শুজাত বুখারির জন্য দুঃখ প্রকাশ ছাড়াও প্রশ্ন করুন কে তাঁকে হত্যা করল এবং কেন

রাইসিং কাশ্মীরের মুখ্য সম্পাদক একজন সত্যিকারের সাহসী সাংবাদিক ছিলে, তিনি সার্থক নামা

 |  5-minute read |   17-06-2018
  • Total Shares

আরবি ভাষায় শুজাত মানে সাহসী। আর বর্ষীয়ান কাশ্মীরি সাংবাদিক সৈয়দ শুজাত বুখারি তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবার পূর্ব মুহূর্ত অবধি তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করে গেছেন। এক অসমসাহসী পেশাদার আর সর্বজনের সত্যিকারের বন্ধু শুজাত আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।

বছর পঞ্চাশের এই ভদ্রলোক, যিনি তাঁর রাশভারী ব্যক্তিত্ব ও জলদম্ভীর কণ্ঠস্বরের জন্য বেশ সুপরিচিত ছিলেন, ১৪ জুন অজ্ঞাতপরিচয় যুবকদের গুলিতে তিনি নিহত হন। সেদিনই রমজানের শেষ দিন ছিল। বুখারির সঙ্গে তাঁর দুই দেহরক্ষী কনস্টেবল হামিদ ও মুস্তাকও নিহত হয়েছেন। এই ঘটনার সময় বুখারি একটি ইফতার অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।

শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রেস এনক্লেভে তাঁর দপ্তরের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। একজন লোককে ঠিক রমজানের উপোস ভাঙার পূর্বমুহূর্তে হত্যা করা হল, এর চেয়ে নিন্দনীয় আর কিছুই হতে পারে না। এই হত্যা মানবিকতার উদাহরণ তো নয়ই, এমনকি ইসলাম ধর্মে যে মানবিকতার কথা বলা হয়েছে, এই আচরণ তারও পরিপন্থী।

খুশির ঈদের দিন মহরমের শোকের ছায়া নেমে এসেছে গোটা কাশ্মীর জুড়ে। ১৫ জুন উত্তর কাশ্মীরের ক্রিরি গ্রামে শুজাতের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার লোকের জমায়েত হয়েছিল। আবার কয়েক হাজার মানুষ শুজাতের শোকাচ্ছন্ন পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন।

body_061718061706.jpgঘটনার পরের দিনের সংবাদপত্র

শুধু মাত্র রাজ্যের সংবাদমাধ্যম নয়, জাতীয় সংবাদমাধ্যমও শুজাতের মৃত্যু সংবাদে অবাক হয়েছে এবং গভীর শোক প্রকাশ করেছে। টাইমস নাওয়ের মুখ্য সম্পাদক রাহুল শিবশঙ্কর রমজানের সময় কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতির পক্ষে নন। শুজাতের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে গিয়ে তিনিও যুদ্ধ বিরতি বাড়াবার আর্জি জানিয়েছেন।

টুইটে তিনি বলেছেন, “যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো হোক... নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সত্তর বছর আগে অদৃষ্ট লক্ষের পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। আজ যদি আমরা শুজাত ও ঔরঙ্গজেবের হত্যায় শ্রদ্ধাবনত হই, তা হলে আমাদের সেই অঙ্গীকার স্মরণ করা উচিৎ এবং যে প্রলোভন এই সব বিবেকবর্জিত শত্রুর জন্ম দিয়েছে, যাদের সঙ্গে আজ আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিৎ।”

বুখারি কাশ্মীরের তিন তিনটে সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এদের মধ্যে রাইজিং কাশ্মীর নামের ইংরেজি দৈনিকটি তো বেশ জনপ্রিয়। এর আগে তাঁর ৩০ বছরের পেশাদার জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের জম্মু-কাশ্মীরের ব্যুরো চিফ ছিলেন।

সত্যিকারের পেশাদার বলতে যা বোঝায় বুখারি প্রকৃত অর্থে ঠিক তাই-ই ছিলেন। বেশ কয়েকটি শান্তি স্থাপন সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তাও তিনি ছিলেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে ট্র্যাক টু ডায়লগের অন্যতম সদস্য ছিলেন বুখারি। শুজাতের বড় ভাই সৈয়দ বাশারাত বুখারি পিডিপি নেতৃত্বাধীন জম্মু-কাশ্মীর সরকারের বর্ষীয়ান মন্ত্রী। কিন্তু তাঁর এই ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোর কোনও প্রভাব তিনি কোনওদিনও তাঁর পেশাগত জীবনে পড়তে দেননি।

একবার বাশারাতের কনভয় লক্ষ করে যখন উত্তেজিত জনতা ইটবৃষ্টি করে, সেই খবর বেশ ফলাও করেই রাইসিং কাশ্মীর প্রকাশ করেছিল। সরকারি বিজ্ঞাপনকে যে কোনও আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমের জীবনরেখা বলা হয়ে থাকে। এই ধরণের খবর প্রকাশের জন্য পিডিপি সরকারের তরফে তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রগুলিতে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধও করে দিয়েছিল। তবে বুখারির জীবনে এ ধরণের সমস্যা বহুবার এসেছে। এর আগেও, তাঁকে অপহরণের চেষ্টা, এমনকি একাধিকবার তাঁকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল।

