কলকাতা বিমানবন্দর নিয়ে কেন বিরক্ত পর্যটকরা
যাঁরা ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এখন তাঁরাও চিন্তায়
- Total Shares
গত দিন দশ-বারো টানা বৃষ্টি, প্রায় দু-সপ্তাহে সাকুল্যে ঘণ্টাখানেক সূর্যের মুখ দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ।
বৃষ্টির মধ্যেই প্রায় দৌড়তে দৌড়তে কলকাতা বিমানবন্দরের প্রধান গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক মাঝবয়সী বিদেশিনী। তাঁর সাদা টি-শার্ট ও নীল জিন্স ভিজে জবজব করছে। অনেকটা উদভ্রান্তের মতো বিমানের প্রস্থান তথ্য দেওয়া ইলেকট্রনিক বোর্ডের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা নিজের মনেই আওড়াচ্ছিলেন। তাঁর চোখে-মুখে ছিল একরাশ বিরক্তির ছাপ। আত্মীয়কে ছাড়তে গিয়ে আমিও তখন সেখানেই দাঁড়িয়ে। সাংবাদিক মন বারবারই প্রশ্ন করতে চাইছিল। অবশেষে বিদেশিনীকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, "এনি প্রব্লেম? "
বিমান প্রস্থানের ইলেকট্রনিক বোর্ডের থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে বেশ কিছুটা বিরক্তিকর চোখেই তাকালেন তিনি। প্রথম প্রতিক্রিয়া, "ইটস হরিবল"। বাংলায় যার আক্ষরিক অর্থ হল, ‘ভয়ঙ্কর’। আমার সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর, বেশ খানিকটা চাঁচাছোলা ভাবে ইংরাজিতে গড়গড় করে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উগরে দিলেন। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা এইরকম, "৪০ মিনিট ধরে বৃষ্টির মধ্যে ট্রলিব্যাগ টানতে টানতে বিমানবন্দরে এলাম। বড় রাস্তাটার যেখান থেকে বাঁ দিক দিয়ে বিমানবন্দরে ঢোকার ব্রিজ শুরু হয়েছে, তারও অনেকটা আগে থেকে হাঁটছি। ওটা মনে হয় কোন একটা বাস স্টপেজ ছিল। এক চুলও নড়ছে না গাড়িগুলো। তারমধ্যে রাস্তাতে অনেকটা জল জমেছে। আমার ট্রলিব্যাগটাও তো ভিজে গেছে। কে জানে ভেতরে জামাকাপড়গুলোর কি অবস্থা! আরেকটা কথা, এই অবস্থা শুধু যে আমার একার হয়েছে তা নয়, আমার মত আরও অনেকেরই এই একই অবস্থা। তাকিয়ে দেখুন ওঁরা সকলেই আমার মতোই কাকভেজা ভিজে আসছেন।"

বুঝতে পারলাম উনি ভিআইপি রোডের কথা বলছেন। রাস্তার বাঁ দিক থেকে ব্রিজে ওঠার আগের স্টপেজ, মানে যে কৈখালি, তাও বুঝতে অসুবিধা হল না। তবে বিমানবন্দরের ৩-এ গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে বলে যাওয়া ওই বিদেশি মহিলার শেষ লাইন দুটো কথায় বেশ অপমানিতই হলাম। যার বাংলা তরজমা করলে হয়, "এই আপনাদের কলকাতা? এই নিয়ে আপনাদের এত গর্ব?"
