দেশদ্রোহিতা মামলার বহর দেখে মনে হচ্ছে দেশ এখনও স্বাধীন হয়নি
আধুনিক বিশ্বে ইতিবাচক বিরোধিতার আরও বেশি জায়গা হওয়া উচিত, এতে দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়না
- Total Shares
২০১৬ সালে কর্নাটক পুলিশকর্মীদের একাংশ মাইনে বৃদ্ধি, সপ্তাহে একদিনের ছুটি ও বছরে নিয়মমাফিক কাটি পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করে এবং তাঁরা আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনি বিষয়ক প্রধান পরামর্শদাতা, ভারতের আইন কমিশন, একটি সুপারিশ পত্রে পরামর্শ দিয়েছিল যে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে উল্লিখিত দেশদ্রোহিতার ধারাকে (১২৪এ ধার) পুনঃবিবেচনা করার সময় এসেছে।
"পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ ব্যক্ত করাকে কোনও মতেই দেশদ্রোহিতা বলা যায় না" এই কতটি বলে কমিশনের তরফ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, ভারতীয়দের শাসন করতে ব্রিটিশদের তৈরি আইন আমরা কেন মেনে চলবে যেখানে ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে এই আইন রদ করে দিয়েছে।
সরকার বিরোধী মানেই দেশদ্রোহী, আমরা কতটা স্বাধীন [ছবি: রয়টার্স]
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, "বাকস্বাধীনতার উপর প্রতিটি নিষেধাজ্ঞাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া প্ৰয়োজন যাতে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো যেন অন্যায্য না হয়ে যায়।"
আইনের চোখে দেশদ্রোহিতা
ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় দেশদ্রোহিতার উল্লেখ রয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে এই আইনের প্রবর্তন করে।
এই ধারা মোতাবেক, দেশের সরকারই আদতে একটি দেশ। অনেকটা যেন ইতিহাসের রাজাদের রাজ্যপাটের মতো। এই ধারা প্রচন্ডরকম ভাবে গণতন্ত্র বিরোধী।
বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময় প্রতিবাদকারী জনগণকে 'শিক্ষা' দেওয়ার জন্য এই ধারার ব্যবহার করেছে। যদিও নিকট অতীতে এই ধারায় কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, তবুও এই ধারাটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সরকার বারংবার সরকার-বিরোধীদের আটকেছে।
অরুন্ধতী রয় থেকে শুরু করে প্রবীণ তোগাড়িয়ার অনেকের বিরুদ্ধেই দেশদ্রোহীর অভিযোগ উঠেছিল [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]
কাদের বিরুদ্ধে এই ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে
বুকার জয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রয় থেকে শুরু করে পরমাণু বিরোধী সমাজকর্মী এসপি উদয়কুমার, লোকশিল্পী এস কোভান থেকে শুরু করে চিকিৎসক বিনায়ক সেন, রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট অসীম ত্রিবেদী থেকে শুরু করে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এসএআর গিলানি প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য এই ধারা প্রয়োগ করে হয়েছিল।
২০০৩ সালে, রাজস্থান সরকার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়ার বিরুদ্ধেও এই ধারায় মামলা করেছিল।
১৪ জানুয়ারী আদালতে পেশ করা বারোশো পাতার চার্জশিটে কানাইহা কুমার ও উমার খালিদ সহ জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দশজন প্রাক্তন ছাত্রের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনার জন্য আর্জি জানানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে তাঁরা একটি রাষ্ট্র বিরোধী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।
কানাইহাদের বিরুদ্ধে দেহদ্রোহীতার অভিযোগ আনার কারণ একটাই - ছাত্ররা সেদিন যাই করে থাকুক বা বলে থাকুক তার থেকে সরকার বিরোধী একটি 'বিপ্লবের' সৃষ্টি হয়েছিল।
শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার ধারা আনা হয়েছে, দাবি কানহাইয়া কুমারের [ছবি: পিটিআই]
কিন্তু দেশের শীর্ষ ন্যায়ালয় সুপ্রিম কোর্ট মনে করে, বিরোধিতা যে কোনও গণতন্ত্রের কাছে একটি সুরক্ষা কবচ।
আধুনিক সমাজে বিরোধিতার আরও বেশি করে জায়গা হওয়া উচিত।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে যদি একদল ছাত্র প্রতিবাদ সমাবেশ করে তাহলে দেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে না। খুব বেশি হলে, এই প্রতিবাদ সমাবেশকে রাজনৈতিক বা বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ বলে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যরাতে ভারত স্বাধীন হয়েছিল। দেশের প্রতিষ্ঠাতাগণ চেয়েছিলেন সকলের জন্যেই এই দেশ স্বাধীন হোক। এটি এমন একটি দেশ যে দেশের প্রতিটি লোকই রাষ্ট্রধর্ম পালন করেন। এই দেশে সবাই সমান - এমনকি যাঁরা সরকারের বিরোধিতা করেন তাঁরাও।
আইন কমিশন বলেছিল, "একটি দেশ যদি ইতিবাচক বিরোধিতাকে মেনে নিতে পারে তার চাইতে মঙ্গলজনক আর কিছুই হতে পারে না।"
দেশের সরকারের কর্তব্য আমাদের 'স্বাধীন' ভারতের স্বাদ দেওয়া, যা আমাদের সকলেরই প্রাপ্য।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে