টিনটিনের দেশ ফুটবলেও চমকে দিয়েছে সারা বিশ্বকে
দল হিসাবে খেলেই বেলজিয়াম হারিয়ে দিয়েছে ব্রাজিলকে
- Total Shares
ওলন্দাজ ভাষায় একটা বিখ্যাত প্রবাদ আছেঃ “Eendracht maakt macht” যাকে ফরাসিরা বলে এ ভাবে, “L'union fait la force”। এর বাংলাটা কী? "একতাই বল"।এই প্রবাদকে আপ্তবাক্যের মতো পালন করেন যে দেশের অধিবাসীরা, সে দেশের নাম বেলজিয়াম।
বেলজিয়ামকে ফরাসি ভাষায় বলা হয় ব্যল্ঝ়িক্ আর জার্মান ভাষায় বলে বেলগিয়েন। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশ হল এই বেলজিয়াম, যা ইউরোপের ক্ষুদ্রতম ও সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির একটি।
এখনও এখানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আছে। ইউরোপের সর্বাধিক নগরায়িত দেশ হিসেবে বেলজিয়াম প্রসিদ্ধ। এখানকার ৯৭% লোক শহরে বসবাস করেন।
গোলের পরে উচ্ছ্বাস বেলজিয়ামের ফুটবলারদের
দেশটির নাম বেল্গায়ে নামের এক কেল্টীয় জাতির (এখানকার আদি অধিবাসী)নাম থেকে এসেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে জুলিয়াস সিজার এলাকাটি দখল করে নেন। ইউরোপের একটি ভৌগোলিক সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হওয়ায় দেশটি মধ্যযুগ থেকেই একটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ১৮৩০ সালে বেলজিয়াম স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রাসেলস শহরটি বেলজিয়ামের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। বেলজিয়াম মূলত তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত- ফ্ল্যান্ডার্স, ওয়ালোনিয়া এবং ব্রাসেলস ক্যাপিটাল সিটি। বেলজিয়ামের প্রায় ৫৭% লোক ওলন্দাজ ভাষার একটি উপভাষা ফ্লেমিশে কথা বলেন আর ফরাসি ভাষা কথা বলে প্রায় ৩৩% মানুষ। তৃতীয় প্রচলিত ভাষা জার্মান।
তবে আমার মতো অনেকের ছোটবেলার স্মৃতিতে বেলজিয়াম যে কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে তা হল শুধুমাত্র টিনটিন। ছোটবেলায় আমরা টিনটিনকে শুধু গোগ্রাসে গিলিনি, তাকে ভালোও বেসেছিলাম প্রাণের সখা ভেবে। তার প্রতিটা অ্যাডভেঞ্চারে আমরা তার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থেকেছি। কী আমেরিকায়, কী রাশিয়ায়। কুলপি ছাড়া যেমন গ্রীষ্মকাল জমে না, টিনটিন ছাড়া তেমনি ছোটবেলা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। কিন্তু কে ছিল এই টিনটিন? যে বেলজিয়ান ছেলেটিকে আমরা আজও ভুলতে পারিনি!
টিনটিনের মাধ্যমেই শৈশবে পরিচয় হয় বেলজিয়ামের
টিনটিন আসলে (ফরাসি উচ্চারণ: ত্যাঁত্যাঁ) দুঃসাহসী টিনটিন কমিক্স সিরিজের প্রধান চরিত্র ও নায়ক। সে পেশায় রিপোর্টার ও নেশায় অভিযাত্রী। টিনটিন তার কুকুর স্নোয়ি (যার বাংলা নাম কুট্টুস)-কে নিয়ে সারাবিশ্বে ঘুরে বেড়ায়। বেলজীয় কার্টুনিস্ট অ্যার্জে এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেন। টিনটিন প্রথম আবির্ভূত হয় পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৯ সালে ল্য ভাঁতিয়েম সিয়েকল সংবাদপত্রের ল্য প্যতি ভাঁতিয়েম নামক বেলজীয় ছোটোদের ক্রোড়পত্রে। প্রকাশক কাস্টারম্যান। কী ছিল টিনটিনের আকর্ষণ? পৃথিবীব্যাপী অন্য কমিক্স চরিত্ররা যেখানে পেশিবহুল, বর্ণিল টিনটিন সেখানে সাধারণ একটা ছেলে, যে বুদ্ধির জোরে, ধৈর্যের সঙ্গে একের পর এক বাধা টপকে রহস্যের সমাধান করে। সে নিরপেক্ষ। জাহির করার পক্ষপাতী নয়। অথচ লক্ষ্যে অবিচল। ফলে ট্যাক্টিক্যাল ইমেজের জন্যই কমিকসের পাঠক নিজেকে টিনটিন হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারেন অতি সহজেই।
