রাশিয়া ২০১৮: আমি দুঃখিত, বাঙালিরাই সবচেয়ে বড় ফুটবলপ্রেমী নয়
বাঙালিরা ভাবেন মতে উত্তরপূর্বাঞ্চলের ফুটবলারদের সাফল্যের রাস্তা সল্টলেকই
- Total Shares
ভারতীয় ফুটবল সমর্থক মানেই আপনাকে বাঙালী হতে হবে, অনথ্যায় আপনি সত্যিকারের ফুটবল সমর্থকই নন।
ফুটবলকে কেন্দ্র করে এমন একটি বিচিত্র শ্রেণি বিভাজন তৈরি করে রেখেছেন 'ভদ্রলোক' বাঙালিরা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে এই ধারণা আদতে একটি রবারের বলের মতো যা আত্মতুষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রতি চার বছরে একবার এই রবারের বলটি ফুলেফেঁপে ওঠে যখন আপামর বঙ্গবাসী ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দেয়। আর বিশ্বকাপ এসে যাওয়া মানেই বাঙালি আর বাঙালি থাকে না। বাঙালি তখন রাতারাতি ব্রাজিলীয় কিংবা আর্জেন্তিনীয় হয়ে যায়। প্রয়োজনে বউকে সঙ্গে করে একেবারে রণক্ষেত্রে পাড়ি দেয়। আর যাওয়ার আগে সংবাদপত্রে নিজেদের ছবি পাঠাতে ভোলে না যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় 'বিশ্বকাপের উদ্দেশ্যে ফুটবল পাগল দম্পতি' গোছের ক্যাপশন দিয়ে।
এটা সত্যি যে বাঙালি মাত্রেই একটি ভাষাই বোঝে - ফুটবল। (এখানে ভাষা বলতে আমি বাংলা ভাষার কথা বলতে চেয়েছি। অবাঙালিদের ভিড়েও বাঙালিরা কিন্তু শুধুই বাংলা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।)
গোটা উত্তরপূর্বাঞ্চলেই বাঙালিদের এই ফুটবলের উপর অগাধ অধিকারবোধ নিয়ে ক্রুদ্ধ। অন্যদিকে, গোয়া ও কেরল ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত হলে শুধুমাত্র টুইটারে বা কোনও নামগোত্রহীন ওয়েবসাইটে নিজেদের মনের কথা লেখে আর কলকাতা কেন আর ভারতের ফুটবল মক্কা নয় সেই বিষয় তর্ক করে। এর পর তারা বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়ে তাদের দাবিকে যুক্তিপূর্ণ করে তোলবার চেষ্টা করে। তারা বোঝাবার চেষ্টা করে কী ভাবে উত্তরপূর্বাঞ্চলের ফুটবলাররা বর্তমানে দেশের ফুটবল ঐতিহ্যের পতাকা বহন করে চলেছেন বা কী ভাবে শিলং লাজং বা আইজল এফসির মতো ক্লাবগুলো তরুণদের মন জয় করবার পাশাপাশি উত্তরপূর্বাঞ্চলকে ভারতীয় ফুটবলের নতুন পাওয়ার হাউস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
না খেললেও এই বিশ্বকাপে আমার প্রিয় ফুটবলার কিন্তু মো শালাহ্
কিন্তু বঙ্গদেশের ফুটবলপ্রেমীরা শুধুমাত্র একটি কথাতেই এই তর্কের নিষ্পত্তি ঘটিয়ে ছাড়বে - উত্তরপূর্বাঞ্চলের ফুটবলারদের সাফল্যের রাস্তা সল্টলেকের মধ্যে দিয়েই যায়।
এই সব ফুটবল বোদ্ধাদের আপনি কী ভাবে বোঝাবেন যে অন্যরা যারা ফুটবল খেলা দেখে এবং রীতিমতো উপভোগ করে তাদের কাছে এই সব ফুটবল বোদ্ধাদের জ্ঞান অপ্ৰয়োজনীয়। বাঙালি ফুটবল সমর্থকদের কী ভাবে বোঝাবেন যে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল যুদ্ধ ছাড়াও আরও অনেক যুদ্ধেই শহীদ হওয়া যায়।
কোনও ফুটবল সমর্থকদের দলের মাঝমাঠ থেকে একজন বয়েসজ্যেষ্ঠ বাঙালিকে সরানো রীতিমতো অসাধ্য।
