কংগ্রেস ও বিজেপি -- দুই জমানায় স্মারকমুদ্রায় রাজনীতি
সম্প্রতি মহলানবীশকে নিয়ে স্মারক মুদ্রা উদ্বোধন হল, শুরুটা কোথায়
- Total Shares
কিছু দিন আগে কলকাতায় এসে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের স্মরণে স্মারকমুদ্রা প্রকাশ করেছেন উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু। বেশ কিছুদিন ধরে বিজেপি যে ভাবে বাংলায় আসন বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ও বঙ্গ সংস্ক্তির প্রতি আবেগ প্রকাশ করছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ হতে পারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে নিয়ে মুদ্রা প্রকাশ করা।
ব্রাত্য বিজ্ঞানীরা, মহলানবীশ ব্যতিক্রম
যোগ্যতার বিচারে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। তবে প্রশ্ন থাকতে পারে সত্যেন্দ্রনাথ বসুকেও কেন একই ভাবে সম্মান প্রদর্শ করা হল না, তা নিয়ে। তবে কোনও অংশে কম নন জগদীশচন্দ্র বসু, ১০ বছর আগেই তিনি দেড়শো পেরিয়েছেন। বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব-খ্যাত বিজ্ঞানী, যাঁর তত্ত্বের উপরে নির্ভর করে ঈশ্বরকণা খোঁজা হয়েছে, আগামী বছর তাঁর জন্মের ১২৫ বছর। শতবর্ষ পেরিয়েছে নীরবে, দেখা য়াক আগামী বছর কী হয়!
ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট সেই কয়েকটি গুটিকয় সংস্থার অন্যতম, যার প্রধান কার্যালয় এখনও কলকাতায়। তাই হয়তো এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাকে বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি আবার বাঙালি বিজ্ঞানী।
ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে নোবেল পেয়েছেন চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরমণ (১৮৮৮-১৯৭০)। ১৯৮৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৮৯ সালে জওহরলাল নেহরুর শতবর্ষ নিয়ে স্মারক মুদ্রা প্রকাশিত হলেও স্যার চন্দ্রশেখরকে তাঁর জন্মশতবর্ষে ভুলে গিয়েছিল তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকার। বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেবলমাত্র হোমি ভাবাকেই নিয়েই ভারতে মুদ্রা তৈরি হয়েছে (২০১০)।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) নীরবেই পার করেছিলেন জন্মের শতবর্ষ ও একশো পঁচিশ বছর। স্বামী বিবেকানন্দের তো মৃত্যুরও শতবর্ষ পার হয়েছে। কিন্তু স্মারকমুদ্রায় তাঁদের ঠাঁই ছিল না। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় অবশ্য তাঁদের জন্মশতবর্ষে স্মারকমুদ্রা প্রকাশ করেন। ভারতে সেগুলিই ছিল প্রথম দেড়শো টাকার কয়েন।
এর আগে অবশ্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর (১৮৯৭-?) জন্মশতবর্ষে স্মারক মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। ভুল করে ১৯৯৬ সাল লিখে (১৯৯৭-এর বদলে) স্মারক মুদ্রাটি বার হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালের কিছুটা সময় পর্যন্ত কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার ছিল। সেই সরকারে বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব ও যোজনা কমিশনের দায়িত্ব সামলেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। হতে পারে এ ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ ছিল।

পরিবারতন্ত্র
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু (১৮৮৯-১৯৬৪) নিজেই নিজেকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও (১৯১৭-১৯৮৪) বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। বিস্ফোরণে মৃত্যুর পরে ইন্দিরার পুত্র রাজীবকেও (১৯৪৩-১৯৯১) সেই সম্মান দিয়েছিল কংগ্রেস সরকার। জওহরলালের মৃত্যুর পরে, তাঁর জন্মের শতবর্ষ ও ১২৫ বছরে স্মারক মুদ্রা প্রকাশ হয়েছে, ইন্দিরা ও রাজীবের মৃত্যুর পরেই তাঁদেরও স্মারকমুদ্রা প্রকাশিত হয়েছে (প্রতিবারই সরকারে ছিল তাঁদের দল কংগ্রেস। তবে ১৯১৭ সালে কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার না থাকায় ইন্দিরার শতবর্ষে সরকারি অর্থে হইচই করার সুযোগ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় লালবাহাদুর শাস্ত্রীর (১৯০৪-১৯৬৬) মৃত্যু হলেও তখন অবশ্য তাঁর কোনও স্মারকমুদ্রা প্রকাশিত হয়নি, হয়েছিল শতবর্ষে।
দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের জন্ম শতবর্ষে তাঁকে নিয়েও কোনও মুদ্রা প্রকাশিত হয়নি, পরে অবশ্য হয়েছে। স্থান পেয়েছেন জওহরলাল নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরুও, কী হিসাবে বলা মুশকিল। তিনি কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন ঠিকই, আরও অনেকেই ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রিত্ব যদি মুদ্রায় স্থান পাওয়ার মাপকাঠি হয়, তা হলে মোরারজি দেশাই ও চৌধরী চরণ সিং কেন বঞ্চিত হলেন? এঁরা কেউই গুলজারিলাল নন্দের মতো ১৩ দিনের জন্য অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না!

