শাসন স্নেহেরই অঙ্গ, ছাত্রছাত্রীকে দরকারে ধমকাতে হতেই পারে, এ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা ঠিক নয়

ছ'বছরের শিশুর খাতায় কাটা চিহ্ন দিলে তার আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগবে, এ কথা মানতে পারছি না

 |  3-minute read |   25-03-2018
  • Total Shares

যেদিন প্রথম  স্কুলে যোগ দিয়েছিলাম, সেদিন  টিচার ইন চার্জ  বলেছিলেন, "খেয়াল রাখবেন, শিশুটি মায়ের কোল থেকে সরাসরি আপনার কোলে আসছে, এই প্রথম সে বাড়ির বাইরে ওই সময়টুকু মাকে ছেড়ে থাকছে, তার চেনা পরিচিত মুখগুলি ছেড়ে এই প্রথম কিছু সময় কাটাতে আসছে, আপনার শ্রেণীর একজন পড়ুয়া হয়ে, তাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠতে হবে আপনাকে। তাকে শিক্ষার ক্ষেত্রে সব রকম সাহায্য করাই আপনার কাজ। পাঠ্যক্রমে শিশুর মনোভাব ইতিবাচক করাই আপনার প্রথম কর্তব্য। আর দ্বিতীয় কর্তব্যই হল, শাসন এড়িয়ে চলা, শিক্ষার জায়গায় শাসনের ভূমিকা থাকতে নেই, আপনি তাকে শিখতে সাহায্য করবেন, শেখার কাজে তার পাশে থাকবেন, তার মনের দ্বিধা কাটিয়ে সে যেন আগামিপথ স্বচ্ছন্দে চলতে পারে তা দেখার জন্যই আপনার এখানে আসা, ভুল সংশোধনের ভার আপনার, কিন্তু তাদের ভুলের শাস্তি যেন তারা না পায়, সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে আপনাকেই, ভুল সংশোধনের মধ্য দিয়েই সঠিক পথের দিশা পাবে শিশু।"...

সেদিন মন দিয়ে শুনেছিলাম, কিন্তু সবটুকুই যে মেনে নিতে পেরেছিলাম, তা নয়... পরে জেনেছিলাম প্রথম দিন দিদি যা বলেছিলেন, সবটাই সরকারের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের নিয়মাবলিরই অংশ, শুধু তাই নয়, বর্তমানে সরকারি নিয়মে প্রাথমিকস্তরে বাচ্চাদের লেখার খাতায় কোনও কাটা চিহ্ন দেওয়াকেও সরকারের আপত্তির তালিকাভুক্ত করা আছে, বলা হচ্ছে কাটা না দিয়ে ভুল শব্দ বা বাক্যকে চিহ্নিত করবেন শিক্ষক,  যাতে শিশু তার ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু কাটা চিহ্ন তার আত্মবিশ্বাসে আঘাত করতে পারে, তাই ওই চিহ্নকে এড়িয়ে যেতে হবে, এই নিয়ম জানার পর যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম, কারণ কোনও চিহ্ন একজন ছ'বছরের শিশুর আত্মবিশ্বাসে আঘাত করবে, এই কথাটাই মেনে নিতে পারছিলাম না, বরং মনে হয়েছিল শিশুর আগ্রহ তৈরিতে বাধা পাবে, কোনও রকম প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরির অবকাশ থাকবে না, যা জীবনে চলার পথে অবশ্যই প্রয়োজন, যদিও সরকার পরিচালিত  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হন তাঁরা সরকারি নিয়ম মানতে বাধ্য থাকেন, সবটুকু না মানতে পারলেও আমিও এই নিয়মেই চলার চেষ্টা করেই আজ প্রায় তেরো বছর চাকরি করে চলেছি, আরও বেশ কিছু বছর করতে হবে, কিন্তু প্রতিদিন যা মনে হয়  আমার.. প্রতিদিনের যা অনুভুতি... চেতনায় মননে যা ছুঁয়ে থাকে তাকে এড়িয়ে যাই কী করে?

