‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইভ’: দু’বছরে কতটা কমল দুর্ঘটনা?

দুর্ঘটনার সংখ্যা কমলেও বাড়ছে পথচারীর মৃত্যু

 |   Long-form |   22-05-2018
  • Total Shares

২০১৬-র জুলাই মাসে তৈরি হওয়া ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইভ’ স্লোগানটি পথ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মহৌষধির কাজ করছে-- স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বসে এহেন অনুভূতি ব্যক্ত করায়, তাঁর পারিষদবর্গ পরিসংখ্যান পকেটে করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন আর বলে চলেছিলেন: রাজ্যে দুর্ঘটনা কমছে, শহরে দু্র্ঘটনা কমছে। এ-বছর পথ নিরাপত্তা সপ্তাহের তোড়জোড় চলছে তখন। আর, তার ঠিক পরে পরেই ঘটে গেল দৌলতাবাদ ও চিংড়িঘাটা।

আসলে পরিসংখ্যান ব্যাপারটা বড় গোলমেলে। অনেকটা রিসোল-করা টায়ারের মতো। যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্ঘটনা না ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘সেফ’। যেমন, বাম আমলের পরিসংখ্যান ছিল: দেশের বড়-বড় শহরগুলোর মধ্যে কলকাতায় দুর্ঘটনা সবচেয়ে কম। কিন্তু কী ভাবে? সন্তোষপুরে ব্রিজের উপর থেকে মিনিবাস উল্টে গিয়ে নীচে পড়ছে। ভিআইপি রোডের মুখে রেষারেষি করতে গিয়ে যাত্রী-সমেত বাস নয়ানজুলিতে উল্টে পড়ছে। বেপরোয়া বাসের সৌজন্যে যাত্রীর হাত কেটে গিয়ে এক বাস থেকে আরেক বাসে গিযে পড়েছে। তবু ‘দুর্ঘটনা সবচেয়ে কম’!

body1_052218065533.jpgদৌলতাবাদে দুর্ঘটনার পরে (ফাইল চিত্র)

আসলে তখন কলকাতা বলতে আক্ষরিক অর্থেই টালা থেকে টালিগঞ্জ বোঝাত। যাদবপুর, বেহালা, কসবা, তিলজলা, রিজেন্ট পার্ক স-অ-ব কলকাতা পুলিশ এলাকার বাইরে। আর, এই টালা টালিগঞ্জের ছোট্ট মাঠে গোল দিয়েই তখন কমরেডরা বছর-বছর আইএফএ শিল্ড ঘরে তুলতেন।

পরিসংখ্যানের মজা এখানেই শেষ নয়। কলকাতা পুলিশের ‘অ্যানুয়াল রিভিয়ু বুলেটিন ২০০৫’ থেকে জানা যায়: সে বছরে দুর্ঘটনার সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় কমে গিয়েছিল। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের একটু ভেতরে ঢুকলে গল্পটা পুরো পাল্টে যায়: তার আগের বছর ২০০৪-এ যেখানে ১০৯৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে মৃতের সংখ্যা ছিল ৪২০। আর, ২০০৫-এ যেখানে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০৩৯-তে, সেখানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়ে গিয়েছে ৪৮৩। এখানেই পরিসংখ্যানের ফাঁক আর ফাঁকি। আধাআধি বললে ‘আচ্ছে দিন’ এসে যায়, পুরোপুরি বললে ‘মন্দা’র ছবি চোখে পড়ে স্পষ্ট।

বছরের গোড়ায় যখন ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ নিয়ে মাতামাতি শুরু হযেছে, ‘পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ’র পৌষকালীন পার্বণ শুরু হয়েছে, তখন কলকাতার কলকাতার পুলিশ কমিশনার বলে বসলেন: কলকাতায় দুর্ঘটনা কমেছে ২৫ শতাংশ। রাজ্য পুলিসের কর্তারাও পরিসংখ্যানের ঝাঁপি উপুড় করে দিয়ে বললেন: রাজ্যজুড়ে দুর্ঘটনা ক্রমহাসমান, ক্রমক্ষীয়মান, ক্রমবিলীয়মান...। আর, তার ঠিক পরেই ঘটল দৌলতাবাদ ও চিংড়িঘাটা।

road_body_052218070014.jpgচিংড়িঘাটায় পথদুর্ঘটনার পরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বাস (ফাইল চিত্র)