টিনটিনের স্রষ্টা ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর সৃষ্টি এখনও টিকে আছে। অনূদিত হয়েছে বহু ভাষায়। নির্মিত হয়েছে চলচিত্র। নির্মাতা স্বয়ং স্টিভেন স্পিলবার্গ।
ফরাসি জেনারেল শার্ল দ্য গল একবার বলেছিলেন, তাঁর "একমাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হল টিনটিন"।বস্তুত, টিনটিন তার অসাধারণ প্রাণশক্তির জন্যে ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়।
ব্রাজিলের বিরুদ্ধে জয়ের নায়ক কেভিন দে ব্রুইনি
এই প্রাণশক্তি আর একতাই বেলজিয়ামের সিক্রেট কোড। এক বেলজিয়ান যুবক সেটা প্রমাণ করেছে বহু আগে। এবার তা বারবার প্রমাণ করছে আর একদল যুবক, পায়ে তাদের ফুটবল। মাথায় তীক্ষ্ণবুদ্ধি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমি ডি ব্রুইন, কুর্তোয়া, লুকাকু, হ্যাজার্ডদের কথা বলছি। বলছি কোচ রবার্তে মার্টিনেজের কথাও। এবার বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিলকে কাঁদিয়ে শেষ চারে উঠে গেছে বেলজিয়াম। বেলজিয়ামের চোখ ধাঁধানো ফুটবল দেখে আমি মুগ্ধ। বিশেষ করে বেলজিয়ামের মাঝমাঠ ও গোলকিপার প্রাচীর কুর্তোয়া। বহুবারের বিশ্বজয়ী দল ব্রাজিল দ্বিতীয়ার্ধে ফেরার চেষ্টা করেছিল প্রবল ভাবে। কিন্তু মাঝমাঠে চাদলি, ফেলাইনিরা তাদের রুখে দিয়েছেন বারবার। তাদের সঙ্গে দারুণ সঙ্গ দিয়েছে লুকাকু, হ্যাজার্ডরা। একটি দলের আসল প্রাণ কিন্তু মাঝ মাঠ। এরপরও যে সুযোগ এসেছিল সেখানে বাধার দেয়াল হয়েছে বেলজিয়ামের গোলরক্ষক। থিবাউট নিকোলাস মার্ক কুর্তোয়া। যত বড় নাম তত বড় পারফর্মার। কুর্তোয়া এমন কিছু অসাধারণ সেভ করেছে যেখানে ব্রাজিলের আর করার কিছুই ছিল না। বিচক্ষণ মার্টিনেজ তাঁর চেনা ৩-৪-২-১ ছক থেকে বেরিয়ে ব্রাজিল ম্যাচে ৩-৪-৩ ছকে বাজিমাত করেন।
আসলে টিনটিনের মতো এ বারের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের প্রতিটা খেলোয়াড়ই সাধারণ, কিন্তু বিচক্ষণ। কারোরই তারকা সুলভ ইগো নেই। তাই বেলজিয়াম দলটি কোনও একজন তারকার উপর নির্ভরশীল নয়। ওরা খেলছে একটা দল হিসেবে। তাই বেলজিয়ামের সংবাদপত্রের শিরোনাম বেরিয়েছে “ দলের সংহতিই হল শক্তি” যা বেলজিয়ামের চিরকালীন মূলমন্ত্র।
যাদের ফুটবলে মুগ্ধ গোটা বিশ্ব তাদের আর দেখা যাবে না রাশিয়া বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে। ব্রাজিল নেই। আর্জেন্টিনা নেই। জার্মানি নেই। তবে কি এবার বিশ্বকাপ যাবে এমন কোনও দেশে যাকে ধর্তব্যের মধ্যে ধরাই হয়নি? হতেই পারে। কারণ পাওয়ার ফুটবল বা শিল্প ফুটবল নয়, যে দল ফ্যান্টাসি ফুটবল খেলবে এ বিশ্বকাপ তার।তাই পরের দিন গ্যালারিতে টিনটিনের দেশের প্রতি সমর্থন থাকবে আমারও। কারণ জীবনে অথবা মাঠে আমরা তো ফ্যান্টাসি ফুটবলই খেলতে চেয়েছি বারবার। বেলজিয়াম ফ্যান্টাসি ফুটবল খেলতে জানে।