body_032518013442.jpgআগামী দিনের নাগরিক যিনি, তাকে সঠিক পথের দিশা দেখাতেই হবে

২০১৮ সাল। যেখানে প্রত্যেক বাবা মা তাঁদের সন্তান নিয়ে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখেন, জীবনের পুরোটাই সন্তানপালনে ব্যয় করেন, এবং তাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকে সন্তানের বেড়ে ওঠায়, ফলত শুরুতেই শিশুকে বাঁধেন কঠিন নিয়মে, বড় বড় ব্যাগ প্রচুর বই, বছর শেষের মূল্যায়নের প্রতিযোগিতা... তারই সঙ্গে টেবল-টেনিস, সাঁতার... শিশুর মনোযোগ যদি বা  এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণের সুযোগ খোঁজে সঙ্গে সঙ্গে  শুরু হয় তুমুল শাসন... ফলত আগাগোড়াই শিশু থাকে কঠিন শাসনের ঘেরাটোপে, সবেতেই সব শিশুর প্রথম সারিতে  জায়গা করতে হবে... কারণ  শেষ পর্যন্ত  এটাইতো স্বপ্ন...

এই হল ২০১৮। এখানে দাঁড়িয়ে  সরকারি বিদ্যালয়ের এহেন নিয়মের উপর ভরসা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে বেশিরভাগ বাবা মায়ের, আমরা যখন চাকরি করতে আসি, তখন একটি ছোট্ট ফুটফুটে শিশুকে আমার সন্তানসম মনে হওয়ার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকত্ব থাকে না। তাকে ভালোবাসব, প্রয়োজনে শাসন করব, অবাধ্য বেপরোয়া শিশুকে শাস্তি দেব, যাতে সে দ্বিতীয়বার একই ভুল বা অন্যায় করার কথা না ভাবে, এটাই তো নিয়ম হওয়া উচিৎ, কারণ শিশুকে যে নিয়মে বাঁধা হবে শিশু ঠিক সে ভাবে সেই নিয়মেই বেড়ে উঠবে, একেবারেই শাসন ছাড়া শিশু সঠিক ভাবে, সঠিক চিন্তায় বেড়ে উঠতে সক্ষম হবে না বলেই আমার ধারণা, অবাধ্য ছেলে আরও অবাধ্য হবে, অন্যায়ের শাস্তি না পেলে অন্যায় করার প্রবণতা বেড়েই চলবে, সুতরাং অবশ্যই তার শাসন নামক শব্দটির সঙ্গে পরিচিত থাকা উচিৎ, যদি আমি শিশুটিকে আমার সন্তানসম মনে করি! তা হলে আমার পরিবারের শিশুটির জন্য আমি যা ভাবছি আমার খুদে পড়ুয়া শিশুটির জন্যেও আমার একই ভাবনা থাকা উচিৎ, তবেই মানুষ গড়ার কারিগর বলতে পারব নিজেদের...  আমি কখনোই আমার পরিবারের শিশুটিকে শাসন ছাড়া বড় করার কথা ভাবতে পারব না, শাসনে রাখাটাই জরুরি এ কথাই  নিজের শিশুর ক্ষেত্রে মনে করে থাকি আমরা, স্নেহ কখনোই শাসন ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না।

... স্নেহে যখন শাসন মেশানো থাকে না তখন তাতে ফল পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়, কিন্তু  সরকার শাসনহীন স্নেহে শিশুপালনে  বিশ্বাস রাখতে বলছে, এই নিয়মে শাসন কী, সে কথাটা শিশু জানবে না, মাত্র ছ’সাত বছর আগেই যে পৃথিবীতে এল, তার ক্ষেত্রে এই নিয়ম যথোপযুক্ত নয় বলেই আমার মনে হয়, ঠিক ভুলের চিহ্নিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে শাসনটাও জরুরি...

আগামী দিনের নাগরিক যে, তাকে সঠিক পথের দিশা দেখাতেই হবে, এমন শপথ থাক না মনে! স্নেহের পাশাপাশি থাক শাসনের ধমক...  একজন পড়ুয়া আর শিক্ষকের সম্পর্ক হোক ভালোবাসার, স্নেহের, শাসনের। তৈরি হোক ভবিষ্যৎ।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MOUSUMI CHOWDHURY MOUSUMI CHOWDHURY

The writer is a government school teacher.

Comment