একই সঙ্গে বলে রাখা দরকার, এই দুই দুর্ঘটনা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। রাজ্যজুড়ে প্রতিদিন একাধিক দুর্ঘটনা ঘটে চলছিল এবং এখনও ঘটে চলেছে। অন্নপ্রাশনের দিন মা-বাবার সঙ্গে বেরিয়ে গাড়ির চাকায় থেঁতলে যাওয়া শিশু বা ঘিলু বেরিয়ে-যাওয়া পথচারী বা ধড়-মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওযা বৃদ্ধ-- প্রতিদিনের ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজ্যে, শহরে, মফস্সলে, গ্রামে। অথচ, ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইভ’কে মহিমান্বিত করতে গিয়ে রাজ্যের আমলা, পুলিশ কর্তারা পরিসংখ্যান জুটিয়ে আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগতে লাগলেন, আর দুর্ঘটনার জন্য পথচারীকে সফট টার্গেট বানিয়ে ফেললেন।

যেখানে সেতু থেকে বাস উল্টে গিয়ে নদীতে পড়ছে সেখানেও পথচারীর দোষ। যেখানে সাইকেল আরোহীকে বেপরোয়া বাস চাপা দিয়ে মারছে, সেখানেও পথচারীর দোষ। আর, কাকে কান নিয়ে গেলে, তার পিছন-পিছন ক্যামেরা নিযে ছুটল মিডিয়ার একাংশ। অথচ, ওই দৌলতাবাদ আর চিংড়িঘাটার ঠিক আগেই আরও একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যান আমাদের হাতে এসে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ সতর্ক হয়নি। হলে হয়ত বা আটকানো যেত...।

traffic_body3_052218070214.jpgসুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যে সরকার মাস ছয়েক আগে ‘রোড সেফটি কাউন্সিল’ গড়েছিল

বছরের গোড়ায় কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের পরিসংখ্যানটি জানিযে দিয়েছিল, এ-দেশে দু্র্ঘটনার প্রথম সারিতে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

দেখা যাক কী বলছে এই পরিসংখ্যান। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় এ দেশে পথ দুর্ঘটনায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬-তে গোটা দেশে ৪ লক্ষ ৮০ হাজারের বেশি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ ঘণ্টায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫৫টি। ২০১৬ সালে দেশে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ (১,৫০,৭৮৫ জন) দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। আহত আরও কয়েক লাখ মানুষ। যাঁদের অনেককেই বাকি জীবনটা পঙ্গু অবস্থায নরক যাপন করতে হচ্ছে। আর, দেশে মোট দুর্ঘটনার ৮৬ শতাংশই ঘটছে ১৩টি রাজ্যে। এই ১৩-র মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।চমকের এখনও অনেক কিছু বাকি আছে। দেশে যে সব শহরে জনসংখ্যা ১০ লাখের বেশি, সেই সব শহরের মধ্যে যে-পাঁচটি শহরে দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে রয়েছে কলকাতা!

ঠিক এমন সময়ে, রাজ্য প্রশাসনের ঝুলি খেকেও বেরিয়ে পড়ল এমনই এক বেড়াল, যা জাতীয় পরিসংখ্যানকেই সমর্থন করে: পথচারীর মৃত্যুতে দেশে এক নম্বরে রয়েছে কলকাতা।

traffic_body2_052218070302.jpgপথ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মহারাষ্ট্র সরকার এক সময়ে ‘অ্যাকসিডেন্ট প্রিভেনশন কমিটি’ গড়েছিল

