দেশপ্রেমের ধারণাটা পাল্টে যাচ্ছে, কেন?

পুলওয়ামার পর থেকে চেনা দেশটাকে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে

 |  3-minute read |   01-03-2019
  • Total Shares

পুলওয়ামায় জঙ্গি হানা। সিআরপিএফ জওয়ানদের নিথর দেহ দেশকে পীড়িত করে। সিআরপিএফের নিহত জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রীকে ট্রোল স্তম্ভিত করে। সদ্য স্বামীহারা স্ত্রীর অন্যায় ছিল, তিনি বলেছেন যুদ্ধ চাই না

ব্যস, তার পরেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দেশপ্রেমিকদের মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়। তাদের বক্তব্য হল – নিহত বাবলু সাঁতরার স্ত্রী পরপুরুষে আকৃষ্ট। তাই তিনি যুদ্ধ চান না। আমার কলেজ পড়ুয়া মেয়ের বান্ধবী যুদ্ধ চায় না বলায় তাকে ধর্ষণ করার হুমকি শুনতে হয়। পুলওয়ামায় জঙ্গি হানার পরে তাই চেনা দেশটাকে অচেনা লাগছে।

bablu_0_030119052300.jpegবাবলু সাঁতরাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

যে জঙ্গিরা মৃত্যু নিয়ে খেলা করে তাদের প্রতি ঘৃণা শুভবুদ্ধির স্বাভাবিক প্রকাশ। কিন্তু শহিদের স্ত্রী যুদ্ধ চাই না বললে তাঁকে দুশ্চরিত্র বলা বা কলেজ পড়ুয়া তরুণীকে ধর্ষণ করার হুমকি দেওয়া কোন বুদ্ধির প্রকাশ?

পাক মদতে পুষ্ট জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রত্যাঘাত দেশের সব নাগরিকই চেয়েছেন। পাকিস্তানের হাতে আটক বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের ফিরে আসার পথের দিকে গোটা দেশবাসীই তাকিয়ে থেকেছে। কিন্তু প্রত্যাঘাতের জন্য বুকের মধ্যে জ্বলা আগুন যদি যুদ্ধোন্মাদনায় বদলে যায়?

বদলে গেলে যে স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধিও সেই আগুনে পুড়ে যায তার ছবি যত দেখছি, ততই শিউরে উঠছি। এক কাশ্মীরি যুবকের বিপথগামিতার জন্য যখন দেশের অন্যপ্রান্তে এক কাশ্মীরী যুবককে মেরে রক্তাক্ত করার ছবি দেখি, তখন ভীষণ অসহায় লাগে। প্রশ্ন জাগে, আমরা কি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত হচ্ছি?

abhinandan_1_030119052325.jpegউইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

দেশ জুড়ে এই জিঙ্গোইজম তৈরির পিছনে যে রাজনৈতিক অঙ্ক দেখা যাচ্ছে, তা দেশের পক্ষে মঙ্গল নয়। পুলওয়ামায় জঙ্গি হানার পর ভারত প্রত্যাঘাত করেছে, পাকিস্তানের হাতে বন্দি উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে ভারতে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তান। এতে হয়তো অনেক যুদ্ধপন্থীর বুকের আগুন নিভবে। কিন্তু কুমন্ত্রণার রাজনীতি তো থেকে যাবে, যা ফল্গুধারার মতো বইতে থাকবে। সময়সুযোগ বুঝে সেই ধারা আগুনের নদী তৈরি করবে।

জঙ্গি দমনের নামে আমাদের কোনও সাংবিধানিক পদাধিকারী যখন দেশের নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীকে একঘরে করার কথা বলেন, তখন তাঁর প্রতি নীরব সায় দিয়ে যাওয়া ভারতের চেনা ছবি নয়!

ভারতে দুষ্টের দমনের পাশাপাশি শিষ্টের পালনের মন্ত্র বহু পুরোনো। সেই পুরোনো মন্ত্র কেমন যেন অচল লাগছে এখন। রাজনীতির ফসল গোলায় তুলতে গিয়ে সারা দেশেই হিংসার বাতাবরণ তৈরি হলে তার আগুন তো সব ঘরেই পৌছবে! কারণ আগুনের তো ভেদাভেদ জ্ঞান নেই!

bharat_030119052352.jpgঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতায় উগ্রতা নেই।

আমাদের পশ্চিমবঙ্গে যেমন ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুদিরামদের গর্জে ওঠার ইতিহাস রয়েছে তেমনই চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও আউল, বাউল, সহজিয়া প্রেমের ইতিহাসও রয়েছে। সেই বাংলায় যখন দেখলাম অনেক দিন ধরে সুদূর কাশ্মীর থেকে সাল বেচতে আসা যুবক দের লাঞ্ছনা। দেখলাম, সেই যুকদের মেরে রক্তাক করে বলা হচ্ছে, বল ‘বন্দেমাতরম্’, বল ‘ভারত মাতা কি জয়’ – আমরা বঙ্গবাসী তো ইংরেজ তাড়াতে দেবী মূর্তির সামনে ক্ষুদিরামদের ‘বন্দেমাতরম্’, ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে শুনেছি। এ রকম কু-মুখে এই বাক্য আমাদের সহনীয় নয়।

আমরা ভারতবাসী। আমরা দেশকে মা বলি। এটা আমাদের ডিএনএ-তে পূর্বপুরুষদের থেকে এসেছে। আমাদের গর্ভধারিণী মায়েরা ছেলেবেলা থেকেই আমাদের শিখিয়েছেন, দেশকে সম্মান করতে হয়। কিন্তু এই সব দৃশ্য দেখে দেশপ্রেমের ধারনাটাই যেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে।

পুলওয়ামায় নিহত সিআরপিএফ জওয়ানদের দেহ থেকে তো শুধু রক্ত ঝরেনি, আমাদের বুকের মধ্যেও তাঁদের জন্য রক্ত ঝরেছে। একই সঙ্গে যখন দেখি কলকাতার পুরোনো বাসিন্দা এক কাশ্মীরী চিকিৎসকের মেয়েদের সঙ্গে একই পুলকারে যেতে নিষেধ করছেন তাঁদের বন্ধুর মা-বাবারা – তখনও বুকের মধ্যে রক্ত গরম হয়। এই উন্মত্ততা আমার আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ।

pulwama_030119052421.jpgপুলওয়ামায় নিহত জওয়ানদের শ্রদ্ধা। (ছবি: ডেইলিও)

জীবনানন্দের ভাষায়, এ যেন বোধ নয়, মাথার মধ্যে এক বিপন্নতা কাজ করে। এক শ্রেণীর রাজনীতির কারবারীরা এই বিপন্নতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ভোট আসবে, যাবে। তাতে কোনও দল জিতবে, কেউ হারবে। কিন্তু দেশটাতো থাকবে! সেই রাজনীতিকরা একটু ভেবে দেখুন! এই হিংসার রাজনীতির পরিণতি কী হবে।

আমরাই তো বলেছি, সন্ত্রাসবাদীদের জাত-ধর্ম-দেশ হয় না। তা হলে এই হিংসার বাতাবরণ তৈরি করা কেন? কেন দেশের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টিকে শত্রু চিহ্নিত করে ভোট জেতার এই প্রয়াস? সেই জীবনানন্দকে স্মরণ করে বলছি, “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা।”

আশা করব শুভবুদ্ধি জাগবে, এই আঁধার কাটবে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

BISWAJIT BHATTACHARYA BISWAJIT BHATTACHARYA

Veteran journalist. Left critic. Political commentator.

Comment