কবে ও কেন বন্ধ হয়ে যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো?
বালক দেবেন্দ্রনাথ নিমমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়কে
- Total Shares
সেকালের প্রায় সব জমিদারই বাড়িতে দুর্গা পুজো করতেন। সেই জমিদারি তো ঘুচেছে কবেই, জমিদাররাও নেই বহুকাল। কিন্তু তাঁদের বাড়িঘরদোর রয়ে গিয়েছে। বাড়ির পুজোটাকেও বাঁচিয়ে রেখেছেন সাবেক সেই জমিদারদের উত্তরপুরুষরা।
শহর কলকাতায় তেমন বনেদি বাড়ি খুব কম নেই। তবে এককালে বাড়িগুলির যে চাকচিক্য বা জৌলুস ছিল তা জমিদারি খোয়ানোর পরপরই তা মিইয়ে যেতে থাকে। অর্থনৈতিক ভাবে অনেক পরিবারগুলি দুর্বল হয়ে পড়লেও জমিদারের রক্ত বলে ঠাটবাট বজায় রাখার রেওয়াজটা রয়েই গিয়েছে। সে কারণে যে ভাবেই হোক না কেন বাপ-ঠাকুর্দার আমলের দুর্গা পুজোটা কিছুতেই বন্ধ হয়ে যেতে দেয়নি।
দাঁ বাড়ির পুজোকে টেক্কা দিয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ (ফাইল ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
অনেক পরিবারের অবস্থা এখন চাকরি ব্যবসার দৌলতে বেশ ভাল। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সদস্যরা পুজোর সময় যূথবদ্ধ হন, ফলে পুজোটা জাঁকজমকপূর্ণ হয়।
সেকালের সেরা পরিবার
বৃষ্টির কাল ফুরোতেই শরতের আকাশে সাদা তুলো মেঘ ভেসে বেড়াতে শুরু করে। ভোরবেলায় শিশির ভেজা শিউলির গন্ধ কংক্রিটের শহরে থেকেও কিছুটা হলেও অনুভব করা যায়। কাশফুলেরও দেখা মেলে কোথাও কোথাও। আর এরকম একটা বাতাবরণ থেকেই বোঝা যায় শারদোৎসব ঘরের দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে।
কয়েকশো বছর আগে শুরু হওয়া বাঙালির দুর্গোৎসবের সাবেকিয়ানা সময়ের পালাবদলে পালটে গিয়েছে অনেকটাই। বনেদি বাড়ির পুজোগুলিতেও হুবহু একই রকমটা না থাকলেও আমেজটা রয়ে গিয়েছে; অবশ্যই তা পরিবারের মধ্যে।
বাঙালির অতীতের দুর্গোৎসবের চর্চায় যে সব পরিবারের কথা একদম গোড়াতেই বলতে হয় তার মধ্যে অবশ্যই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো অন্যতম।
আজও চর্চার বিষয়
ঠাকুরবাড়ি মানে কেবলমাত্র একটি জমিদার বা বনেদি বাড়ি নয়, এই বাড়ির ইট-চুন-সুরকির গাঁথনির পরতে পরতে মিশে আছে প্রতিভা, কীর্তি, খ্যাতি, সাফল্য এবং ঐতিহ্য। বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ওই বাড়ির ভূমিকা আজ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ঊনিশ শতকের নবজাগরণেও ঠাকুর বাড়ির অবদান অস্বীকার করা যায় না।
বাংলা ও বাঙালির চিরাচরিত জীবনধারাতে বিশেষ করে প্রাচীন সমাজের গতানুগতিক রীতিনীতি বদলের ক্ষেত্রে ওই বাড়ি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এ ধরণের বহুবিধ কারণেই ঠাকুরবাড়ি ঘিরে তৎকালীন বাংলায় যেমন উৎসাহের অন্ত ছিল না, তেমনই নিজস্ব পরিচয় এবং বিশিষ্টতা নিয়ে ছিল স্বতন্ত্র।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দালান (উইকিমিডিয়া কমনস)
আজ কৌতূহলের কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই; সে কথাও বলা যাবে না, কারণ ঠাকুরবাড়ির প্রতিভা, কীর্তি, খ্যাতি, সাফল্য এবং ঐতিহ্য নিয়ে আজও চর্চার শেষ নেই, গবেষকরা ওই পরিবারের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে এখনও গবেষণা করছেন।
যশোহরের কুশারী থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি
ঠাকুরবাড়ির স্বতন্ত্রতার একটি অন্যতম কারণ হল তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্ম। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। ধর্মীয় ভাবনায় তাঁরা পৌত্তলিকতা বা মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন না। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তা হলে সেই বাড়িতে দুর্গা পুজো হত কি ভাবে আর তা বন্ধই বা হল কবে থেকে?