অবশ্য এহেন বেড়াল বেরিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অন্য এক গল্প। গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস নাগাদ একের-পর-এক দু্র্ঘটনা ঘটছিল কলকাতায়। গড়িয়াহাটে ফুটপাথের ওপর বাস উঠে পড়ে ধাক্কা মারল। মিলেনিয়াম পার্কে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে-থাকা পথচারীকে ধাক্কা মেরে দুটো-পা পিষে দিল। আর তখনই, “বেপরোয়া পথচারী” কে শিক্ষা দেওয়ার কনটেক্সে জানা গেল, দেশের মধ্যে কলকাতায় পথচারীর মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। আর সেই কারণেই, ড্রপ গেট বসানো হবে স্ট্র্যান্ড রোডে ও বিভিন্ন জায়গায় (যদিও বোঝা গেল না, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে-থাকা নিয়মনিষ্ঠ পথচারীকেও যদি রেষারেষি-করা বাস পিষে দেয় আর সে জন্য দুটো পা বাদ যায় তাঁর, তাহলে পথচারীর দোষে কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে)।

পথচারীর রাস্তা পার হওয়ার গল্পে পরে আসব। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে আদৌ নিরাপদে রাস্তা পার হওয়া যায় কিনা বা আদ্যোপান্ত মিসগাইডিং সিগনাল ব্যবস্থা কী ভাবে একই সঙ্গে পথচারীকে বলে রাস্তা পার হতে বলে আর গাড়িকেও বলে এগিয়ে যেতে, সে এক বিস্তারিত আলোচনা। আপাতত বক্তব্য একটাই, যে রাজ্যে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, সেখানে, আর যাই হোক, গত একবছরের পরিসংখ্যান দেখিয়ে অন্তত প্রমাণ করা যায় না ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ স্লোগান যথেষ্ট কাজে দিচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী, স্লোগান যত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, দুর্ঘটনাও তত বেড়ে চলেছে- প্যারাডক্স এখানেই।

traffic_body1_052218070348.jpgএখানে এমন কোনও কমিটি বা কমিশনও তৈরি হল না

“সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ” এই দু’বছরে কতটা সফল, সে প্রসঙ্গে আসতে গেলে একবার জেনে নেওয়া দরকার, কোন পরিস্থিতিতে তৈরি হল এই স্লোগান?

‘জুতো আবিষ্কার’-এর সহজ বুদ্ধি বলে, রেষারেষি করা বাসকে বাইকে করে ধাওয়া করে ধরবে ট্র্যাফিক সার্জেন্ট। প্রয়োজনে ওয়াকিটকিতে সামনের সিগন্যালে বাস দুটোকে আটকাতে বলবে। আর, একমাত্র তা হলেই রেষারেষি কমবে। বাইকের সামনে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িযে থেকে, এক পা এগিযে বা দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ানোর জন্য বাসগুলোকে জরিমানা করে গেলে, রেষারেষি কোনও দিনই কমানো যাবে না। এমনকী, জরিমানার অঙ্ক একশো গুণ বাড়ালেও নয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক কাজটি পুলিশ করে না। আর তার বড় প্রমাণ হল, ২০০৭-এ, ঢাকুরিয়ার মোড়ে রেষারেষি করা দুটো বাসকে ধাওয়া করে থামিয়েছিলেন এক ট্যাফিক সার্জেন্ট। আর তা পরের দিন খবরের কাগজে বড় করে খবর হয়েছিল, বিরল ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে। বামজমানার এই ট্যাডিশন কিন্তু বদলাল না পরিবর্তনের জমানাতেও। অথচ চালু হয়ে গেল ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইভ’।

