নদী-সংযোগ প্রকল্পে কেন বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে
নদী নিয়ে বিবাদের সময়ে কর্নাটকে যে ধর্মঘটের ডাকা হয়েছিল তা পুরোপুরি রাজনৈতিক
- Total Shares
মাণ্ডভি নদীকে কেন্দ্র করে শ্রীকান্ত রামকৃষ্ণন তাঁর লেখায় একটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ নিয়ে ভারতীয় সমাজে দ্রুত সচেতনতা তৈরি হচ্ছে - মিঠা জল নিয়ে দ্বন্দ্ব। বর্তমানে মিঠা জল নিয়ে দ্বন্দ্ব দেশের অনেক জায়গাতেই লক্ষ করা যাচ্ছে।
মহাদায়ী নদীকে (গোয়াতে যা মাণ্ডবী নামে পরিচিত) কেন্দ্র করে কর্ণাটক ও গোয়ার মধ্যে তীব্র বিবাদ বেধেছে। এই মরসুমি নদীটি উত্তর কর্ণাটকের খরাপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্য দিয়ে উত্তর গোয়ার শুষ্ক এলাকাগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এই নদীকে কেন্দ্র করেই দুই রাজ্যের মধ্যে বিবাদ-- কৃষি ও মাছচাষ নাকি গার্হস্থ্য পরিষেবা, এই নদীর জল ঠিক কোন কাজের জন্য ব্যবহার করা হবে?
রামকৃষ্ণন দাবি করেছেন যে, মহাদায়ী নদী নিয়ে বিবাদের সময়ে কর্ণাটকে যে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তা পুরোপুরি ভাবে রাজনৈতিক। ধর্মঘটের সিদ্ধান্তের সঙ্গে নদীর জল ব্যবহারের কোনও সম্পর্ক নেই বলেই তিনি মনে করেন। তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে রামকৃষ্ণনের দাবিতে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। যে সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী নির্বাচনী প্রচারে কর্ণাটকে ছিলেন, সেই সময় আরও দুটি ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এই ধর্মঘটগুলোর সময় থেকে পরিষ্কার যে, এই ধর্মঘটগুলো রাজ্যের রাজনীতিকরণের কথা মাথায় রেখেই ডাকা হয়েছে। তবে রামকৃষ্ণন ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড প্রত্যাহার করার ব্যাপারে যে সমাধান বাতলেছেন তা বিবিধ অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও ভৌগোলিক কারণে যুক্তিযুক্ত নয়।

নদী সংযুক্তির ধারণা শুধু কাগজে-কলমেই ভালো
ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড বা জাতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প (এনআরএলপি) কোনও মৌলিক ভাবনা নয়। কয়েক শতাব্দী আগে ব্রিটিশরাও এই প্রকল্পের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেছিল। নদী সংযোগ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্লাবিত নদীগুলোর সঙ্গে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের মরসুমি নদীগুলোর সংযোগ ঘটানো। ২০০০-এর প্রথম দশকে এই এনআরএলপি আবার মাথাচাড়া দেয়। সেই সময় একের পর এক বন্যায় ও খরা পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে জলের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, সেই সময় এনআরএলপি নিয়ে কথাবার্তা নতুন করে শুরু হয়েছিল।
আজও এই প্রকল্পের বহু সমর্থক রয়েছেন, কিন্তু এই প্রকল্পের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। দেশের যে সব নিত্যবহা, সেগুলি সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে মোটামুটি একই উচ্চতায় অবস্থিত। উল্টোদিকে, দেশের মরসুমি নদীগুলো খুব কম করেও সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে ১০০ মিটার উপর দিয়ে বয়ে চলে। তাই গাঙ্গেয় উপত্যকার নদীগুলো থেকে জল মরসুমি নদীগুলোয় পাঠাতে প্রায় ৩,৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। ২০০১ সালে এনআরএলপির আনুমানিক খরচ ৫,৬০,০০০ কোটি টাকা (যা ২০১৪-১৫ তে উত্তর পূর্বাঞ্চলের জিডিপির থেকেও বেশি) ধার্য করা হয়েছিল। ১৭ বছর পর এই খরচ আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে। দাবি করা হচ্ছে যে, এনআরএল প্ৰকল্পে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হবে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। কিন্তু দেশে সৌরশক্তির দাম ক্রমশ কমছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটির দাম। সুতারং, ভবিষ্যতে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটির কতটা চাহিদা থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