ব্রাহ্ম বা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিধিপূর্ব উপাসনার পরিবর্তে কী ভাবে মূর্তি পুজোর মাধ্যমে মাতৃশক্তির আরাধনা করতেন, এটা বুঝতে ঠাকুর বাড়ির পারিবারিক ইতিহাসের প্রথম দিককার প্রসঙ্গ এসেই যায়।
যতদূর জানা যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলায় এবং তাঁদের পদবি ছিল কুশারী। জাতি বা বর্ণ অনুযায়ী সমাজে কুশারীরা হলেন ব্রাহ্মণ। যশোহর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে সাত পুরুষ আগের পঞ্চানন কুশারী। যশোহর থেকে কলকাতা শহরে এসে ব্রাহ্মণ পঞ্চানন কুশারী তৎকালীন সুতানুটি অঞ্চলে গঙ্গার ঘাটে ব্যবসায়ীদের পুজোঅর্চা করতেন। আর সে কারণেই লোকে তাঁকে ঠাকুরমশাই বলে ডাকতে শুরু করে। ক্রমে তিনি পঞ্চানন কুশারীর থেকেও পঞ্চানন ঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে তাঁর ও উত্তরসূরীদের পদবী হয়ে যায় ঠাকুর।
পৌরোহিত্য এবং অন্যান্য কাজ করেই একদিন যশোর থেকে আসা পঞ্চানন ও পরবর্তী প্রজন্ম এই শহরে বেশ কিছু সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠেন। একটা সময় পঞ্চানন ঠাকুরের দুই নাতি নীলমণি ঠাকুর এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরের মধ্যে সেই বিষয়সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ লেগেই থাকত।
বিবাদ একদিন এমন জায়গায় গিয়ে পৌছায় যার জেরে নীলমণিঠাকুর ঠাকুর বংশের গৃহদেবতা লক্ষ্মী এবং শালগ্রাম শিলা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তী কালে তিনি কলকাতার মেছুয়াবাজার অর্থাৎ আজকের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক সুবিশাল বাড়ি নির্মাণ করেন। নীলমণিঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পত্তন যেমন করেছিলেন সেই সঙ্গে তিনি ঠাকুরপরিবারে দুর্গাপুজোরও সুচনা করেছিলেন। তবে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো রাজকীয় আকার ধারণ করেছিল নীলমণি ঠাকুরের নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের হাত ধরেই।
দেবী বন্দনায় ঠাকুরবাড়ি
ইতিমধ্যে ঠাকুর পরিবার কলকাতা শহরে বিপুল অর্থ ও সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠায় তাঁদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। যার পূর্ণ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর আড়ম্বড়ে। সেকালের কলকাতার যে কোনও জমিদার বা বনেদি পরিবারের দুর্গা পুজোকে টেক্কা দিতে পারত ঠাকুর পরিবারের পুজো। বিশাল বাড়ির প্রকাণ্ড খোলা ঠাকুরদালানে হত মাতৃ আরাধনার আয়োজন। উল্টোরথের দিন ঠাকুরবাড়ির প্রতিমা গড়ার মাটি আসত গঙ্গার পাড় থেকে। কাঠামো পুজো সারা হলে সেই কাঠামোয় মাটির প্রলেপ পড়ত। মূর্তি শিল্পী সমস্ত নিয়ম মেনে শুদ্ধাচেরে প্রলেপের পর প্রলেপ চড়িয়ে দেবী দুর্গার অবয়ব ফুটিয়ে তুলতেন। প্রকাণ্ড ঠাকুরদালানে প্রতিমা নির্মাণের কাজ হত পর্দার আড়ালে। ঠাকুরবাড়ির দেবী দুর্গার বৈশিষ্ট্য ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতির একচালার মূর্তি। তবে বিশেষ গুরুত্ব পেত প্রতিমার মুখের আদল।
প্রিন্স দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরীদেবী ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী এক নারী, কথিত আছে তাঁর আমলে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর মূর্তি দিগম্বরীদেবীর মুখের আদলে তৈরি করা হত। কেবলমাত্র দেবীর মুখাবয়ব নয়, পুজোর দিনগুলিতে মূর্তিকে দু’বেলা বেনারসী শাড়ি বদল করে পরানো হত, আবার কখনও পরানো হত দামি তসর কিংবা গরদের শাড়ি। প্রতিমায় পরানো হত প্রচুর সোনার গয়না, মাথায় সোনার মুকুট থেকে কোমরে চন্দ্রহার সবই প্রতিমার গায়ে শোভা পেত।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর ভোগও ছিল বলার মতো। এবেলা ওবেলা দু’বেলাই অন্ন থেকে মিষ্টান্ন সব মিলিয়ে একান্ন রকমের পদ দুর্গার ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হত। সঙ্গে থাকত নানা রকমের ফল, ডাবের জল প্রভৃতি। সেগুলো পরে ঠাকুরবাড়ির পুজোর দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হত।
