সৌরভ শুধু ক্রিকেটার নন, মাঠে ও মাঠের বাইরে তিনি জ্বলজ্যান্ত অনুপ্রেরণা

অবসর প্রসঙ্গে: "রোজ পরীক্ষায় বসতে হচ্ছিল। সেটা আর চাইনি।"

 |  4-minute read |   09-07-2018
  • Total Shares

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আগে অনেক বাঙালি আইকন এসেছে। কিন্তু তাঁরা এদের মধ্যে দু' একজন ছাড়া বাকিরা কেউই সেই অর্থে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি, বাঙালির হৃদয়ে গণহিস্টিরিয়া তৈরি করতে পারেননি।

যে দু'জন পরেছিলেন সেই দু'জনই বিনোদন জগতের - একজন মহানায়ক উত্তম কুমার, অন্যজন 'ডিস্কো ডান্স' খ্যাত মিঠুন চক্রবর্তী। আশি বা নব্বইয়ের দশকে মিঠুন তো আম বাঙালির অন্দরমহল পেরিয়ে একেবারে হেঁশেলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। উত্তম ও মিঠুন জমানার মাঝে ছিল একটা বিশাল শূন্যতা। মিঠুন পরবর্তী অধ্যায়ে আবার তৈরি হল সেই শূন্যতা।

এমন একজনও স্বপ্নের নায়ক নেই যাকে নিয়ে গর্ববোধ করা যায়। ক্রমেই দ্রুত ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছিল বাঙালি।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৯৬ সালের জুন মাসের এক সন্ধ্যায় (ভারতীয় সময়) লর্ডসে স্বপ্নের টেস্ট অভিষেক ঘটল ইডেনের বাঁ হাতির। প্রথম টেস্টে ১৩১ রানের ইনিংসটি বাঙালির মনে চিরকালের জন্য গেঁথে গেছে। না শুধু রানের সংখ্যার জন্য নয়। বেহালার বঙ্গ তনয়ের মানসিকতার জন্য। যে ভাবে সে দিন তিনি ইংরেজ বোলারদের শাসন করেছিলেন তা সহজে ভোলার নয়।

একে তো চার বছর পরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করছেন বছর তেইশের যুবকটি। প্রথম টেস্টে ভারত পরাজিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় টেস্টে তাঁকে কোন জায়গায় নামানো হল? ওয়ান ডাউনে, স্বল্প রানে প্রথম উইকেটটি পড়ে যাওয়ার পরে। অধিনায়কের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। কিন্তু সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে কোনও ভুল করেননি সৌরভ। ১৩১ রানের ইনিংস খেললেন। দ্বিতীয় টেস্টেও শতরান। আর বাঙালি আবার তাদের স্বপ্নের নায়কের খোঁজ পেয়ে গেল।

সেদিন মহারাজের মতো ব্যাট করে নিজের নামের সার্থকতা বুঝিয়েছিলেন তিনি। আর সৌরভকে ঘিরে সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির রোমান্টিসিজম বাড়তে থাকে। এর পরের অধ্যায়টা তো ইতিহাস।    

সৌরভের আইকনিক চরিত্র হয়ে ওঠার পিছনে দু'তিনটে ধাপ রয়েছে। প্রথমটা যদি লর্ডসের অভিষেক হয় তা হলে দ্বিতীয়টা নিঃসন্দেহে ১৯৯৭ সালের টরোন্টোয় সাহারা কাপ। একদিনের ম্যাচে 'অচল' এই তকমা দিয়ে আগের ১৯৯৬ সালে সাহারা কাপের অধিকাংশ খেলতে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁকে। আর এবার তো তিনি সচিনের 'গোপন অস্ত্র'। চির শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরপর চারটে ম্যাচের সেরা হয়ে গড়ে ফেললেন বিশ্ব রেকর্ড।

সৌরভের আইকন হয়ে ওঠার তৃতীয় ধাপ দেশের অধিনায়কত্ব। ২০০০ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবে পূর্ণ সময়ের জন্য জাতীয় দলের অধিনায়ক হলেন তিনি। এর আগে পঙ্কজ রায় দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু একটি টেস্ট ম্যাচে।

সেই ২০০০ সাল থেকেই ভারতীয় ক্রিকেটের চাকা ঘুরতে শুরু করে। সেই বছরই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কবলে পড়ে তৈরি হয় একটি তরুণ ভারতীয় দল, যেখানে সিনিয়র বলতে শুধুমাত্র সচিন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই সেই তরুণ দল বিশ্বমানের হয়ে ওঠে শুধুমাত্র তার ম্যান ম্যানেজমেন্টের জন্য।

body1_070918030550.jpgতিনি আর শুধু অধিনায়ক নন, তিনি মেন্টর

সেই সময় তিনি আর শুধু অধিনায়ক নন। তিনি মেন্টর।

সৌরভের অধিনায়কত্বের সময় প্রাদেশিকতা লোপ পেয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট থেকে, যা আগে অন্য অধিনায়কদের সময় ভীষণ ভাবে চোখে পড়ত। দলের স্বার্থে প্রাদেশিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি এক নতুন কীর্তি স্থাপন করেছিলেন। সেই সময় ভারতীয় দলে সেরা এগারো জন ক্রিকেটার খেলতে শুরু করেন। অধিনায়কের পছন্দের এগারো জন নন।

আর এখান থেকেই সৌরভ আর বাঙালির অনুপ্ররণা নন, তিনি তখন গোটা ভারতের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন।

