দুর্গাপুজোর ইতিকথা: বনেদি বাড়ি পুজো থেকে পাড়ার মোড়ের সর্বজনীন বারোয়ারি পুজো

শহুরে বাবুদের হাতে পড়ে কী ভাবে পটের দেবী হলেন মৃন্ময়ী

 |  4-minute read |   12-10-2018
  • Total Shares

ভাদর-আশ্বিন মাসে ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে-র অনেক আগে গ্রাম বাংলার আকাশে-বাতাসে পুজোর খবর নিয়ে আসত গানবালার গাওয়া আগমনীর সুর-

“যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী

উমা নাকি বড় কেঁদেছে।

আমি দেখেছি স্বপন, নারদ বচন,

উমা 'মা' 'মা' বলে কেঁদেছে।।"

কিংবা মুস্কিল আসানের চামর দোলানো “আচারে লক্ষ্মী মাতা বিচারে পণ্ডিতে, আর মুস্কিল আসান কর দোহাই মানিক পীর.....” শুনতে শুনতে | তখন গুটিকয় ধনী গেরস্থ বাড়িতে পুজো হত ঘটে পটে অনাড়ম্বর ভক্তি উপাচারে| স্নান যাত্রার দিন শুরু হত পটের চালি তৈরির শুভারম্ভ| তার নাম কাঠামো পূজা। সে সব এখন চুলোর দোরে। ওসব পাঁজি-পুঁথির পাতায় লেখা দিনক্ষণ কে দেখে? ঠাকুর রামকৃষ্ণই তো বলেছেন পাঁজিতে লেখা এক আড়া জল কিন্তু পাঁজি নিংড়লে এক ফোঁটা জলও মেলে না। তবে আর ওসবের কী মানে আছে? তার চেয়ে এই ভালো নিজেদের সময় সু্যোগ বুঝে একটা ছুটির দিনে সেজে গুজে খুঁটি পুজো করলেই হল। সেটাই একালের দস্তুর।

body1_101218115137.jpgতখন গুটিকয় ধনী গেরস্থ বাড়িতে পুজো হত [ছবি: ইন্ডিয়াটুডে]

কাঠামো পূজা হয়ে গেলে ছুরি-কাঁচি-রঙিন কাগজ-রাংতা-জরি-বাঁশের চটা-দড়ি-দড়া-গঁদের আঠা নিয়ে চিত্রকরদের কাজ শুরু। তখন আর ব্যস্ততার অন্ত থাকত না। বাদশাহী আমল পাল্টে এল কোম্পানি তথা ইংরেজ আমল। বাবুদের হাতে লুটের পয়সা কুট কুট করছে। অনাড়ম্বর ভক্তি উপচারে পটের পুজোয় বাবুদের আর মন ভরে না। গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বসত -- শুরু হল থাম খিলানের দুগ্গা দালান তৈরী, না হলে যে বৈভব দেখানো যায় না, সেখানে কত মান্নি গন্নি সাহেব সুবো আসবে, লোকে ধন্নি ধন্নি করবে , তবে না? দূর্গা দালানে তো শুরু হোল মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি পুজার আয়োজন| সেই থেকে শুরু হলো স্নান যাত্রার দিনে কাঠামো পূজার চল। তা না হয় হল, কিন্তু মূর্তি কী রূপ হবে? পুজা উপচারই বা কেমন?

পণ্ডিতরা নস্য টেনে বিধান দিলেন মাভৈঃ। উপাসক শাক্ত হলে দেবী মূর্তির গাত্রবর্ণ হবে অতসী ফুলের ন্যায়। স্ফীত নাসা, চোখ টানা টানা মোঙ্গলীয় ধাঁচের, ভালে তৃতীয় নয়ন করবে ধক ধক। সিংহ হবে সিংহের ন্যায় পাঁশুটে হলদে, অসুরের গাত্রবর্ণ তামাটে, চালচিত্র হবে একচালা। চলচিত্রের সর্বোচ্চে থাকবেন সয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। পুজো হতে হবে তন্ত্র মতে, বলিদান বিধেয়। শুরু হলো শ্রীশ্রী দুর্গা পুজো| নিখুঁত কচি পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খাইয়ে রণহুঙ্কারে “বধ বধ কাম ক্রোধ মদ……” মন্ত্র উচ্চারণে হাঁড়িকাঠে ফেলে ঘচাং ফু। মাকে মুন্ডু দিয়ে ধর নিয়ে বাবুদের মাংস মোচ্ছব। কথামৃতে এক জায়গায় আছে -- এক বাবুর কথা, যাঁর বাড়িতে দুগ্গোচ্ছবে পাঁঠা বলি হত, তারপর বাবুর দাঁত পড়ে গেলে বলিও বন্ধ হয়ে যায়, কারণ বাবু যে আর চিবোতে পারেন না। কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের হুগলী জেলার নন্দনপুরের আদি বাড়িতে দেবী দুর্গা চণ্ডিকা রূপে পূজিতা হন। মূর্তির রং হয় উজ্জ্বল তাম্রবর্ণ।