এবার আসি রাস্তা পার হওয়ার প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, এখানে জেব্রা ক্রসিংয়ের চেয়ে বড় মিথ তথা মিথ্যে আর কিছুই হয় না। বিশ্বের যে কোনও জায়গায়, জেব্রা ক্রসিংয়ে পথচারী পা-ফেলা মাত্র, দূর থেকে আসা গাড়ি গতি কমিয়ে দিয়ে পথচারীকে পার হতে দেয়। এখানে সেই নিয়মটি মানা তো দূরের কথা, জানা পর্যন্ত আছে ক’জনের সন্দেহ। তাই দেখা যায়, জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপরেই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি, আর পথচারীকে গাড়িঘোড়ার মাঝখান দিয়েই প্রাণ হাত করে রাস্তা পার হতে হয়: এই বুঝি ছেড়ে দিল গাড়িগুলো। এই অবস্থায় দৌড়ে পার হলে তা নিয়ম-বিরুদ্ধ। আর দৌড়ে পার না-হলে তা জীবন-বিরুদ্ধ। অথচ ফি-বছর ‘পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ’তে কতই-না স্লোগান তৈরি হয় এই জেব্রা ক্রসিংকে ঘিরে। জেব্রার উপর দিয়ে রাস্তা পার হওয়া বিটলসদের ছবি দেখিয়ে বলা হয়, ‘ইফ দে ক্যান, হোয়াই কান্ট উই’। অথবা: ‘রাস্তার অ্যালZEBRA’...। কত সব স্লোগান আর জ্ঞানগর্ভ বাণী। এমনকী, জেব্রা দিয়ে পার না-হলে হাজতবাসের হুমকি দিয়ে হোর্ডিং পর্যন্ত।

অথচ, রাস্তায় বিশাল পুলিশ বাহিনী গাড়িগুলোকে স্টপ লাইনের মধ্যে দাঁড় করানোর সামান্য কাজটুকুও করে উঠতে পারে না। মনে আছে, মৌলালির মোড়ে একবার এক ট্যাফিক সার্জেন্টকে অনুরোধের সুরে বলেছিলাম: জেব্রার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে গাড়িগুলো, একটু সরিয়ে দিন, তা হলে পার হতে পারি। প্রত্যুত্তরে, ওই সার্জেন্ট কলকাতা পুলিসের একটা ছাপানো পোস্টকার্ড এগিয়ে দিয়ে বলেন: অভিযোগ লিখে পোস্ট করে দেবেন লালবাজারে...!এবার আসি সিগন্যাল প্রসঙ্গে। বেশিরভাগ সিগন্যালই পুরোপুরি ধন্দে ফেলে দেয় পথচারীদের। একইসঙ্গে পথচারীর জন্য সিগনাল সবুজ, অন্যদিকে বাঁদিক-ডানদিক দিযে যাওয়ার জন্য গাড়ির জন্য সিগনালও সবুজ। যে-কারণে দেখবেন, চিংড়িঘাটায় দুর্ঘটনার পর, সিগনাল ব্যবস্থা ঢেলে সাজার সময়ে, সবক’টা সিগন্যাল একসঙ্গে লাল করার ব্যবস্থা হয়েছিল। অর্থাৎ, পথচারী যখন সবুজ সিগন্যাল দেখবেন, তখন গাড়ির জন্য কোনও সিগন্যালই খোলা থাকবে না। এ ছাড়া সিগন্যাল নিয়ে আরও বড় সমস্যাটি হল, আমরা কয়েকজন নাগরিক বছর বারো আগে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে কলকাতার দশটা মোড়ে গিয়ে দেখেছিলাম, ধর্মতলার মতো বড় মোড় পার হওয়ার জন্য কোথাও সিগন্যাল খোলা রয়েছে ৪ থেকে ৭ সেকেন্ড মাত্র। দক্ষিণ কলকাতার এক মোড়ে দেখেছিলাম, রাস্তা পার হওয়ার জন্য পথচারীদের সিগন্যাল খোলা থাকছে ১ সেকেন্ড! আমরা হিসেব করে দেখেছিলাম, “সিগন্যাল মেনে” ধর্মতলার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছতে সময় লাগে ২৮ মিনিট, মানে প্রায় আধঘণ্টা! কারণ, এক-একটা মোড়ে পথচারীর জন্য সিগন্যাল লাল থাকছে মিনিট সাতেক(তারপর সবুজ হচ্ছে মাত্র চার থেকে সাত সেকেন্ড মতো)। সেই হিসেবে ৭ মিনিটকে ৪দিয়ে গুণ করলে দাঁড়ায় ২৮ মিনিট। আমাদের এই ভিডিও সমীক্ষাটিকে নিয়ে প্রথম সারির একটি ইংরেজি দৈনিক লিড স্টোরি করেছিল, অবশ্যই নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে।

body2_052218070524.jpgবাম আমলে যা ছিল ‘দেখেশুনে হলে পার, বহুদিন আয়ু তার’, তারই ‘পরিবর্তন’-পরবর্তী ভারশন আর কী

