পড়ুয়ারা কেন ক্লাসে আসছে না সেটি না বুঝেই সমাধান করা অন্যায়
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজিরা, শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা, মানসিকতা
- Total Shares
ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে থাকবে কি থাকবে না, তা নিশ্চিত করতে শিক্ষা প্রশাসন যদি একেবারে কড়া আইন বা নিয়ম করে, তা হলে কয়েকটি অসুবিধা হলেও হতে পারে।
প্রথমত ছাত্রছাত্রীরা কেন আসছে না, কোনও বিশেষ ক্লাস করতে চাইছে না নাকি সামগ্রিক ভাবে পড়তেই চাইছে না, অর্থাৎ ক্লাসের পড়ার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ কমছে কেন? এই ব্যাপারটি বোঝার জন্য যে পদ্ধতিতে শিক্ষা চলছে সেই পদ্ধতির দিকে নিশ্চিত ভাবেই নজর দিতে হবে। সে দিকে নজর না দিয়ে, সেই ব্যাপারে দৃষ্টিপাত না করে আমরা যদি সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণীকক্ষে আসতে বাধ্য করি এবং বলি যে পরীক্ষা দিতে দেব না, তা হলে এটা হবে এক ধরনের অন্যায়।
পাঠ্যক্রম নির্ভর না হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনা হচ্ছে (উপস্থাপনামূলক ছবি)
এই অন্যায়ের কারণ হল, বাস্তব পরিস্থিতি নিশ্চিত ভাবে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসমুখী করছে না। এই বাস্তব পরিস্থিতি কী? প্রথমেই বলতে হবে পরীক্ষা ব্যবস্থার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়ম অনুযায়ী, যত দিন যাচ্ছে সর্বত্রই সেমেস্টার পদ্ধতি চালু হচ্ছে।
সেমেস্টার পদ্ধতিতে ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেন্ট বিশেষ ভাবে জরুরি। ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণীকক্ষের ভিতরে কেমন শুনছে পড়ছে এবং মোটামুটি ভাবে নিয়মিত আসছে কিনা তার উপরে নির্ভর করেই এই মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেন্ট যদি ‘জল মেশানো’ হয়, তা হলে মুশকিল।
‘জল মেশানো’ শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি একটি বিশেষ কারণে। যদি ছাত্রদের বলে দেওয়া হয় যে এই প্রশ্নটি আমি তোমাকে পরীক্ষার সময় করব, তা হলে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রকৃতপক্ষে সেমেস্টারের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি হল একটি নিয়মিত মূল্যায়ন পদ্ধতি, সেখানে কাউকে প্রশ্ন ও উত্তর মোটামুটি বলে দিয়ে ১০ নম্বরের মধ্যে ৮-৯ নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম, এটা নয়। আর ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো এসেছে কিনা সেটা দেখার চেয়েও বেশি করে লক্ষ্য করলাম, যেদিন শিক্ষক হিসাবে সম্ভাব্য প্রশ্ন বলে দিলাম বা তার উত্তর সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে দিলাম, সেই দিন ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ ও উপস্থিতি বেশি হল, অন্য দিনগুলিতে তারা এল না।
অর্থাৎ আমি এমন একটা ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছি যেটি অনৈতিক তো বটেই একই সঙ্গে যেটি শিক্ষানীতির বিরোধী। তা ছাড়া ইউজিসি যে কারণে সেমেস্টার পদ্ধতি চালু করতে চাইছে, এটি সেই পদ্ধতিরও পরিপন্থী।
আমার মনে হয় এ ই বিষয়গুলি শিক্ষা অধিকর্তারা জানেন না, দ্বিতীয় কথা তাঁদের কাছে যাঁরা খবর পাঠান তাঁরাও এই বিষয়ে ঠিকমতো নজর করেন না অথবা বলা যেতে পারে তাঁরা সেটি করার যোগ্য নন।
উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কড়া পদক্ষেপ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী (ইন্ডিয়া টুডে)
