থ্যালাসেমিয়া রুখতে বিয়ের আগে রক্তপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিৎ

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে যৌথ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সমস্যাটিকে মোকাবেলার করার জন্য

 |  4-minute read |   08-05-2018
  • Total Shares

গ্রিক ভাষায় সমুদ্রকে ''থ্যালাস' বলা হয় তাই যেহেতু গ্রিক ও ইতালিয়ানদের মধ্যে থ্যালাসিমিয়া বেশি দেখা যেত তাই রোগটির নাম হয় থ্যালাসিমিয়া। ভূমধ্যসাগরের চারপাশে এই রোগটি বেশি দেখা যেত। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। ধীরে ধীরে রক্তের এই রোগটি পুরো এশিয়ায়েই চিহ্নিত হতে থাকে বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বর্মা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য জায়গায়। 

পরে অবশ্য গ্রিস, সাইপ্রাস ও ইতালিতে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয় বলে ওখানে এখন এই রোগটা খুবই কম দেখা যায়।

ভারতকে বিশ্বের থ্যালাসেমিয়ার রাজধানী বলা হয়। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই থ্যালাসেমিয়া বেশি নজরে আসতে শুরু করে।

thal_body1_050818073133.jpgকেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকারগুলোকে যৌথ ভাবে সমস্যাটির মোকাবেলার করতে হবে

আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাটা অনেক হলেও রোগটিকে প্রতিরোধ করার জন্য কিন্তু বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার ব্যাপারটা এখনও বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এই বিষয় আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতাও তেমন একটা নেই।

আমার মনে হয় সমস্যাটিকে প্রতিরোধ করার জন্য শুধু মাত্র কয়েক জনকে এগিয়ে এলে চলবে না। ভারতে থ্যালাসেমিয়া সমস্যাটা যে ঠিক কতটা বড় একটা সমস্যা সেটা মানুষকে বলতে হবে। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য জাতীয় স্তরে বেশ কয়েকটা প্রকল্পও গ্রহণ করা প্রয়োজন, বিষয়টিকে একটা জাতীয় আন্দোলনের জায়গায় না নিয়ে গেলে কোনও রকম সুরাহা হবে। এই মুহূর্তে আমাদের দেশের কয়েকটি রাজ্য কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করলেও একটা কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করতে হবে সরকারকে।

আমাদের রাজ্যে যেমন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এমনকি জেলাতেও থ্যালাসিমিয়ার চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এই সব কেন্দ্রে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা হয়, রোগীদের ব্লাড ট্রান্সফিউশন করানো হয় এবং এখন থেকে রোগীদের ওষুধও দেওয়া হয়।

রক্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের দেশে বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর ঠিকুজিকোষ্ঠী না মিলিয়ে তাদের রক্ত পরীক্ষা করানো বেশ প্রয়োজনীয়, এবং সঙ্গে কাউন্সেলিং করানোও বাধ্যতামূলক করতে হবে। যদিও এখন আমাদের কাছে অনেক মানুষ আসেন যাঁরা বিয়ের আগে এই বিষয়গুলো নিয়ে পরামর্শ চান।

দম্পতির মধ্যে যদি একজন এর বাহক হন তাহলে তাঁরা বিয়ে করতে পারেন কিন্তু দু'জনেই বাহক হলে এদের দু'জনের বিয়ে করাটা উচিৎ সিদ্ধান্ত হবে না। এই ব্যাপারটাকে যদি আমরা বাধ্যতামূলক করতে পারি তা হলে আমাদের দেশ অনেকটা হলেও থ্যালাসেমিয়া মুক্ত হতে পারবে।

একজন দম্পতির সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হতে পারে কি না, মানে, এই দম্পতির মধ্যে কেউ একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না সেটা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে দু'ধরণের পরীক্ষার মাধ্যমে, যেমন কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট টেস্ট এবং হাই পারফরমেন্স লিকুইড কোমাটোগ্রাফি।

যদি কেউ থ্যালাসিমিয়া মেজর হন তাহলে তাঁর মজ্জা (বোন-ম্যারো) প্রতিস্থাপন করলে তিনি হয়ত সুস্থ হয়ে উঠবেন কিন্তু এই চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই খরচ সাপেক্ষ। যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকলে তা সম্ভব নয়। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দিকটিও সরকারকে ভাবতে হবে।

thal_body2_050818073222.jpgবিয়ের আগে পাত্রপাত্রী উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করানো বাঞ্ছনীয়

আমাদের দেশে এই রোগটা একটা কঠিন সমস্যা হলেও কয়েকটি গাইডলাইনস বা নির্দেশিকা মেনে চলা যায় তা হলে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। একজন ডাক্তার হিসাবে আমার মনে হয় বিশেষ কয়েকটা পদক্ষেপ সাধারণ মানুষকেও নিতে হবে।

*বিয়ের আগে পাত্রপাত্রী উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করানোটা বাঞ্ছনীয়।

*যদি কোনও দম্পতির মধ্যে কেউ একজন বাহক হন তাহলে তাঁদের সন্তানের ক্যারিয়ার টেস্ট করতে হবে। এই পরীক্ষাটি ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যেই করতে হয়।

*এই রোগের বাহকের পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ যে এই ব্যক্তির বাবা কিংবা মা কে এই রোগটির বাহক যার থেকে তিনি এই রোগটি পেয়েছেন। আবার অনেক সময় দেখা হয় সেই পরিবারে আর কেউ এই রোগের বাহক কি না দেখার জন্য পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ।

যাদের থ্যালাসেমিয়া মেজর রয়েছে এমন এক ব্যক্তি যিনি নিয়মিত ট্রান্সফিউশন পাচ্ছেন সেই ব্যক্তিকে হেপাটাইটিস বি-র টিকাটি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

সার্বিক স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকে আমাদের দেশকে এগোতে হবে এবং এই প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে আমরা যদি প্রতিষেধকের দিকে বেশি সচেতন হই যেমন টিকাকরণ, ওষুধ, তাহলে কাজ হবে।

thal_body3_050818073254.jpgকোনও দম্পতির মধ্যে কেউ একজন যদি বাহক হন তাহলে তাঁদের সন্তানের ক্যারিয়ার টেস্ট করতে হবে

যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু যথেষ্ট খরচ করে এই সব সমস্যাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যথোপযুক্ত ভাবে ও ঠিকঠাক খাতে টাকা খরচ করা হচ্ছে না। কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকারগুলোকে যৌথ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এই সমস্যার মোকাবিলার জন্য।

বিশ্ব থ্যালাসিমিয়া দিবস উপলক্ষে শেষে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে থ্যালাসেমিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু খুব একটা কঠিন কাজ নয়, যেটা করতে হবে সেটা হল মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে যাতে তাঁরা নিজেদের ভবিষৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বিয়ের আগে উপযুক্ত পরীক্ষা করতে উদ্যোগী হন। 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

DR. SOUMYA BHATTACHARYA DR. SOUMYA BHATTACHARYA

Haemato Oncologist

Comment