এটা সকলেরই জানা যে গত চার বছরে পিডিপি সরকারের দয়া কাশ্মীরের বহু আন্ডার গ্র্যাজুয়েট সাংবাদিক জেড প্লাস ক্যাটেগরির নিরাপত্তা ভোগ করে আসছেন। হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই পড়ছেন- আন্ডার গ্রাজুয়েট সাংবাদিকদের জন্য জেড প্লাস নিরাপত্তা বলয়! কিন্তু বুখারির মতো বর্ষীয়ান সাংবাদিকের অতটা সৌভাগ্য হয়নি।

body1_061718061747.jpgএক অসমসাহসী পেশাদার আর সর্বজনের সত্যিকারের বন্ধু শুজাত আজ আর আমাদের মধ্যে নেই

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে বা করা বুখারিকে হত্যা করল এবং কেন? উত্তরটা গোলমেলে হয়ে পড়ছে, কারণ লস্কর ও হিজবের মতো দুই প্রধান জঙ্গি সংগঠনও বুখারির হত্যার নিন্দা করেছে। অনেকেই মনে করছেন যে এক 'এজেন্সি যুদ্ধের' শিকার হয়েছেন বুখারি। কিন্তু এই এজেন্সির নাম কেউই প্রকাশ্যে আনতে চাইছেন না।

গত ৩০ বছরে কাশ্মীরের অজ্ঞাত পরিচিতদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর নজির কম নেই। শ্রীনগরের প্রেস এনক্লেভেই তো এর আগে তিনজন সাংবাদিকের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল। শুজাতের মৃত্যুও শুধুমাত্র এই তালিকায় আরও একটি সংযোজন হিসেবে না রয়ে যায়।

পুলিশের তরফ থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু করা হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই পুলিশ সম্ভাব্য আততায়ীদের ছবি প্রকাশ করেছে ও একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, বেশ কয়েকটি প্রশ্নের এখনও মীমাংসা করা যায়নি। পুলিশের একটি ফ্লায়িং স্কোয়াড কেন প্রেস এনক্লেভের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল? বুখারি যখন খুন হলেন তখন সেই ফ্লায়িং স্কোয়াড কোথায় ছিল? প্রেস এনক্লেভের নিরাপত্তা এমনিতেই বেশ জোরদার। শুধু পুলিশ নয়, প্রেস এনক্লেভে সাদা পোশাকের গোয়েন্দারাও মোতায়ন থাকেন। কিন্তু, আশ্চর্যজনক ভাবে শুজাতের উপর হামলার সময় এরা অনুপুস্থিত ছিলেন। কেন? প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী ঘটনাস্থলের ঢিল ছোড়া দূরত্বে থানা থাকলেও ঘটনার ২০ মিনিট বাদে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু, কেন?

সরকারের কাছের বহু সাংবাদিকই যেখানে জেড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা ভোগ করে থাকেন সেখানে হত্যার চেষ্টা হওয়া সত্ত্বেও সুজাতের জেড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি কেন? জীবন মূল্যবান। তাই মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও রাজ্য পুলিশের ডিজি এসপি বৈদকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেই হবে।

মৃত্যুর পরের দিন, সকলেই যখন সুজাতের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার আয়োজনে ব্যস্ত, রাইসিং কাশ্মীরের প্রকাশ কিন্তু বন্ধ হয়নি। মৃত্যুর পরের দিনও সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে যার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে কাগজের মুখ্য সম্পাদকের হত্যার খবর।

পরের দিনের সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল, "আপনি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু আপনার পেশাদারিত্ব ও সৎসাহস আমাদের জীবনের আলো হয়ে রয়ে যাবে। যারা আপনাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে আমরা কিন্তু সেই কাপরুষদের নিয়ে কাপুরুষতায় ভুগব না। সত্য যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন, আমরা সর্বদাই সত্যের পূজারী থাকব... আপনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।"

রাইসিং কাশ্মীর, শুজাতের স্ত্রী তেহমিনা বুখারি ও দুই সন্তানের জন্য এই মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। শুজাতর অর্থ এখন সাহসী সাংবাদিকতার জন্য শহীদ। কাশ্মীর একজন সত্যিকারের পেশাদার সাংবাদিককে হারাল। একটি প্রতিষ্ঠান তার মস্তিষ্ককে হারাল। একটি পরিবার একজন সদস্যকে হারাল। আর আমার মতো অনেকে একজন সত্যিকারের বন্ধুকে হারাল। কোনও ক্ষমতা, কোনও কলমের জোরই এখন আর তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

আমরা শুধু দোয়া করতে পারি - সুজাতের আত্মা যেন জন্নতে স্থান পায়, আর তার হত্যাকারীরা নরকে পচে মরে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MAJID HYDERI MAJID HYDERI @majid_hyderi

The writer is a journalist based in Kashmir.

Comment