কথাটা হজম করতে পারছিলাম না, কিন্তু কী উত্তর দেব! উনি ভুল বলেছেন, এ কথা তো বলা যাবে না! ২৮ জুলাইয়ের ঘটনা।
আতঙ্ক! বিমান যাত্রীদের কাছে এখন কলকাতা বিমানবন্দর বেশ আতঙ্কের। চুরি-ছিনতাই নয়, এর কারণ কলকাতা বিমানবন্দরের চারপাশে থাকা ভিআইপি রোড ও যশোহর রোডের বেহাল দশা। দাঁত বার করা রাস্তার দুর্দশা ক্রমশই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিমান যাত্রীদের কাছে।
একে তো ট্যাক্সি রিফিউজাল ও শহরে নতুন কাউকে দেখলেই তাদের ঠকানোর প্রবণতা রয়েছে এই শহরের ট্যাক্সিচালকদের বড় অংশের। তার উপরে বেহার রাস্তা। দুইয়ে মিলে ভ্রমণার্থীদের মনেও এই শহর সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। তাই কলকাতা বিমানবন্দরকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন ভ্রমণার্থীদের একটা বড় অংশ। ফলে কলকাতায় যে সংখ্যায় ভ্রমনার্থী আসার কথা, সংখ্যাটি তার চেয়ে কম বলে মনে করছেন অনেকেই।

আবার যাঁরা ব্যবসার কারণে এ রাজ্যে আসেন, তাঁদের কাছেও এই মুহূর্তে কলকাতায় আসাটা বিরক্তিকর হয়ে পড়ছে। আর রাস্তা সারনোর দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই পূর্ত দপ্তরের ভুমিকা যথেষ্টই প্রশ্নের মুখে।
ভিআইপি রোডের অবস্থা যে খুব একটা খারাপ তা হয়তো নয়, তবে ভিআইপি রোড আর যশোহর রোডের সংযোগস্থল থেকে শুরু করে বারাসতের দিকে এগোলে রাস্তার যে দশা চোখে পড়ে, তাকে তাকে নরক বললেও বোধহয় কম বলা হবে। পিচের আস্তরণ উঠে ইট বেরিয়ে পড়েছে। তার মধ্যে প্রায় দু’এক পা অন্তর বিশাল বিশাল গর্ত। মিনিট দশেকের টানা বৃষ্টিতেও জল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তার উপর। গাড়িচালকদের পক্ষে জলভর্তি গর্ত বাঁচিয়ে গাড়ি চালানো সত্যিই খুব সমস্যার। যে কোনও সময়ই ঘটতে পারে যে কোনও বড় দুর্ঘটনা। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়েই গাড়ির গতি একদমই কমিয়ে দিতে হচ্ছে চালকদের। যার ফলে তৈরি হচ্ছে তীব্র যানজট, ভিআইপি রোড বরাবর।
মিনিট পনোরোর রাস্তা পার হতে কখনও কখনও প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। সকাল-বিকেলের ব্যস্ত সময় হলে তো আর কথাই নেই। বাসের ভিতরে অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কিছু করার থাকে না। যাঁরা বিমান ধরতে আসছেন, তাঁদের টেনশন কী, তা সহজেই বোঝা যায়। একটা সময় বাধ্য হয়েই তাঁরা ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে পা পিঠে স্যাক বেঁধে দৌড়তে শুরু করেন।
বিদেশ কিংবা ভিন রাজ্য থেকে কলকাতায় ঘুরতে আসা মানুষজনের কাছে এটা একটা বড় সমস্যা। যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাঁরা না হয় জানেন কতক্ষণ সময় হাতে নিয়ে বেরতে হবে, কিন্তু যাঁরা প্রথম বার এই শহরে আসছেন তাঁদের অবস্থা কী, তা সহজেই অনুমেয়।
বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে যানজটের কথা মাথায় রেখে ভ্রমনসূচিতেও বেশ কিছুটা পরিবর্তন করতে হচ্ছে ভ্রমণ সংস্থাগুলিকে। এই কারণে যথেষ্টই অসন্তুষ্ট হচ্ছেন কলকাতায় আসা ভ্রমণার্থীরা - এমনটিই জানালেন কলকাতার নামকরা একটি ট্যুর অর্গানাইজিং কোম্পানির মালিক। ফেরার টিকিট যদি বিকেলের বিমানে হয়
তাহলে সেদিন সকালে ঘোরানোর প্রায় সব পরিকল্পনাই বাতিল করতে হচ্ছে তাঁদের। এতটা সময় নষ্ট হওয়ায় বিরক্ত হচ্ছেন পর্যটকরা। একই কারণে কলকাতায় ভ্রমণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কপালেও এখন চিন্তার ভাঁজ। দ্বিতীয়বার তাঁরা আসবেন তো?
ব্যবয়াসিক কাজে যাঁরা কলকাতায় আসেন, তাঁরা সাধারণ ভাবে সকালের বিমানে এসে বিকালে ফিরে যান। তাঁদের হাতে সময় থাকে খুব কম। এই সময়ের মধ্যে যানজটের জন্য পথে সময় নষ্ট হলে তাঁরা যে এই শহরে আসা কমিয়ে দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এর ফলে বিমানে যাত্রী কমবে, একই ক্ষতি হবে হোটেল ব্যবসারও।
রাস্তায় কোনও বড় সমস্যা হলে ইটের টুকরো টিয়ে গর্ত ভরাট করে তার উপরে বিটুমিনের আস্তরণ দেওয়া হয়। তার আয়ু মেরে কেটে কয়েক সপ্তাহ। বৃষ্টি হলে তা কমে কয়েক দিনে দাঁড়াতে পারে। তবে সরকারের কাছে, পূর্ত দপ্তরের কাছে নথি আছে, তাঁরা নিয়মিত রাস্তা সারাচ্ছেন। সারানো মানে জোড়া-তালি দেওয়া আর রক্ষণাবেক্ষণ নামে নিম্নমানের সরঞ্জাম দিয়ে কোনওক্রমে রাস্তা সারাই করা। এই ব্যবস্থা চলতে থাকলে রাজ্য থেকে মুখ ফেরাবেন ব্যবসায়ীরা, আসবেন না পর্যটকরাও।