কংগ্রেস ও আঞ্চলিকতা
বিজ্ঞানীরা কার্যত বাদ। সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ত্রয়োদশ শতকের মরাঠী কবি সন্ত বাসবেশ্বর ছাড়া অন্য কারও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি স্মারক মুদ্রার বিচারে। তবে কংগ্রেসি আমলে দলের ও শরিক দলের নেতাদের যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে মুদ্রার মাধ্যমে। যেমন কে কামরাজ (কংগ্রেস নেতা), পেরিগনার আন্না (ডিএমকে-র প্রতিষ্ঠাতা), চিদম্বরম সুব্রমণিয়ম (কংগ্রেস নেতা ও সবুজবিপ্লবের জনক) প্রমুখ। দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে নিয়েও মুদ্রা বার হয়।
অষ্টম তামিল কংগ্রেসের কথাও উল্লেখ করতেই হবে। কারণ এ নিয়ে তিন-তিন রকম মুদ্রা প্রকাশ করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। তাতে ছিলেন সন্ত তিরুবল্লুবর। ১৯৯৬ সালের মুদ্রা। তখন নরসিমহা রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকার। তারপরে বাজপেয়ীর এক পক্ষকালের সরকারের কথা বাদ দিলে আঞ্চলিক দলগুলির সরকার ছিল কিছুদিন। তাতে শরিক ছিল সিপিআই-ও।
ধর্ম ও রাজনীতি
শোনা যায়, কংগ্রেসের কোনও এক নেতার মনোস্কামনা পূর্ণ হয়েছিল বলে নাকি বৈষ্ণোদেবীর মুদ্রা প্রকাশ করেছিল কংগ্রেস। ব্যাপারটা বেশ অভাবনীয়, কিন্তু বাজারে প্রচার কেমনই। বৈষ্ণোদেবীকে নিয়ে মুদ্রা প্রকাশিত হওয়ায় একটি মামলাও হয়েছিল। তবে সেটি পরে ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে এর আগেও কংগ্রেস মহাবীর জৈনকে নিয়ে মুদ্রা প্রকাশ করে, যেখানে তাদের ধর্মীয় চিহ্ন ছিল।
২০০৪ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে ২০০৬ সালে দুজন ধর্মগুরু বা সমাজসংস্কারকের নামে স্মারকমুদ্রা প্রকাশ করে, সন্ত বাসবেশ্বর ও জগৎগুরু শ্রী নারায়ণগুরু। লিঙ্গায়তদের আদর্শস্থানীয় ব্যক্তি সন্ত বাসবেশ্বর এবং কেরলের এলাভা বা এজাভা সম্প্রদায়ের উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সংস্কারক ছিলেন নারায়ণগুরু।
২০০৮ সালে শিখ ধর্মগ্রন্থের ৩৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ স্মারকমুদ্রা প্রকাশিত হয়, যদিও সেটি সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য কোনও দিনই খোলা বাজারে চালু হয়নি। অতি সম্প্রতি বিজেপি আবার প্রকাশ করেছে গুরু গোবিন্দ গোবিন্দ সিংহের মুদ্রা, এখনও সেটি বাজারে আসেনি, আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ হয়েছে মাত্র।
২০০৯ ও ২০১০ সেন্ট আলফোনসা (কেরল) ও মাদার টেরেসার মুদ্রা বার হয় কংগ্রেস আমলে। স্বামী চিন্ময়ানন্দের (২০১৫)নামে মুদ্রা বার করেছে বিজেপি। সম্প্রতি জৈন কবি শ্রীমদ রাজচন্দ্রকে (গুজরাট) নিয়ে মুদ্রা বার করেছে বিজেপি। এখন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে আদর্শ মানে বিজেপি, তাঁকে নিয়ে মুদ্রা বার হয়েছে বিজেপি জমানার আগে, ১৯৯৬ সালে। দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় মদনমোহন মালবীয়কে নিয়েও স্মারকমুদ্রা প্রকাশ হয়েছে।
