সিকিম-অরুণাচল-মেঘালয় কেন, উত্তরপূর্ব ভারতে বাঙালি পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে মণিপুরও

মণিপুরের কেবুল লামজো জাতীয় উদ্যান ও মোহময়ী লোকতাক হ্রদ যেন ভাসমান স্বর্গ

 |  5-minute read |   18-12-2018
  • Total Shares

দেশের উত্তরপূর্ব কোণ বলতেই আমাদেরর চোখে ভেসে ওঠে দার্জিলিঙের পাহাড়ি যৌবন। কাঞ্চনজঙ্ঘার মনভোলানো রূপ দেখতে আমরা সিকিমের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হাজির হয়ে থাকি। প্রতি বছর বহু পর্যটক ছুটি উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়েন। ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণে এসে নিজের রূপের শেষ অংশটুকু উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করেনি হিমালয়। তুষারশুভ্র চূড়ার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের পাশেই ঘন সবুজের অমোঘ হাতছানি। অসম-অরুণাচলপ্রদেশের সবুজ বনানী আর পাহাড়ের মেল বন্ধনে রহস্যের আমেজ। মেঘালয়ের বর্ষাঘন তন্বী মেঘের আকর্ষণে ভেসে গিয়েছিলেন স্বয়ং রবিঠাকুরও।

ভারতের পর্যটন মানচিত্রের উত্তর-পূর্ব অংশ বলতে বোঝায় প্রধানত দার্জিলিং, সিকিম, অসম, অরুণাচলপ্রদেশ, মেঘালয়; কয়েকটি ক্ষেতে ত্রিপুরাকেও জোর করে ঢোকানো হয় বটে। কিন্তু দেশের উত্তরপূর্ব কোণে এ ছাড়াও বহু জায়গা আছে সাধরণ ভাবে যেগুলো পর্যটকদের কাছে অতটা জনপ্রিয় নয় অথচ প্র্রকৃতি নিজের খেয়ালে সেখানে আপন হারা রূপের ডালি সাজিয়ে বসে আছে। বহু প্রত্যন্ত অঞ্চল, বহু জনপদ কুমারী অবস্থায় এখনো অপাপবিদ্ধ।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল পাহাড়-পর্বত, অরণ্য, উপত্যকা, প্রাকৃতিক হ্রদ, ভাসমান জাতীয় অভয়ারণ্য, নদী, গুহার বিবিধ প্রাকৃতিক বৈচিত্রের এক সমৃদ্ধ সমাহার। প্রচলিত বা গতানুগতিক ভ্রমণের সংজ্ঞা অতিক্রম করে যে ভ্রমণপিপাসু মন, উত্তর পূর্ব ভারতের আপাত আদিম অনাঘ্রাত প্রকৃতির কাছে এসে দাঁড়ায়, প্রকৃতি যথাসম্ভব উজাড় করে তার কাছে ধরা দেয়। মণিপুর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য অবশ্যই যে কোনও ভ্রমণকারীর বাকেট লিস্টে থাকা উচিৎ।

এই উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যতম সীমান্তবর্তী রাজ্য মণিপুর। চিত্রাঙ্গদার মণিপুর, সাবিত্রী হেইন্সামের মণিপুর, ইলম শর্মিলা চানুর মণিপুর, মেরি কমের মণিপুর! মহাভারত থেকে বর্তমানের সময় অবধি এই নামগুলোর সঙ্গে ভীষণভাবে পরিচিত। সেই সঙ্গে পাহাড়, গুহা, হ্রদ ও নদী – সব মিলিয়ে প্রকৃতির অক্লান্ত দানে ভরা মণিপুরকে একটি লুকানো মণি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

body_121818044737.jpg

body1_121818044747.jpg

body2_121818044757.jpg

body3_121818044809.jpg

body4_121818044827.jpg

body5_121818044858.jpg[ছবি: লেখক]