রাজকীয় জাঁকজমকের পুজো
ঠাকুরবাড়ির দুর্গা পুজোর আয়োজন ও আড়ম্বর যেমন রাজকীয় ছিল পুজোয় পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন জামাকাপড় ও উপহারের ক্ষেত্রেও গৃহকর্তারা ছিলেন খুবই দরাজ। বিশেষ করে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বাড়ির ছেলেমেয়েদের প্রতিবছর পুজোয় দামি দামি পোশাক উপহার দিতেন।
পুজোর তিনমাস আগেই দক্ষিণের বারান্দায় দেখা যেত নানা মানুষের ভিড়। জুতোর মাপ নিয়ে যেত চিনাম্যান। কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে হাজির হত দর্জি। তার কাছেই জামার মাপ দিতে হত। ছেলেদের জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ ছিল চাপকান, জরি দেওয়া টুপি আর রেশমি রুমাল।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমলেই বন্ধ হয় ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো
আসতেন আতরওয়ালাও। তাঁর কাছে ছোটরা পেত এক শিশি করে আতর। বাড়ির মহিলামহলে আসতেন তাঁতিনীরা। তাঁরা নিয়ে আসতেন নীলাম্বরী, গঙ্গাযমুনা— এমন কত রকমের শাড়ি।
পুজোর কদিন মহিলারা দিনে পরতেন সোনার গয়না, রাতে জড়োয়া। দ্বারকানাথের কাছ থেকে প্রত্যেক পুজোতেই ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউ উপহার পেতেন এক শিশি দামী সুগন্ধী, খোঁপায় দেওয়ার সোনা বা রুপোর ফুল, কাচের চুড়ি আর নতুন বই। প্রিন্স দ্বারকানাথ পার্বণী দেওয়ার ব্যাপারে খুব দরাজ ছিলেন। বাড়ির দুর্গাপুজোয় আত্মীয়স্বজন, ভৃত্য-কর্মচারীরাও তাঁর কাছ থেকে পেতেন নতুন জামাকাপড় ও উপহার।
সোনার গয়না সমেত প্রতিমা ভাসান
রাজকীয় বৈভবে পুজো শেষ হত নবমীর রাতে। পরের দিন দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন। গঙ্গায় ঠাকুরবাড়ির প্রতিমা বিসর্জনও হত মহাধূমধাম করে। প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা ছিল নজরকাড়া। শোভাযাত্রায় ঢাকি ছাড়াও থাকতেন নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্রী, তাঁদের পাশাপাশি গ্যাসবাতি নিয়ে পথ চলতেন বেশ কয়েকজন। ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরবাসিনীরাও বিসর্জনে যেতেন গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত, তাঁরা যেতেন দরজা বন্ধ করা পাল্কিতে।
কথিত আছে ঠাকুরবাড়ির প্রতিবেশী শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে প্রতিমার গায়ে শোভা পেত বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না। প্রতি বছর দ্বারকানাথের বাড়ির সামনে দিয়েই গা-ভর্তি গয়না পরে দাঁ বাড়ির প্রতিমা যেত বিসর্জনে। তখন একটি প্রবাদও চালু ছিল, মা নাকি কৈলাস থেকে মর্তে এসে শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে গয়না পরতে আসেন। যদিও সে গয়না ভাসানের আগেই খুলে নেওয়া হত। তবু এতে দ্বারকানাথ ভাবলেন তাঁর আয়োজনে কোথাও যেন একটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তাই মনে মনে ঠিক করলেন, এর যোগ্য জবাব দেবেন। তিনিও প্যারিস থেকে বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না আনিয়ে তা প্রতিমাকে পরালেন। আর আভিজাত্যের লড়াইটা জিততে দ্বারকানাথের নির্দেশে সেই সব বহুমূল্য গয়না সমেতই দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিমা ভাসানের পর ঠাকুরবাড়িতেও স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে হত বিজয়া সম্মিলনী। সেই উপলক্ষে খোলা ঠাকুরদালানে হত জলসা। নাচ, গান, নাটক এবং অন্যান্য আমোদপ্রমোদ চলত মহাসমারোহে। সেকালের নামকরা ওস্তাদরা তাঁদের গানে মাত করে দিতেন আমন্ত্রিত অতিথিদের। ঝাড়বাতির নীচে চলত বিজয়ার রাজসিক খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখ, গোলাপজল, আতর, পান আর কোলাকুলি।