বিজেপির ঝোঁক
১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। শোনা যায় তিনি নাকি একটু বাঙালি-ঘেঁষা ছিলেন। সেই সময়ে চিত্তরঞ্জন দাশ ও অরবিন্দ ঘোষকে নিয়ে মুদ্রা বার হয়েছিল। ২০০১ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে যে মুদ্রা প্রকাশ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণের স্মারক মুদ্রা, জরুরি অবস্থা জারির সঙ্গে সঙ্গে যাঁকে গ্রেপ্তার করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
তবে বিজেপি আমলে দুবার বার হয়েছে রানা প্রতাপ সিংহের স্মারক মুদ্রা। একবার বার হয়েছে ছত্রপতি শিবাজির স্মারক। আলাদা ভাবে তাত্যা তোপীর মুদ্রাও প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি শিক্ষাবিদ সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণনকে নিয়ে স্মারক মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে।
মণিপুরের রানি গাইদিনল্যুর স্মারকমুদ্রা প্রকাশ হয়েছে ২০১৫ সালে, এখনও অবশ্য সর্বসাধারণের জন্য তা বাজারে চালু হয়নি। অবশ্যই বেরিয়েছে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্মারক মুদ্রা। ১৯১৪ সালে কোমাগাতামারু নিয়ে স্মারক মুদ্রা প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ জয়ের স্মারকমুদ্রাও প্রকাশ করে বিজেপি। সম্প্রতি গায়িকা সুব্বুলক্ষ্মীকে নিয়ে তারা স্মারক প্রকাশ করেছে।
স্বাধীনতা ও সংগ্রামী
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে ২০০৭ সালে ভগৎ সিং ও লোকমান্য টিলককে নিয়ে মুদ্রা বার হয় ইউপিএ জমানায়। এ বার বার হতে চলেছে লালা লাজপত রাইয়ের স্মারক মুদ্রা, উদ্বোধন হয়ে গেছে, বাজারে আসেনি। লাল-বাল-পালের মধ্যে এখনও ব্রাত্য রয়েছেন বিপিনচন্দ্র পাল। সিপাহি বিদ্রোহের দেড়শো বছর উপলক্ষে ২০০৭ সালে বিশেষ স্মারকমুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তাত্যা তোপীর স্মারকমুদ্রা প্রকাশ করেছে বিজেপি সরকার।
তাঁরা সংগ্রামী ছিলেন, এখন হিন্দুত্বের প্রতীক বলে মনে করেন অনেকে। বীর দুর্গাদাস, রানা প্রতাপ সিংহ ও ছত্রপতি শিবাজি। এঁদের নিয়ে স্মারকমুদ্রা প্রকাশ করেছে বিজেপি। এর মধ্যে আবার শুধু মহারানা প্রতাপকে নিয়ে দু-বার।
গান্ধী ও আম্বেদকর
মহাত্মা গান্ধীর ছবি দেওয়া স্মারক মুদ্রা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বেরিরেছে। ১৯৬৯ সালে ৪ রকম, ১৯৯২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৫০ বছর (১ টাকা) , ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী (৫০ পয়সা), ডান্ডি অভিযানের ৭৫ বছর (৫ টাকা), খাদি গ্রামোদ্যোগের ৫০ বছর (৫ টাকা) ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তাঁর দেশে ফেরার ১০০ বছর (১০ টাকা)।
আম্বেদকর দ্বিতীয় ব্যক্তি যাঁকে এই দুই জমানাতেই মুদ্রায় সম্মানিত করা হয়েছে।