কোনও রকম দ্বন্দ্ব ছাড়া দলে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন দ্রাবিড় লক্ষ্মণরা। এদের উত্থানে সাহায্য করেছিলেন অধিনায়ক সৌরভ। ২০০০ থেকে ২০০৫ অবধি যে সময়টা সৌরভ অধিনায়ক ছিলেন কেউ বলতে পারবে না যে সে সময়ে একজনও অযোগ্য ক্রিকেটার ভারতীয় দোলে খেলেছে। সব বাছাই হতো পারফর্মেন্সের নিরিখে।

সৌরভের জমানায় বিদেশের মাঠে জিততে শিখেছে ভারত। যার শুরুটা অবশ্য ঘরের মাঠে ২০০১ সালে মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়া বধ দিয়ে শুরু। তার পর থেকে আর সৌরভকে পিছনে ফেলে তাকাতে হয়নি।

একদিনের ও টেস্ট ক্রিকেটে সমান তালে রান করে গিয়েছেন ধারাবাহিকতার সঙ্গে। এবং, একদিনের ক্রিকেটে ওর নাম চলে আসে সর্বকালের সেরা ম্যাচ উইনারদের  তালিকায়।

এর পর ২০০৪ সালের অস্ট্রেলিয়া সফর। যেখানে ব্রেট লি 'চিন মিউজিকের' কথা বলেছিলেন। সেটাই বোধহয় তাতিয়েছিল অধিনায়ক সৌরভকে। গাব্বার প্রথম টেস্টার প্রথম ইনিংসে ১৪৮। সেই ইনিংস সিরিজে ভারতকে সুবিধাজনক অবস্থায় পৌছিয়ে দেয়। সৌরভ আর অধিনায়ক নন, নেতা।  

তারপরে তাঁর জীবনে ভাটা আসে, তার ব্যাটে রানও ছিল না। এলেন গ্রেগ চ্যাপেল। অধিয়কত্ব হারলেন, দল থেকেও বাদ পড়লেন।

এখান থেকে শুরু হল অন্য এক সৌরভের জীবন। যার অনুপ্রেরণা শুধু মাত্র বাইশ গজে নয়, মাঠের বাইরেও বিরাজ করে।

এগারো মাস তিনি যখন দলের বাইরে ছিলেন তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর ব্যাট কথা বলেছে। উত্তরাঞ্চলের বিরুদ্ধে একটি ঘরোয়া ক্রিকেট ম্যাচে একটি ঝকঝকে ১১৭ রানের ইনিংস খেলেন রাজকোটে। সেই ম্যাচে আমি প্রেসবক্সে। আর বক্স থেকে দেখলাম গ্রেগ চ্যাপেলের স্নেহধন্য বোলার গগনদীপ সিং প্রথম ওভারে একটি বাউন্সার করলেন। আর সেটাই বোধহয় গগনদীপের ক্রিকেট কেরিয়ারের সব চেয়ে বড় ভুল। ওই ওভারে ২২ রান তোলেন সৌরভ, পরের দিন শতরান। আবার কাগজের শিরোনামে সৌরভ। গগনদীপ হারিয়ে গেলেন।

body_070918030613.jpgসৌরভের জীবনটাই তো সেরার সেরা অনুপ্রেরণা

প্রত্যাবর্তনের পরেই একদিনের ক্রিকেটে নাগপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে  ৯৮ রান করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজে তিনিই ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন। বিশ্ব ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করে আবার সফল।

অনুপ্রেরণা নিয়ে অনেকেই বই পড়েন। তার আর প্রয়োজন কী? সৌরভের জীবনটাই তো সেরার সেরা অনুপ্রেরণা। মাঠ ও মাঠের বাইরে দু'জায়গাতেই তিনি আইকনিক চরিত্র। খুব কম ক্রিকেটারই আছেন যাঁরা খেলতে খেলতে কিংবদন্তি হয়ে যান সৌরভ তাঁদেরই একজন।

বাংলার ক্রীড়াবিদদের মধ্যে তিনি সফলতম ক্রীড়াবিদ।

২০০৮ সালে উনি যখন অবসর গ্রহণ করেন তখন সময়টা বেছে নিয়েছিলেন বুদ্ধি করে।

এক সাক্ষাৎকারে আমি তাঁর অবসরের কারণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, "আমার আর প্রমাণ করার কিছু ছিল না। তাও আমাকে রোজ পরীক্ষায় বসতে হচ্ছিল। সেটা আর চাইনি।"

ক্রিকেট ছাড়ার পরও ক্রিকেট ওঁকে ছাড়েনি ভারতের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হওয়ার জন্য বিসিসিআই এবং সিএবি দু'জায়গা থেকেই ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুধু খেলার মাঠে নয়, টিভির পর্দায় দাদাগিরি অনুষ্ঠানেও তিনি স্বচ্ছন্দ। এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনার জন্য তাঁর চেয়ে উপযুক্ত কেউ ছিলেন না।

আসলে বঙ্গ জীবনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ক্রিকেটার বা দেশের অন্যতম সেরা অধিনায়ক নন, তিনি একজন জ্বলজ্যান্ত অনুপ্রেরণা। ক্রিকেট মাঠে, আবার মাঠের বাইরেও।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANJIB GUHA SANJIB GUHA @sanjibguha

The writer is a veteran sports reporter. Editor, www.thelivemirror.com.

Comment