প্লাজমা, লোহিতকণিকা, শ্বেতকণিকা পৃথক করার পরিকাঠামো না থাকায় রক্তের এত অকাল

দেশের যুবসমাজকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে

 |  4-minute read |   14-06-2018
  • Total Shares

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আমাদের দেশে রক্ত পরিষেবা ও পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছে ভারত সরকারের জাতীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদকে। ওই পর্ষদটির পরামর্শদাতা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আমিও যুক্ত রয়েছি বহু বছর ধরে।

বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের প্রচারসূচি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনার জন্য গত মাসে দিল্লিতে জাতীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদটির একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পয়লা জুন থেকে ৩০ জুন- এই পুরো সময়টিতে দেশজুড়ে  রক্তের আকাল দেখা দেয়, তাই এই মাসটিকে ইংরেজিতে 'ড্রাই-মান্থ' বলে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে আমি রক্তদান ও রক্ত নিয়ে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। তাই ওই বৈঠকে আমি বলি যে গ্রীষ্মকালে যে রক্তের দেখা দেয় সেটা শুধু মাত্র এক সপ্তাহের তৎপরতাতেই মিটবে না, প্রয়োজন দীর্ঘ আন্দোলন ও প্রচার কর্মসূচির।

ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেইনের আজ জন্মদিন। তাই এই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে এগারোটি দেশ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বা হু-র একটি সম্মেলন হয়। ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে আমিও সেদিন ওই বৈঠকটিতে উপস্থিত ছিলাম। বৈঠকে উপস্থিত দেশগুলির মধ্যে কোন দিনটিকে চূড়ান্ত করা হবে তা নিয়ে বেশ কথাকাটাকাটি চলছিল। অবশেষে সর্বসম্মত ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেইনের জন্মদিনটিতেই পালিত হবে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।

body2_061418040700.jpg

তারপর ২০০৪ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই দিনটি পালন করা শুরু করল পৃথিবীব্যাপী। এখন এই দিবসটি ১৮০টি দেশে পালন করা হয়।

ভারতের মতো এতো বড় একটা দেশে এখনও প্রায় দেড় কোটি রক্তদাতার প্রয়োজন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা মোট ৬০ লক্ষের মতো। অর্থাৎ একটা বিরাট ঘাটতি এখনও রয়ে গেছে। আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকটাই রক্ত সঞ্চালনের উপরে নির্ভরশীল। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ৬৩টি দেশ স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে রক্ত পেয়ে দেশগুলি রক্তের ঘাটতি প্রায় একশো ভাগই মেটাতে পেরেছে। যদিও আমাদের সরকারও এই বিষয় বেশ তৎপর। পশ্চিমবঙ্গও বেশ অনেকটাই এগিয়ে ছিল কিন্তু এখন আবার আমরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি।

boby2_061418040745.jpg

আমাদের দেশে যে সব জায়গায় স্বেচ্ছায় রক্তদানের সংখ্যা খুব কম সেখানে পরিবর্তক রক্তদাতার মাধ্যমে রক্ত দেওয়া ও নেওয়া হয়। অর্থাৎ যদি কোনও রোগীর রক্তের প্রয়োজন হয় তা হলে হাসপাতাল সেই রোগীকে তাঁর প্রয়োজনীয় রক্ত দেবে ঠিকই কিন্তু পরিবর্তে সেই রোগীর পরিবারের একজনকে তাঁর রক্ত হাসপাতালে জমা করতে হবে।

আমার মতে এই নিয়মটা খুবই অমানবিক। কারণ যেই রোগীর ক্যান্সার কিংবা অন্য কোনও কঠিন অসুখ হয়েছে তখন সেই রোগীর পরিবারের ও নিকটাত্মীয়দের মনের অবস্থা খুবই খারাপ থাকে আর সেই পরিস্থিতিতে তাঁর পরিবারের মানুষের থেকে রক্ত চাওয়াটা খুব একটা কাজের কথা নয়।

ভারতে প্রায় ২৯০০ ব্লাডব্যাঙ্ক আছে যার মধ্যে ১২০০টি সরকারি পরিচালিত ব্লাডব্যাঙ্ক। সরকারি তথা বেসরকারি ব্লাডব্যাংকগুলো পরিবর্তক রক্ত নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। আরও একটা খারাপ দিক হল এই রক্তের একটা পরিষেবা বাবদ টাকা নেওয়া হয়ে থাকে রোগীর পরিবারের থেকে। যদিও ভারত সরকার বলে রক্তের কোনও মূল্য বা দাম হয় না তাই তাঁরা এটিকে পরিষেবা বাবদ টাকা বা সার্ভিস চার্জ বলে।

body3_061418040732.jpg

তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঠিক করেছে যে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবকটি দেশে রক্তদাতার সংখ্যা বারবার কথা। এ বছরে আমরা এটাও মাথায় রেখেছি যে প্রচারের মাধ্য মে এমন একটা সংখ্যা পৌঁছতে হবে যাতে মানুষকে রক্তের বিনিময় রক্ত নিতে না হয়।

দেখা গেছে আমাদের দেশে যত সংখ্যক ছাত্রছাত্রীরা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক বা সিবিএসসি কিংবা এই ধরণের অন্যান্য পরীক্ষাগুলো দিয়ে থাকে তাঁরা যদি জীবনে এক বারও স্বেচ্ছায় রক্তদান করে তা হলে এই রক্তের ঘাটতি এক লাফে অনেকটা কমে আসবে। সুতরাং আমাদের দেশের যুবসমাজকেও স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

body1_061418040713.jpg

আমি আগেও যেমন বলেছি একটি দিনকে রক্তদান দিবসের তকমা না দিয়ে কিংবা সাতদিন ব্যাপী প্রচারে কোনও লাভই হবে না ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রক্তের আকাল চিকিৎসকদের কপালে চিন্তার ছাপ ফেলেছে তাই বছরের ৩৬৫ দিনেই এই প্রচার কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে এবং বিভিন্ন জায়গায় যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও নানা জায়গায় প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের সকলকে বুঝতে হবে যে রক্তদান একটা সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যেই পরে সেটা।

আর একটা বিষয়ে যেটা সাধারণ মানুষের বড় একটা জানা নেই সেটা হল রক্তকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। কারণ যখন কাউকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে সেই রোগীর সম্পূর্ণ রক্তের প্রয়োজন হয় না। যদিও রক্তের বিভাজন  সম্ভব হয় তা হলে এক রক্ত তিন জন পেতে পারেন। এর ফলে প্রচুর পরিমাণে রক্তের অপচয় হচ্ছে। আমাদের  দেশে তথা রাজ্যে রক্ত বিভাজনের (ব্লাড কম্পোনেন্ট)-এর কোনও রকম পরিকল্পনা, পরিকাঠামো ও সর্বোপরি দূরদর্শিতার অভাব। যদিও আমাদের রাজ্যে এখনও এই মুহূর্তে ১৪টি হাসপাতালে এই পরিকাঠামো থাকলেও সেখানে রয়েছে টেকনিশিয়ানদের অভাব। আমরা এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বলেছি তৃণমূল সরকারের আসার পর থেকেই শুনেছি যে প্রত্যেকটি জেলায় এই বিভাজন ব্যবস্থা শুরু করা হবে কিন্তু তা এখনও কিছু এগোয়নি। 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

APURBA GHOSH APURBA GHOSH

Secretary General, FBDOI | Member, Blood Transfusion Services of India, Government of India

Comment