বহুদিনের মনের সুপ্ত বাসনা ছিল উত্তরপূর্ব ভারতের এই মাতৃতান্ত্রিক রাজ্যে ঘুরে আসার। কোনও দিকে না তাকিয়ে ইম্ফলের বিমানে চেপে বসেছিলাম। সঙ্গী আরও ১২ জন। বিমানবন্দরে আমাদের জন্য উইঙ্গার নিয়ে অপেক্ষা করছিল হাসিমুখে প্রীয়ম। ২৮ নভেম্বর ১০.৩০টা নাগাদ ইম্ফল থেকে কেবুল লামজো জাতীয় উদ্যানের দিকে রওনা দিলাম। ইম্ফল থেকে দূরত্ব ৪৫ কিমি, কম-বেশি দেড় ঘণ্টা মত সময় লাগে। পৃথিবীর একমাত্র 'ভাসমান' জাতীয় উদ্যান মণিপুরের শীর্ষস্থানীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম এবং বিপন্ন সাঙ্গাই হরিণের একমাত্র প্রাকৃতিক আবাস। পার্কটি ৪০ বর্গকিমি জুড়ে বিস্তৃত। এই জাতীয় উদ্যান পরিদর্শন করার সেরা সময় নভেম্বর ও এপ্রিলের মধ্যে।

ভাসমান উদ্যানের ভরাট সবুজ ঘাস, গাছের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া এবং এত সুন্দর যে সৌন্দর্যকে কাছ থেকে উপভোগ করার জন্য নৌকা যাত্রা না করে ফিরে ফিরে আসা যায় না। বিপন্ন ব্রো অ্যান্টলার্ড ডিয়ার বা সাঙ্গাই হরিণ বা নর্তক হরিণ এই অঞ্চলে আদি বাসিন্দা। মণিপুরী নৃত্যের উৎস হিসাবে এই নাচের হরিণের সূক্ষ্ম চলাফেরাকে অনুসরণ করা হয়। এখানে দেখা হরিণের অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে রয়েছে হগ হরিণ, সম্বর হরিণ ও মান্টজ্যাক। সবচেয়ে আদিম প্রাইমেটগুলির মধ্যে একটি, ধীরগতির লরিসটি পাহাড়ে বিক্ষিপ্ত পকেটে পাওয়া যায়। আসামিজ এবং স্ট্যাম্প-লেইড ম্যাকাক, এবং হোলক গিবন পশ্চিমের পাহাড়ে সীমায়িত। ভাসমান কেবুল লামজো ন্যাশনাল পার্কের নৌকার মাধ্যমে ভ্রমণ, স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে তার গল্প শোনা, এই বিষয়টি উপলব্ধি করে যে রাজ্যটি অনেক বেশি নিরাপদ। দেশের অনেক জঙ্গলে ঘুরেছি, থেকেছি, কিন্তু এই ভাসমান জাতীয় উদ্যানের কোনও বিকল্প নেই এবং এখানে ঘোরা জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি।

পরবর্তী গন্তব্য লোকতাক হ্রদ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মিষ্টি জলের হ্রদ পর্যটকদের বিস্মিত না করে পারে না। বছরের যে কোনও সময় আসা যায় এখানে। লোকতাক লেকটিতে ফুমদি বা ফুমশং নামে পরিচিত অনেকগুলি গোলাকার ভাসমান দ্বীপ রয়েছে যা অভিনব আর এক অসামান্য অনন্যতা দিয়েছে। এগুলির মধ্যে কয়েকটি ছোট পরিবার বাস করে এবং কয়েকটি পরিবার যথেষ্ট বড়। এই ছোট দ্বীপগুলির মধ্যে পরিবহণের সুস্পষ্ট মাধ্যম হল নৌকা।