আজও নন্দনপুরের রায় বাড়িতে পুরানো প্রথা মেনে দেবী দুর্গার গাত্রবর্ণ প্রস্তুত করা হয় শেফালী ফুলের বোঁটা থেকে। অসুরের গাত্রবর্ণ কালচে ধরনের, তবে সিংহ কিন্তু সিংহের ন্যায় পাঁশুটে হলদে রঙের।    

এতো গেল শাক্ত মতে মূর্তি আর চলচিত্রের বর্ণনা| যাঁদের বৈষ্ণবমতে পূজা হবে তাঁদের দুর্গা প্রতিমার গাত্রবর্ণও অতসী ফুলের মতো তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ, চোখ টানা টানা, স্ফীত নাসা, কিন্ত সিংহ হবে সাদা রঙের তায় আবার হয়বদন আর অসুর হবে সবুজ রঙের। চালচিত্র হয় তিনটি  গম্বুজাকৃতি মঠচৌরি বা তিন থাকের মার্কিনি চালের| পশুবলি? নৈব নৈব চ। তাহলে ওইসব কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্যের বধ কি নিষিদ্ধ? মোটেও না। তার জন্য তোলা আছে চালের লতানো লতার চালকুমড়ো আর ক্ষেতের আখ।

body2_101218115408.jpgবারোয়ারি পুজো এখন পাড়ার মোড়ে মোড়ে [ছবি: পিটিআই]

সে সব পাল্টাতে পাল্টাতে বারোয়ারির পুজোয় দেখা গেল অন্য ভিন্নতা| দেবী মূর্তির মুখ মাতৃ সুষমা হারিয়ে হতে লাগলো সে সময়ের জনপ্রিয় চলচিত্র শিল্পীদের আদলে, দেহ বল্লরী দেবিত্ব হারিয়ে হয়ে উঠল উদ্দীপক। মাটির পোশাক থেকে ডাকের সাজ, বুলেনের সাজ। এখন আবার মিক্স অ্যান্ড ম্যাচের যুগ। কুমারটুলি পৌঁছে যাচ্ছেন ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্র পল, হয়ত বা মাকে আরও ফ্য়াশনিস্ত বানাবেন বলে| এখন আবার কয়েক দশকের নতুন হুজুগ থিমের ঠাকুর। থিম সব প্যান্ডেল আর আবহ নির্মাণে। শুরুটা হল ভাঁড়ের ঠাকুর, পেরেকের ঠাকুর, শিশি বোতলের ঠাকুর, মায় লজেন্স-বিস্কুটের ঠাকুর দিয়ে। তারপর হল কী, অমুক বাবু, এবার পুজোয় যাবেন নাকি তমুক যায়গায় বেড়াতে?

তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, উত্তর-আধুনিক তথা সাম্প্রতিক বছর গুলোয় বেশ কেয়কটি পূজা উদ্যোক্তা ফিরিয়ে এনেছেন, আমাদের দেখার, চেনার সু্যোগ করে দিয়েছেন  এই বাংলার হারিয়ে যাওয়া আর ভিন প্রদেশের এমন কি ভিন দেশের শিল্পশৈলীকে। সাজসজ্জায় এই যে এত খরচ তাকে কোনও মতেই অপব্যয় বলা যাবে না তার কারণ দূর দুরান্তের অজ্ঞাত অখ্যাত শিল্পীদের সারা বছরের রোজগার দেয়। বিলুপ্তপ্রায় শিল্পশৈলীকে নবজীবন দেয়। তবে হ্যাঁ পূজার বেলায় নমঃ নমঃ। পুরোহিতের পাওনা গণ্ডায় ফল মিষ্টি, নৈবেদ্যের চাল কলা কাপড়ে কার্পণ্যের অভাব নেই।

অবশ্য  পুরুত ঠাকুরের উচ্চারণও তথৈবচ- “…… সিবেসর ব্যর্থ শাধিকে শর নেত্র বকে গৌরী……” ইত্যাদি প্রভৃতি। আধুনিক কালের উদ্যোক্তাদের বর্ণপরিচয় নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ জাগে, যখন দেখি পাড়ায় পাড়ায় রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা বাঁধা কাপড়ে থুরি ব্যানারে বা ফ্লেক্সে, চাঁদার বিলে সর্বজনীন-এর যায়গায় লেখা সার্বজনীন।  কিছু বললেই বলবে, ক্কাকু, ও কিছু না। বোঝা গেলেই হল। জত্তসব, ... অমুকের দল, এখনও কাঠি করছে। কপচাচ্ছে, ...।

সে যাই হোক, মা সব সময়েই মা। তিনি যে রূপেই মর্তে আগমন করুন আমরা বিজয়াদশমীর দিন বেল পাতায় লাল চন্দন দিয়ে শ্রীশ্রী দুর্গা সহায় লিখে প্রতিমাকে ঘিরে অঞ্জলি দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করে বলব -  

পুত্রায়ুরধনবৃদ্ধথং স্থাপিতাসী ময়াজলে

গচ্ছ গচ্ছ গৃহে গচ্ছ যত্র দেব মহেশ্বর

সম্বৎসরে বীতীতেতু তু পুনরাগমনায় চ।।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

PALLAB MUKHOPADHYAY PALLAB MUKHOPADHYAY

The writer is the former Public Relations Officer, South Eastern Railway and an avid historian.

Comment