কোন নদীতে জল বেশি বা কোনটাতে জল কম রয়েছে তা নিয়ে কোনও রকম ঐকমত্য নেই। সুতরাং, এই প্রকল্পে কোন নদীগুলোকে সংযোগকরণের জন্যে চিহ্নিত করা হবে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হবে। প্রকৃতির নিয়মে নদীর জল সমুদ্রে যায়, যাকে জলচক্র বলা হয়। প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এনআরএলপি কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। বরং মনে করে এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর জল অপচয় হয়।

বড় প্রকল্পে সমস্যাও বেশি
স্বাধীনতার পরে ৪,৩০০টি বাঁধের নির্মাণ দেশজুড়ে ৪৪ লোককে ছিন্নমূল করেছে। পুনর্বাসনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের পুরোনা রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়। তাই তো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম জুড়ে এই দেশে মানুষ ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়েই চলছে। এবার যদি ৩৭টি নদী সংযোগ করতে গিয়ে ৩,০০০ টি বাঁধ নির্মাণ করতে হয় তাহলে আরও কত লোককে ভিটেমাটি ছাড়া হতে হবে ভেবে দেখুন। দেশে অচলাবস্থা ও নাগরিক বিক্ষোভ শুরু হতে বাধ্য। তাই নদী সংযুক্তিকরণের মতো যে কোনও ধরণের প্রকল্প রূপায়ণের সময় বিশদে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
বড় ধরণের জলসংযুক্তি প্রকল্পে আরও একটি সমস্যা রয়েছে - পরিবেশের ওপর প্রভাব। প্রতিটি প্রকল্প রূপায়ণের সময় পরিবেশের উপর তার কী প্রভাব পড়বে তা খতিয়ে দেখা জরুরি। কিন্তু এই খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া অধিকাংশ সময়তেই শুধুমাত্র 'করতে হয়' বলেই করা হয়। এর একটি বড় উদাহরণ সিকিমে নির্মাণ করা বেশ কয়েকটি জলবিদ্যু প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলো নির্মাণ করার সময় সতর্কীকরণ প্রচার করা হয়েছিল যে রাজ্যটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম।এনআরএলপি প্রকল্পগুলো যদি ব্যাপক ভাবে রূপায়ণ করা হয় তা হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য। নদী কিন্তু বালতি নয় যে তাতে জল ভর্তি করে খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে। নদী ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল।
ভাবনাচিন্তা না করে নদী সংযোগ করতে গেলে জীব বৈচিত্র্যের উপর প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে দেশের কৃষি, শিল্প, খাদ্য ও জলের সুরক্ষা এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। তার পর বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তুহারা হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এর পর কোশী, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার মত আন্তর্জাতিক নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশ ও নেপালের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো। যমুনা, কাবেরী, নর্মদা, মহাদায়ী, গোদাবরী, কৃষ্ণা ও মহানদীর মতো নদীগুলোকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব তুঙ্গে। পাকিস্তান, চিন ও বাংলাদেশের সঙ্গে সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদী নিয়ে এমনিতেই যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। ফের নতুন করে সমস্যা তৈরি করা কোনও মতেই উচিত্ হবে না।
প্রযুক্তির উপুক্ত ব্যবহার
একটা বিষয় অনস্বীকার্য যে, দেশের পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে প্রযুক্তির কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু এই ধরণের সমস্যা মোকাবিলা করতে গেলে সব দিক বিচার-বিবেচনা করে বিভিন্ন অঞ্চলের উপযোগী এমন উপায় বার করতে হবে যাতে খরচও কম হয়। এমন প্রকল্প রূপায়ণ করতে হবে যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই চাহিদামতো জল পেতে পারেন।
অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের মতো জলজাত সম্পদগুলো নিয়েও বিস্তারিত পরিকল্পনা করতে হবে। এমন পরিকল্পনা করতে হবে যার সাহায্যে উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যথাযথ ভাবে প্রকল্প রূপায়ণ করা যায়। জলসমস্যা দূর করতে হলে ভারতে এই ধরণের পরিকল্পনার প্রয়োজন। নদীসংযোগ প্রকল্পের মতো মতো কোনও বড় মাপের প্রকল্প নয়।

