অনেক খবরই ছাপে না সংবাদপত্র, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই খবর ভাইরাল হয়

সোশ্যাল মিডিয়া সত্ত্বেও কেন গুরুত্ব হারাচ্ছে না মূলধারার সংবাদমাধ্যম

 |  6-minute read |   24-12-2018
  • Total Shares

সংবাদমাধ্যম তার নীতি মেনে অনেক খবরই প্রকাশ করে না, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে খবর প্রকাশ করে না তা হল শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে এমন খবর। সোজা কথায় দাঙ্গা লাগতে পারে এমন কিছু। এর কারণ নিহিত আছে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মধ্যে। মূলধারার সাংবাদিকদের নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠতে পারে, যেমন সাংবাদিকতা হিসাবে নিরপেক্ষতা আগে নাকি দেশপ্রেম আগে। তবে এর বাইরেও এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটে যা আপাত ভাবে প্রকাশ না করার কোনও কারণ নেই, তবুও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সেই খবর প্রকাশ করা হয় না কিছুটা অস্বস্তি এড়াতেই।

এখন হাতে হাতে স্মার্টফোন, সেখানে খবরের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হল ফেসবুক-টুইটার। অর্থাৎ আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রধানের টুইটার ফলো করলেই খবরটা পেয়ে যাব। এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের টুইটার হ্যান্ডেল তো আছেই। তা হলে আর মূলধারার সংবাদমাধ্যম, মানে টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলি কী বলল তাতে কী যায় আসে!

jbody1_122418081203.jpg

অবশ্যই যায়-আসে। তার কারণ সাংবাদিকরা যে সব ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করেন সেই সব ক্ষেত্রের অন্দরে কী ঘটছে সেই প্রেক্ষিত দেওয়া থাকে সংবাদে, একই সঙ্গে একই ধরনের ঘটনার অবতারণাও থাকে, যার ফলে কোনও ঘটনার বিশ্লেষণ অনেক বেশি প্রাঞ্জল হয়। তা ছাড়া মূলধারার সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব রয়েছে সঠিক সংবাদ পরিবেষণ করার, তাই খবর যাচাই করে তবেই তাঁরা সেটি প্রকাশ করেন। সেখানে গুজব ঠাঁই পায় না। গণেশের দুধ খাওয়া গোছের খবর থাকলেও তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও থাকে।

কয়েকদিন আগে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক গ্রেপ্তার হওয়ার পরে আরেকটি সংবাদমাধ্যমের প্রধান ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সেই খবরটি কোনও সংবাদপত্র প্রকাশ করবে না, নাম-ছবি দিয়ে তো নয়ই। সোশ্যালমিডিয়ার লাইভ-এ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী আংশিক ভাবে মিলেছিল। একটা কথা বলে রাখা দরকার, সেই সাংবাদিকও গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং দু’টি ক্ষেত্রেই একটি বড় মিল হল, দু’টির নেপথ্যেই ছিল পনজি স্কিম, যাকে সাধারণ ভাবে চিটফান্ড বলা হয়ে থাকে (যদিও চিটফান্ড বৈধ এবং যে আর্থিক সংস্থার ব্যাপারে তাঁদের নাম জড়িয়েছিল সেগুলি চিটফান্ড ছিল না, সেগুলি ছিল বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা)।

একটি খবর সংবাদমাধ্যমে যে ভাবে প্রকাশ করেছিল, আরেকটি সংবাদ সে ভাবে প্রকাশিত হয়নি। কেন প্রকাশিত হয়নি? এর একটি বড় কারণ হল প্রথমজন শুধুমাত্র সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। অন্তত স্মরণকালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কোনও আর্থিক প্রতারণ সংস্থায় যোগের অভিযোগে কোনও সাংসদ-বিধায়ককে গ্রেফতার হতে দেখা যায়নি, তিনি সাংসদ থাকাকালীন গ্রেফতার হয়েছিলেন (দোষী কিনা এখনও প্রমাণিত নয়)। এ রাজ্যে আরও একজন আরও একজন সাংসদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল যিনি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকও বটে, তবে সেই সংবাদও সে ভাবে প্রকাশ করা হয়নি, কারণ সেই ব্যক্তির রাজনৈতিক যোগ থাকলেও আদতে তিনি শিল্পপতি এবং যতদূর জানা যায়, এই ধরনের সংস্থার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ রুচি ছিল না, ঘটনাচক্রে তাঁর নাম জড়িয়েছিল।

দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু হয় মি-টু নিয়ে, যখন এটি ঘটে তখন তিনি মন্ত্রী। সেই খবরও প্রকাশিত হয়েছিল, কারণ তিনি শুধু প্রাক্তন সাংবাদিক নন, মন্ত্রীও বটে। তাঁর নীতিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি স্বচ্ছ্ব ও প্রশ্নাতীত হওয়া দরকার।

jj_122418081231.jpg

সাম্প্রতিক অতীতে একটি লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছিল। সেটি মূলধারার কোনও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। সেই ঘটনার কিছুদিন পরে এক সাংবাদিক তাঁর স্কুলের সময়ের বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজন করছিলেন, সেই প্রাক্তন সহপাঠীদের বেশিরভাগই বিজ্ঞান অথবা সফটওয়্যার নিয়ে পড়াশোনা করে চাকরি অথবা ব্যবসা করছেন, কয়েকজন আবার বিদেশে থাকেন, দু’জন বিদেশি নাগরিকও বটে। তাঁরা কেউ সাংবাদিক নন। সেখানে মজা করেই সাংবাদিক বন্ধুকে বলা হয়, তিনি যেন চামচ চুরি না করেন। ব্যাপারটা নিখাদ মজা হলেও খোঁচাটা লেগেছিল সেই সাংবাদিকের।

ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বিদেশে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের একজন সরকারি আমন্ত্রণে একটি ভোজসভায় গিয়ে রুপোর চামচ পকেটে পুরেছিলেন। হতে পারে তাঁর হাতটান স্বভাব আছে (criptomania), কিন্তু সেই ঘটনা মোটেই সাংবাদিকতাকে গৌরবান্বিত করেনি, উল্টে কলঙ্কিত করেছিল। জরিমানা করা হয় সেই সাংবাদিককে।

দেশে যখন জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল তখন অনেক সাংবাদিককেই গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেই গ্রেফতারি ছিল গৌরবের। রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ব্যবহার করে প্রতিবাদ করার জন্য গ্রেফতার হওয়াকে জেলখাটা বলা হয় না, তাকে বলা হয় কারাবরণ করা। কিন্তু বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া মোটেই গৌরবের নয়।

এ বার আসা যাক কোন খবর প্রকাশ করা হবে এবং কোনটি হবে না, কেন।

আইন যেমন আছে তার বাইরে নীতি বলেও একটি বিষয় আছে। সংবাদমাধ্যমে আইনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট নীতিও মানা হয়। সেই নীতির জন্যই কোনও কোনও সংবাদ প্রকাশ করা হয় না। যেমন কাক কাকের মাংস খায় না বলেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করা হয় না, কিন্তু তিনি সাংবাদিকতা পেশার বাইরে বিশেষ করে রাজনীতি করলে সেই সংবাদ শিরোনামে এসে থাকে।

এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, সারদা রিয়েলটি ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু তাঁদের নামে ফলাও করে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ করা হচ্ছে না তার গুরুত্ব নেই বলেই। পুলিশ তো বটেই, সিবিআই-ও প্রতিদিন অনেককে গ্রেফতার করে, জেরা করে, সে সব নিয়ে খবর হয় না, গুরুত্ব নেই বলেই।