হ্রদটিকে ক্ষুদ্র দ্বীপের সমুদ্র হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এই ফুমদি ঘাস, মাটি আর অন্যান্য জৈব উপাদানের মণ্ড যা লোকতাক হ্রদের ওপর ভেসে থাকে। এই আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক উদ্ভিদ গভীর জলের নীচে সঞ্চালিত হয় এবং এর মধ্যে মাত্র ২০% জলস্তরের উপরে দেখা যায়। এই ভাসমান দ্বীপগুলির আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল যে যখন জলস্তর নিচে চলে যায় তখন তারা হ্রদের ভুমি থেকে পুষ্টি শোষণ করে। গাছপালা এত পুরু এবং শক্তপোক্ত যে স্থানীয়রা তাদের উপর তাদের ঘর নির্মাণ করেছে। পরিযায়ী পাখিদের জন্য এই হ্রদ শীতকালে আদর্শ আবাসস্থল।

এই হ্রদকে কেন্দ্র করে বহু মৎস্যজীবী দিন গুজরান করে থাকেন। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে যখন ধীরে ধীরে জেগে ওঠে, নৌকা বয়ে যাওয়া একাকী মাঝি তখন নিসর্গচিত্র হয়ে সারাজীবনের জন্য মনের কোণে ঠাঁই করে নেয়। বিকেলে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় অপরূপা লোকতাক আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। সমস্ত লাল আভা গায়ে মেখে নিয়ে সুন্দরী লোকতাক তখন পাহাড়ের কোলে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকে, আর একের পর এক ডিঙি নৌকার মাঝিরা ঘরে ফেরার গান গায়। কোনও স্থানকে নিবিড় ভাবে অনুভব গেলে তার সঙ্গে কিছু একান্ত মুহূর্ত কাটাতে হয়। লোকতাক হ্রদের পাশে সম্ভ্রান্ত এক রিসর্ট সে পথও খুলে দিয়েছে। কটেজের জানলায় দাঁড়ালে সামনে উন্মুক্ত লোকতাক তার সমস্ত সৌন্দর্য উজাড় করে দেয় সবার কাছে। সেই নিবিড় নিভৃত নিসর্গ ছাড়া আর যা কিছু সব যেন গৌণ। দেশের প্রথম তিনটি মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য স্থান নির্বাচন করতে হলে লোকতাক হ্রদ আর এই রিসোর্ট অবশ্যই থাকবে।

প্রয়োজনীয় তথ্য: 

• ইম্ফল থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে কেবুল লামজো জাতীয় উদ্যান ও লোকতাক হ্রদ। সময় লাগে কম বেশি দেড় ঘণ্টা মতো।

• পুরো জায়গা প্লাস্টিক মুক্ত। তাই উপত্যকার কোথাও প্লাস্টিকের জিনিস ফেলবেন না। আবর্জনা নির্দিষ্ট জায়গাতেই ফেলুন।

• লোকতাক বিষ্ণুপুর জেলায়। লোকতাক থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে বৃহত্তম শহর মইরাং অবস্থিত। এখানে থাকার সুবন্দোবস্ত আছে। মণিপুরের প্রথম মৈতেয়ি লোক সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি।

• মইরাংয়ের গুরুত্ব ভারতীয় স্বাধীনতা ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে সবসময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৪ সালের ১৪ই এপ্রিল কর্নেল শওকত মালিকের ভারতের মাটিতে এই মইরাংয়ে প্রথমবার তিরঙ্গা উত্তোলিত হয়। আজাদ হিন্দ বাহিনীর দফতর ছিল এখানে। শতাধিক বছরের সেই প্রাচীন বাড়ি আজও ইতিহাসের নানা সাক্ষ্য নীরবে বহন করে চলেছে। এই মইরাং-এই অবস্থিত আইএনএ ওয়ীর মিউজিয়াম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য, দলিল-দস্তাবেজ, অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও অসংখ্য স্মারক চিত্র এই সংগ্রহালয়ে সযত্নে সংরক্ষিত আছে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUDIPTA PAUL SUDIPTA PAUL

The writer is an ardent traveller and travel photographer.

Comment