তাহলে কী দাঁড়াল? রেষারেষি-করা বাসকে পুলিস আটকাটাবার চেষ্টা করে না। পথচারী জেব্রা ক্রসিং দিয়ে নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারেন না। সিগন্যাল ব্যবস্থা হয় অকার্যকর নয় তা আদ্যোপান্ত পথচারী-বিরোধী। বাম আমল থেকে চলে আসা এই ট্র্যাডিশনের কোনও পরিবর্তন হল না। সব আগের মতোই রয়ে গেল। তৈরি হল স্লোগান: ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইভ’।

মনে আছে, রেষারেষি করতে গিয়ে, হাওড়ায় একটি সেতু থেকে যাত্রী বোঝাই বাস নিচে পড়ে গেলে বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে, রেষারেষি বন্ধে কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। অথচ ক্ষমতায় এসে এই নিযে কোনও উচ্চবাচ্যই করলেন না তিনি। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে একের-পর-এক দুর্ঘনায় সেলিব্রিটিরা মারা যেতে থাকলেন।

২০১৫-র দুর্গাপুজোর সময়ে, সপ্তমীর দিন, অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় গাড়ি করে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ফেরার পথে সাঁতরাগাছি ব্রিজে পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান(তখনও কালিকাপ্রসাদ মারা যাননি দুর্ঘটনায়)। এর অল্প কিছুদিন পর, মুখ্যমন্ত্রী বেলুড় যাওয়ার পথে আচমকাই তাঁর কনভয় থেকে নেমে পড়েন সাঁতরাগাছি ব্রিজের উপর এসে। ঠিক যেখানে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়। কী দেখেন তিনি?

সেই সময়ে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যে সরকার মাস ছয়েক আগে ‘রোড সেফটি কাউন্সিল’ গড়েছিল মুখ্যসচিবকে মাথায় রেখে। ওই কাউন্সিল দুর্ঘটনার নিরিখে রাজ্যের ২৫টি ব্যস্ত এলাকাকে ব্ল্যাকস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ওই ২৫-এর মধ্যে পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের দুর্ঘটনাস্থলটিও ছিল। কিন্তু এত কিছুর পরেও, ওই এলাকায় দুর্ঘটনা কমাতে পুলিশ প্রশাসন যে কার্যত কিছুই করেনি, তা দেখে বিস্মিত হয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী নিজেই!

এরপর? কুখ্যাত বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও দেখা গেল, পুলিশের নথিতে তা ‘দুর্ঘটনাপ্রবণ’ বলে চিহ্নিতই নয়!

পথ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মহারাষ্ট্র সরকার এক সময়ে ‘অ্যাকসিডেন্ট প্রিভেনশন কমিটি’ গড়েছিল, আমলা ও পুলিশ কর্তাদের ভার্শনের ওপর নির্ভর না-করে। ওই কমিটি দুর্ঘটনার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। করেছিল। এখানে এমন কোনও কমিটি বা কমিশনও তৈরি হল না।

আর এই যখন পরিস্থিতি, যখন কিছুই বদলানো গেল না, বলা ভাল, বদলানোর চেষ্টাই করা হল না কার্যত, তখন তৈরি হল বাণী তথা স্লোগান: ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইভ’। বাম আমলে যা ছিল ‘দেখেশুনে হলে পার, বহুদিন আয়ু তার’, তারই ‘পরিবর্তন’-পরবর্তী ভারশন আর কী।

‘বাণী তব ধায়’।

পুনশ্চ: রাজ্যজুড়ে দুর্ঘটনার যে মড়ক লেগেছে, আর যাই হোক, ‘বাণী’ দিয়ে অন্তত তার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। দু-বছরে তো নয়ই। সম্ভবত, দুশো বছরেও নয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SABUJ MUKHOPADHYAY SABUJ MUKHOPADHYAY

JOURNALIST | AUTHOR

Comment