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে নোটস-কেন্দ্রিক পঠনপাঠন চালু হয়েছে। আগে নোটবই ছিল, এখন সেটিও নয়, ছোট ছোট প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে সেটাই অনেক বেশি জরুরি বলে মনে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের কাছে। একদিকে নম্বর বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং একই সঙ্গে কম পড়াশোনা করে বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে জেগে উঠেছে এবং এটি সামগ্রিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
জ্ঞান বাড়ানোর জন্য পড়ুয়ারা শিক্ষকদের কথা শুনবে, এই শিক্ষাসংস্কৃতির মাঝখানে সেটা হওয়া খুবই কঠিন। অর্থাৎ একদিকে শিক্ষকরা প্রশ্ন বলে দিলে ছাত্ররা বেশি থাকবে আর অন্যদিকে ভালো করে পড়ালে ছাত্ররা কম থাকবে। এই রকম একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ এই অবস্থার মধ্যে শিক্ষা পরিচালনার পদ্ধতির (যাকে শিক্ষাবিজ্ঞানে পেডাগগিক্যাল সিস্টেম বলা হয়) দুটি দিক। একটি দিক হল টিচিং অন্যটি হল টট। অর্থাৎ একদল শিক্ষক, যাঁরা শেখাচ্ছেন আর অন্যরা হল ছাত্র, যারা শিখছে।
যাঁরা শেখাচ্ছেন, তাঁরা কী শেখাচ্ছেন? একজন শিক্ষক যা শেখাচ্ছেন তা পাঠ্যক্রমনির্ভর না হয়ে তা যদি পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়, তা হলে ছাত্রছাত্রীদের জোর করে ক্লাস-মুখী করা যাবে না। তারা কলেজস্ট্রিটে গিয়ে দেখবে কোন বিষয়ের জন্য কোন নোটস রয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া যায় কোন নোটে বা বিজ্ঞাপনের ছলনায় আমাকে কোন বইটি আগ্রহী করে তুলেছে।
আমরা এখন এমন একটি পর্যায়ে এসে গেছি, যে ছেলেটি বা মেয়েটি প্রথম স্থান অধিকার করছে, সে একটি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে যে অমুক কোম্পানির বই পড়ে আমি প্রথম হয়েছি। তার মানে অনুক কোম্পানির বই পড়াই বেশি জরুরি, ক্লাসে পড়া নয়। এটা সমাজের মধ্যে চালু হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সামাজিক ক্ষেত্রে আমরা শিক্ষার অবনমন করছি।
এই জায়গাগুলোকে না দেখিয়ে হঠাৎ বলে দিলাম যে সবাইকে ক্লাসে আসতে হবে, তা না হলে দেখে নেব... অর্থাৎ পাহারার ব্যবস্থা করব। এটি শিক্ষার মূল ধারা থেকে বিচ্যুতি তো বটেই, এটা এক ধরনের অপরাদ বলে আমার মনে হয়, অন্যায় তো বটেই।
ছাত্রছাত্রীরা কেন শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে, সেই উত্তর খুঁজে বার করতে হবে (উপস্থাপনামূলক চিত্র)
তবে ছাত্রছাত্রীদেরও আমরা সমর্থন করছি না, তারা অনেকেই ক্লাস করছে না। অথচ মাস্টারমশাই কোনও একদিন যদি নোটস দেন তা হলে দেখা যাবে তার ব্যাগ থেকে খাতা বার হচ্ছে এবং ডটপেনে লিখতে লিখতে তার আঙুল ব্যথা হয়ে গেল অথবা রিফিল ফুটিয়ে গোল। এর অর্থ সে একেবারেই তৈরি নয়। তার ভিতরে নোটস পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং নোট লেখার ইচ্ছা এই দুইয়ের মধ্যে এক ধরনের বিপর্যয় দেখা যায়। দীর্ঘদিন পড়াচ্ছি বলে আমি এ কথা জানি।
দীর্ঘদিন পড়ানোর সুবাদে মাঝেমঝে মনে হয়, আমরাও তো পরাজিত সৈনিক, আমরাও তো হেরে যাচ্ছি, আমরাও তো মেনে নিচ্ছি এই পদ্ধতিটিকে। তাই একজনকে বা একমুখী ভাবে কাউকে দোষ না দিয়ে আমি বলব, সামগ্রিক ভাবে এই অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে গৌরব, সেই গৌরব রক্ষিত হয় শিক্ষক নিয়োগের স্বচ্ছতায়। যদি এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতাই না থাকে তা হলে কী ভাবে আশা করা যাবে যে একজন ভালো মাস্টারমশাই পাবে ছাত্রছাত্রীরা? ভালো মাস্টারমশাই না থাকলে কী করে আশা করবেন যে ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত ভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে?