থেমে গেল ঢাকের বাদ্যি
তখনকার সমাজের বিশিষ্টজনেরা ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসবে আমন্ত্রণ পেতেন। আমন্ত্রণপত্র লেখা হত দ্বারকানাথের পিতা রামমণি ঠাকুরের নামে। উল্লেখ্য, ১৮৩৮ সালে ১২ বছরের বালক দেবেন্দ্রনাথ তাঁর বাবার বন্ধু রাজা রামমোহন রায়কে ঠাকুরবাড়ির দুর্গা পুজোয় আমন্ত্রণ জানাতে হাজির হয়েছিলেন নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে। বালক দেবেন্দ্র রামমোহনকে বলেন, ‘সামনে পুজো তাই তিনদিনই প্রতিমাদর্শনে আপনার নিমন্ত্রণ, পত্রে দাদুর এই অনুরোধ’। ব্রাহ্ম রামমোহন রায় প্রতিমাপুজোয় যার একেবারেই বিশ্বাস বা আস্থা নেই তিনি এই আমন্ত্রণে খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। যদিও বন্ধু দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে তিনি খুব স্নেহ করতেন তাই নিমন্ত্রণপত্রটি প্রত্যাখ্যান করেননি আবার সরাসরি সেটা গ্রহণও করেননি, তিনি তাঁর ছেলে রাধাপ্রসাদের কাছে দেবেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
রাধাপ্রসাদ পিতার হয়ে সেটা গ্রহণ করে দেবেন্দ্রনাথকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিয়েছিলেন। এরই আট বছর পর তরুণ দেবেন্দ্রনাথই উপনিষদের প্রথম শ্লোকের অর্থের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞান খুঁজে পেয়েছিলেন। পিতার বন্ধু রামমোহনের একেশ্বরবাদ মতবাদ সম্পর্কে তখন তিনি অবগত।
পরের বছরই সহকর্মীদের নিয়ে একেশ্বরবাদ চর্চার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুললেন ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’। ওই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে তত্ত্বরঞ্জিনী নাম পাল্টে হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ সভা। দু’বছর যেতে না যেতেই সেই সভার সঙ্গে যুক্ত হল ‘ব্রহ্মসভা’। ওই সভার দায়িত্ব নিয়ে পঁচিশ বছরের তরুণ দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মকে দীক্ষার ধর্মে রূপায়িত করে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করলেন।
দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরেই ঠাকুরবাড়ি ধীরে ধীরে ‘ব্রাহ্ম’ বলে পরিচয় লাভ করল। পৌত্তলিকতার ঠাঁই নেই যে ধর্মে সেখানে দুর্গাপুজো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে বাধ্য। যদিও সে বছরই পুজো বন্ধ হয়নি কারণ, পরিবারের অনেকেই তা মানতে চাননি। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ পুজোতে কখনোই যোগ দেননি। ওই সময় তিনি হিমালয় ভ্রমণে যেতেন।
বিসর্জন: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা চিত্র
মাত্র দু’বছর পরই ঠাকুরবাড়ির পুজো চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই নয়, দুর্গাপুজো হত পাথুরিয়াঘাটার সঙ্গীতপ্রিয় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের পরিবারে, ধুমধাম করে পুজো হত কয়লাঘাটার রমানাথ ঠাকুরের বাড়িতেও, তেমনই দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের বাড়িতে পুজো হত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছাড়াও ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য বাড়িগুলিতেও পুজো বন্ধ হয়েছে অনেককাল আগে।
ঋণ-অনুপূর্বা রায়, বিভূতি ভট্টাচার্য