উত্তরপূর্বাঞ্চল কি এখন ভারতীয় ফুটবলের নতুন পাওয়ার হাউস
দিল্লিতেও যে নতুন নতুন ফুটবল সমর্থকদের ক্লাব গড়ে উঠছে যারা লিভারপুলের জার্সি গায়ে দিয়ে আর্সেনালকে সমর্থন করে আর বিয়ার হাতে টিভির পর্দার সামনে বা কোনও অভিজাত রেস্তরাঁয় বসে ফুটবল উপভোগ করে। তাদেরও কিন্তু বাঙালিদের এই ফুটলবলের উপর অগাধ অধিকারবোধ নিয়ে যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। ক্লাবের সমর্থক ফুটবল নিয়ে কথা বলতে গেলেই বুঝে যায় যে তার পাশের চেয়ারের বন্ধুটি একজন বঙ্গ সন্তান। এই বঙ্গ সন্তান তার বাবাকে কৃপণ বলে খোটা দেয় আবার তার পাশাপাশি বারংবার বলতে থাকে যে একমাত্র ফুটবল নিয়ে সে তার কৃপণ বাবার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারে। বুঝতেই পারছেন সেই রবারের বলটি এবার ফেটেছে, দাবাং মনটি এবার শান্ত হয়েছে!
এই অধিকারবোধ খর্ব করবার একটি রাস্তা রয়েছে।
মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল যুদ্ধ ছাড়াও আরও অনেক যুদ্ধেই শহীদ হওয়া যায়
যে সব ফুটবল সমর্থক নিজেদের বঞ্চিত বলে মনে করে তাদের আমি আজ এই গোপন পথের সন্ধানটি দিচ্ছি। বাঙালি ফুটবল সমর্থকদের মস্তিষ্কে ঢুকতে গেলে ম্যাচের মধ্যিখানে হঠাৎই ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কোনও প্রশ্ন করে বসতে হবে। মিলিয়ে নেবেন, তা হলে মাঝমাঠের খেলোয়াড়ও সেমসাইড গোল দিয়ে দেবে।
একবার এক ভুঁড়ি-বিশিষ্ট ফুটবল সমর্থককে এ ভাবে চেপে ধরবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।
'হে রমণী আমি এখন ফুটবল দেখছি আর ফুটবল পুরুষদেরই খেলা যা আপনি বোঝেন না' এরকম গোছের চাহনি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেই ভদ্রলোক। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম "টিভিতে কী জ্লাটানকে দেখাচ্ছে?" উত্তরে উনি বললেন, "হ্যা, জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ।" কিন্তু যে উচ্চারণে নামটি বললেন মনে হল নামটা বুঝি আমি এই প্রথমবার শুনছি।
আমি আর এ নিয়ে কথা না বাড়িয়ে পরবর্তী প্রশ্ন করলাম। "বলুন তো ভারতীয় ফুটবলের প্রথম অধিনায়ক কে ছিলেন?" তিনি বিলক্ষণ নাগাল্যান্ডের চিকিৎসকের নামটা জানতেন কিন্তু তালিমেরেন অ্যাওর উচ্চারণ সম্পর্কে তার কোনও সম্যক ধারণাই ছিল না।
নাগাল্যান্ডের চিকিৎসকের তালিমেরেন অ্যাও ভারতের প্রথম ফুটবল অধিনায়ক
অ্যাও সম্পর্কে ভদ্রলোক অনেক কিছুই জানেন দেখলাম এবং তার জন্য সে বিশেষ কৃতিত্বের দাবি করতেই পারেন। কিন্তু আমাদের এই আলোচনায় ঘরের বাকিরা কী রকম একটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমার আর কীই বা করার থাকতে পারে। ঘর থেকে বেরিয়ে শাহরুখের চাক দে ইন্ডিয়া দেখতে বসলাম।
[পুনশ্চ: বঙ্গজ ফুটবলপ্রেম নিয়ে বিক্ষুব্ধ হওয়ার কোনও মানে হয় না। দিনের শেষে আমরা সকলেই ফুটবল ভক্ত। কিন্তু আমাদের ফুটবল মাঠে সকলকেই সমানাধিকার দেওয়ায় উচিৎ। যাই হোক, না খেললেও এই বিশ্বকাপে আমার প্রিয় ফুটবলার কিন্তু মো শালাহ্।]

