল মানুষের। আশা করা হয়েছিল সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে নোবেল পদক ফিরে আসবে।

১৪ বছর পর আজও নোবেল ফিরে এল না।

তদন্ত কেন ব্যর্থ

তদন্ত, বিদেশি যোগ, পাচার – এই সব নিয়ে বিগত এতগুলো বছরে বহু অনুমান করা হয়েছে, বহু কথা বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে, একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে প্রথম থেকেই আমার কিছু জিনিস মনে হয়েছে। তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় – গোড়ায় গলদ। সিবিআই-এর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, রাজ্য পুলিশ বা সিআইডি যে ভাবে এগিয়েছিল – সিবিআই তদন্তকারীরা সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন নি। সিবিআই এর বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ শাখা থাকলেও চুরি যাওয়া সামগ্রী উদ্ধার বিষয়ে কোনও শাখা সে ভাবে আছে বলে আমার জানা নেই। তাছাড়াও তাদের তদন্তে কিছু গলদ ছিল বলে ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়েছে।

কোনও ঘটনা ঘটলে লোকাল ক্রিমিনালদের একটা যোগ থাকেই। লোকাল সোর্স আর লোকাল ক্রিমিনালরা সেটার লিঙ্ক তাদের পরিচিত তদন্তকারীদের হাতে তুলে দেন। শান্তিনিকেতনে সিবিআই-এর কিছুই ছিল না। না তাদের লোকাল কোনও সোর্স ছিল, না তাদের হাতে স্থানীয় ক্রিমিনাল রেকর্ড ছিল – যাদের উপর ভরসা করে প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। দলে স্থানীয় কোন অফিসার থাকলে যেমন সহজেই কোনও জায়গায় পৌঁছতে সুবিধা হয় ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেশা ও তথ্য সংগ্রহে সুবিধা হয়। সিবিআই কে সেই পথে যেতে দেখা গেল না। উপরন্তু দেখা গেল তদন্তে যাঁরা এলেন তাঁরা কেউ এলাকাটিই চেনেন না।

body1_032918120843.jpgরবীন্দ্রভারতীর উত্তরায়ণের বিচিত্রা বাড়ির সংগ্রহশালা থেকে চুরি হয়েছিল নোবেল

ফলে ভুলভুলাইয়ায় আটকে গেল সিবিআই, আর দুষ্কৃতীরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় পেয়ে গেল অপরাধ ও চুরি যাওয়া সামগ্রী লুকিয়ে ফেলতে।

এদিকে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে গিয়ে ধরে ধরে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তাঁরা। গাড়ির ড্রাইভার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, কর্মী থেকে শুরু করে শহরের এক সাংবাদিক, বাদ যাননি কেউ। কিন্তু প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য। বছরের পর বছর ধরে তদন্ত করেও উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য দেখাতে পারলেন না তাঁরা। যার ফলে কয়েকবছর পর ‘তদন্তে কোনও অগ্রগতি না হওয়ায়’ আদালতে ‘তদন্ত সাময়িক বন্ধের আবেদন করতে বাধ্য হয় সিবিআই।

তারা জানায়, ‘গুরুত্বপূর্ণ সূত্র’ পেলে আবার তদন্ত শুরু করবে। যদিও সেই ‘গুরুত্বপূর্ণ সুত্র’ কী, আদৌ সেটা মিলবে কি সে নিয়ে কোনও কিছু খোলসা করেনি তারা।

মোদের আশা

বছর দুয়েক আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল তদন্ত রাজ্য শুরু করতে চায় বলার পর সাধারণ মানুষ আবার আশার একটা আলো দেখতে পান। কিন্তু সিবিআই এখনও নোবেল চুরির তদন্ত রাজ্যকে হস্তান্তর করতে রাজি নয়। ফলে নোবেল তদন্ত আদৌ কিছু হবে কি না, বা হলে কী হবে, সে নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর বিশ বাঁও জলে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, যে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু থেকেই ভুলে ভরা, সেই তদন্তে কী আদৌ সাফল্য পাওয়া কোনওদিনও সম্ভব? তাই নোবেল পদক-সহ সমস্ত সামগ্রীকে কে বা কারা অজ্ঞাতবাসে পাঠাল, সেখান থেকে কবেই বা ফিরবে সে প্রশ্নের উত্তর হয়েত কোনও দিনও পাওয়া যাবে না।

তাও, আশায় মরে আম বাঙালি সহ সমগ্র ভারতবাসী।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Surajit Ghosh Hazra Surajit Ghosh Hazra @surajit_press

The writer is a senior journalist based in Bolpur, Shantiniketan.

Comment