তবে আর পাঁচটি পেশার সঙ্গে সাংবাদিকতার পার্থক্য রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের কাছে পাঠক ও দর্শকরা নিরপেক্ষতা আশা করেন। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যদি তাঁদের মনে বদ্ধমূল ধারনা হয় যে সংবাদমাধ্যম কোনও একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করছে তা হলে সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমবে এবং সাংবাদিকতা পেশার প্রতি তাঁরা বীতশ্রদ্ধ হবেন।

এক প্রবীণ সাংবাদিক কয়েকদিন আগে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরুর একটি ঘটনা বলছিলেন তিনি বহুদিন এই পেশায় নেই এবং এখন অবসরপ্রাপ্ত, তিনি বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখকও। তাঁর কথায়, “আমি তখন হয়তো কয়েক বছর সাংবাদিকতা করছি। একটি জায়গায় গিয়ে নিজের ও সংবাদপত্রের পরিচয় দিই, তখনই সকলে উঠে দাঁড়ান। তাতে আমি লজ্জিত হয়েছিলাম, তবে গর্বিতও হয়েছিলাম এ কথা ভেবে যে আমি যে পেশায় কাজ করি সেই পেশার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা দেখে। এখনকার সাংবাদিকদের আর সে ভাবে সম্মানিত হতে দেখি না। এখন অনেককেই বলতে শুনেছি সাংবাদিকরা সংবাদ ছেপে নয়, সংবাদ চেপে খান।”

প্রতিযোগিতার বাজারে সাংবাদিকদের দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়। সে জন্য তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করার সুযোগ সব সময় পান না। তবে তাঁরা নিজের পেশার প্রতি কতটা সুবিচার করেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কেন সে কথা জানানোর এটাই উপযুক্ত জায়গা।

প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন অর্থমন্ত্রী। বাজেট পেশ করার এক বা দু’দিন পরে কলকাতায় এসেছেন। রাত তখন প্রায় এগারোটা, বেশ কয়েকজন নাইট রিপোর্টার তাঁর বাড়ির বাইরে জটলা করছিলেন। তাঁরা চাইছিলেন অর্থমন্ত্রী এসে তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন। যদিও অত রাতে তিনি যে আসবেন না সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই রাতে অপ্রত্যাশিত ভাবেই বেরিয়ে আসেন। অডিয়োভিস্যুয়াল ক্যামেরা চালু হয়ে যায়, তিনি আসতেই সকলে বুম এগিয়ে দেয়। প্রণববাবুও শান্ত ভাবে সময় দেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই সবাই প্রস্তুত হয়ে যান। তারপরে দেখা যায় কারও কোনও প্রশ্ন নেই। তখন একজন বলেন, “দাদা, কিছু একটা বলে দিন...।” তখন তাঁর দিকে তীব্র বিরক্তিভরে তাকিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নিজের ঘরে চলে যান কিছু না বলেই।

অন্তত দশ জন সাংবাদিক, কারও কোনও কোনও প্রশ্ন নেই – ইংরেজিতে যাকে বলে ব্রিফলেস অ্যাডভোকেট। স্বভাবতই রাজনীতিক কাছেও সংবাদমাধ্যম অনেক লঘু হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা আক্রান্ত হলেও অনেক সময় সেই সংবাদও প্রকাশ করা হয় না, এই ঘটনা অবশ্যই বেদনার।

খবর চাপা আর খবর ছাপার দ্বন্দ্ব থাকবেই। সব খবর প্রকাশ করা যায় না, করা উচিত নয় এ কথাও ঠিক। তবে একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের উচিত তাদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা।

এই প্রবন্ধে কারও নাম উল্লেখ করা হল না। কারণ যাঁরা এই বিশ্লেষণ পড়বেন তাঁরা জানেন কার সম্বন্ধে কোন কথা বলা হচ্ছে, তাই নাম উল্লেখ করে সংবাদমাধ্যমকে আর বিড়ম্বনায় না ফেলাই শ্রেয়। যেখানে এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হচ্ছে সেটিও একটি সংবাদমাধ্যম ছাড়া অন্য কিছু তো নয়!

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Comment