বঙ্গোপসাগরের মাঝে সেদিন কে আমাদের সতর্ক করায় বেঁচেছিলাম দুর্ঘটনা থেকে
এক ফোঁটাও হাওয়া নেই, অথচ ব্রিজের দরজাটা নিজেই সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল
- Total Shares
বাবা হরভজন সিংয়ের কথা অনেকেই জানেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান যিনি নাকি মৃত্যুর পরেও সিকিমের নাথুলার ভারত-চিন সীমান্ত পাহারা দিয়ে চলেছেন। কথিত আছে, চিন যদি সীমান্ত আক্রমণের চেষ্টা করেন তাহলে বাবা হরভজন তিন দিন আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দেন।
আমার জীবনেও এই ধরণের একজনের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁকে আমি চিনি না। ব্যাপারটা অলৌকিক কিনা জানিনা। কিন্তু কেন যেন মনে হয় সেদিন কোনও এক অশরীরী আত্মা এসে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল। তা না করলে চাকরি তো যেতই। মৃত্যুও হতে পারত।
২০০৮ সালের ঘটনা। তবে সিকিমের পাহাড়ে নয়, বঙ্গপোসাগরের মাঝ সমুদ্রে। সেই সময় আমি এম ভি এপিজে শ্রীদেবীতে কর্মরত। হলদিয়া পারাদ্বীপ কিংবা বিশাখাপত্তনম থেকে আমরা পেট্রোলিয়াম কয়লা নিয়ে যেতাম এন্নোরে। এই এন্নোর বন্দরটি চেন্নাই থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থিত।
সেদিন প্রায় ৬৫,০০০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে আমরা বঙ্গোপসাগরে উপরে। পারাদ্বীপ থেকে এন্নোর যাচ্ছিলাম। রাতের বেলা। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমি আর সিনিয়র সহকর্মী সৌরভ বসু ব্রিজে বসে ওই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেই পথ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের সামনে যেন কোনও ছোট নৌকা বা ট্রলার জাতীয় কিছু এসে না পড়ে সেহি চেষ্টাই করছিলাম। এখানে বলে রাখা প্ৰয়োজন, বিমানে আমরা যেটাকে ককপিট বলি জাহাজে তাকেই ব্রিজ বলা হয়ে থাকে।
জেলেদের ট্রেলার বা নৌকোগুলো কোনও আইনকানুন মানে না [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
আমাদের কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। কারণ পারাদ্বীপ বা বিশাখাপত্তনমের উপকূল সংলগ্ন বঙ্গপোসাগরে মাছ ধরার নৌকো বা ট্রেলারদের আধিপত্য। রাতের বেলায় জেলেরা এই নৌকো বা ট্রেলারে চেপে মাছ ধরতে বেরোয়। দূর থেকে যাতে বোঝা যায় তার জন্য একটি মাত্র টিমটিমে আলো নৌকো বা ট্রেলারের মাথায় ঝুলিয়ে রাখে।
অভিজ্ঞতা না থাকলে জেলেদের এই নৌকো বা ট্রলারের সারির মধ্যে দিয়ে পথ বের করে নেওয়াটা বেশ বিপজ্জনক। এদের আচরণ অনেকটা কলকাতার রাস্তার অটোগুলোর মতো। আইন কানুন প্রায় মানে না বললেই চলে।কিন্তু ধাক্কা লেগে গেলে তার খেসারত গুনতে বড় জাহাজের নাবিকদেরই। মোটা টাকা জরিমানা তো হবেই। হাজতবাসও হতে পারে।
মূল গল্পে আবার ফিরে আসি।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক এই নৌকো ও ট্রেলারের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চালিয়ে তখন আমরা উপকূল থেকে অনেকটাই মাঝ সমুদ্র চলে এসেছি। সেদিন প্রচন্ড গরম ছিল। তার উপর আমাদের ব্রিজের শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ঠিক মতো কাজ করছিল না। ব্রিজের দরজা খুলে রেখেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আমরা দু'জনেই ঠিক করলাম চার্টরুমে গিয়ে একটু কফি পান করে নেওয়া যাক। প্রতিটি জাহাজে একটি করে ঘর থাকে যেখানে নাবিকরা মূলত রুট ম্যাপ তৈরি করে। এই ঘরটিকে চার্ট রুম বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে চার্ট রুমে আমরা আড্ডাও মারি।
যাই হোক, এই ফাঁকে শিক্ষার্থীদের আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই। সেদিন আমি আর সৌরভ বসু দু'জনেই একসঙ্গে ব্রিগ ছেড়ে চার্টরুমে চলে এসেছিলাম। মাঝ সমুদ্রেও জাহাজ থাকলে এই কাজটি কোনও দিনও করা উচিত নয়। খেয়াল রাখা দরকার অন্তত একজন যেন সর্বদাই ব্রিজে থাকে।
সেদিন দু'জনেই ব্রিজ ছেড়ে চার্টরুমে গিয়ে বড় ভুল করেছিলাম [ছবি: রয়টার্স]
আর, এই ভুলের মাশুল সেদিন আমরা প্রায় দিয়েই ফেলেছিলাম। একেবারে শেষ মুহূর্তে ভয়াবহ বিপদ এড়ানো গিয়েছিল সেদিন। এড়ানো যেত যদি না সেদিন কেউ বাবা হরভজনের মতো এসে আমাদের সতর্ক করতেন।
সেদিন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম দু'জনে। আড্ডা দিতে গিয়ে সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হটাৎ করে একটা জোর শব্দে আমাদের সংজ্ঞা ফিরল। আওয়াজ শুনে দু'জনেই বুঝতে পারলাম ব্রিজের একদিকের দরজার শব্দ। দু'জনেই আন্দাজ করলাম যে খোলা দরজাটা খুব জোরে ধাক্কা মেরে বন্ধ হয়ে গেল। আজ স্বীকার করে নিচ্ছি প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। আতঙ্কের কারণ যথেষ্ট ছিল। বাইরে এক ফোটাও হাওয়া নেই। দমকা বাতাস কী ভাবে দরজাটা বন্ধ করে দিল? তাহলে কি অন্য কিছু?
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ব্রিজের দিকে দৌড় লাগলাম দু'জনে। গিয়ে দেখি, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে। ব্রিজের এক দিকের দরজা বন্ধ। ব্রিজে প্রবেশ করেই চক্ষু চড়কগাছ। আমাদের সন্নিকটে একটি ট্রলার। কোনও রকমে আপৎকালীন ব্যবস্থা নিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে জাহাজের মুখ ঘোরাতে পেরেছিলাম সেদিন। না পারলে সেদিন কিন্তু বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যেত পারত।
দশ বছর পরেও ঘটনাটি লিখতে বসে আমার মনের মধ্যে একটা শিহরণ বয়ে চলেছে। সে দিন আমরা আড্ডাতে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে সেই সময়ে ব্রিজে যেতাম না যদি না সেই আওয়াজটা হত। আওয়াজটা করল কে? আজও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছি। সৌরভ বসুও খুঁজে চলেছেন। হয়ত, এই প্রশ্নের উত্তর কোনও দিনও পাব না।
শুধু এই টুকুই জানা থাকবে, সেদিন বঙ্গোপসাগরের মাঝ সমুদ্রে কেউ একজন এসে আমাদের সতর্ক করেছিলেন। কেউ একজন এসে আমাদের চাকরি এমনকি জীবন রক্ষা করেছিল। একটি নিশ্চিত দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই দিয়েছিলেন।
ধন্যবাদ জ্ঞাপনেরও ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা।