যথেষ্ট হয়েছে, চলচ্চিত্র সমালোচনার নামে রাজনৈতিক ধারাবিবরণী চাই না

নেপথ্য কাহিনির পরিবর্তে ছবির নানা দিক নিয়ে সমালোচনা করা উচিত

 |  4-minute read |   12-02-2019
  • Total Shares

বিশেষজ্ঞ চলচ্চিত্র সমালোচক কোথাওই নেই, বিশেষ করে ভারতে। সাধারণ ভাবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিনোদন জগতের সংবাদের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকরাই চলচ্চিত্র সমালোচনা করে থাকেন। আমি নির্দিষ্ট ভাবে কোনও সংবাদপ্রতিষ্ঠানের কথা বলছি না, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একই রকম।

সব চলচ্চিত্র সমালোচনাই যে একপেশে, সে কথা ভারতে সকলেই জানেন-বোঝেন, তবে কেউ এ নিয়ে বলেন না, মানে যাকে বলে ওপেন সিক্রেট।

বেশির ভাগ লোকই মনে করেন যে কোনও কোনও চলচ্চিত্র সমালোচনা হয় টাকার বিনিময়ে, কোনও কোনও সমালোচনা বাড়তি স্টার পেয়ে যায়, কারণ ওই ছবির নায়ক বা নায়িকা সমালোচকের নিকটজন। প্রযোজনাকারী সংস্থা কোনও কোনও সময় সংবাদমাধ্যমকে উপঢৌকন দেয়। তবে এমন অনেক সমালোচকও আছেন যাঁরা বলিউডের ছবির সমালোচনা করেন শিল্পসমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। সব দিক বিচার করে একটা কথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, বেশিরভাগ সমালোচনাই নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে করা হয় না। অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত ভারতে এমন কোনও চলচ্চিত্র সমালোচক নেই যাঁকে আমরা নির্ভরযোগ্য বলে মনে করতে পারি।

তবে আরও এক ধরনের চলচ্চিত্র সমালোচনা পরবর্তীকালে শুরু হয়েছে যা অন্য সব ধরনের চলচ্চিত্র সমালোচনার তুলনায় একেবারেই ভিন্ন – তা হল একটি নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে সমালোচনা।

এই ধরনের 'আদর্শগত' চলচ্চিত্র সমালোচনার ধরনটি বছর পাঁচেক আগেও অজানা ছিল, তবে পরে দেখা গেল এটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় ধাঁচ হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র সমালোচকরা খুব দ্রুতই চলচ্চিত্রটিকে ‘শাসকদলের হয়ে সওয়াল করছে’ বা 'রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপন' বলে ছাপ মেরে দিচ্ছে।

মজার কথা হল, সম্প্রতি যে সব ছবি মুক্তি পেয়েছে সেগুলি জীবনচরিত নির্ভর ছবি হোক বা কোনও ঘটনা অবলম্বনেই হয়ে থাক, সেগুলিকে 'রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপন' লেবেল সেঁটে দেওয়া হচ্ছে।

collage_013119021923_021219082416.jpgচলচ্চিত্র সমালোচনায় রাজনৈতিক মতবাদ দেওয়ার কোনও জায়গাই নেই। (ছবি: ইউটিউব স্ক্রিনগ্র্যাব)

এই সব ছবির তালিকায় রয়েছে উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, মণিকর্ণিকা: দ্য কুইন অফ ঝাঁসি, দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টারথ্যাকারে

কয়েকজন 'আদর্শগত' সমালোচকরা জনসমক্ষে ঘোষণা করে দেন যে অমুকের কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে, কারণ ছবির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি তমুকের ঘনিষ্ঠ – আসলে তিনি ধরেই নেন যে তিনি যে কথা বলবেন, পাঠকরাও সে কথা মেনে নেবেন। পাঠকরা এ ব্যাপারে শুধুমাত্র ভিন্ন মতই পোষণ করেন না, বাস্তবে তাঁরা গাঁটের কড়ি খরচ করে টিকিট কাটেন এবং পুরো ছবিটি দেখেন।

উল্টো দিকে, পেজ-ভিউর নিম্নমুখিতা (যদি না কোনও অ্যাপ ব্যবহার করতে চান, তা হলে খুব সহজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নজর রেখে সমস্যাগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন) দেখলেই বুঝতে পারবেন যে এই ধরনের সমালোচনা পাঠক হারাচ্ছে।

সাধারণ পাঠকের অপছন্দের কথা আমি বলতে চাইছি না, আমার কথা হল, চলচ্চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শের মিশেল দেওয়া বেশ বিপজ্জনক। কয়েকটি ক্ষেত্রে সমালোচক নিজের বিশ্বাসে এতটাই অন্ধ (বলা যেতে পারে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রবল অপছন্দ করা) যে তাঁরা সোজাসুজি সেই ছবিটিকে বাতিলের দলে ফেলে দিচ্ছেন কারণ ছবিটি একটি রাজনৈতিক দল বা কোনও ব্যক্তির আলোকপাত করছে।

এর ফল কী হচ্ছে? সমালোচনাটি অত্যন্ত সাদামাটা হচ্ছে এবং তা দেখা মাত্রই খারিজ করে দিচ্ছেন পাঠক, তাঁরা সমালোচকের সঙ্গে একমত হচ্ছেন না।

রাজনীতি নিয়ে সারা ভারতে নিরন্তর আলোচনা হয়েই চলেছে তাই চলচ্চিত্র সমালোচনার সময় নতুন করে আর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা কেউ শুনতে চাইছেন না।

আমার মতে, চলচ্চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রে কোনও ওয়েবপেজে রাজনৈতিক ধারাবিবরণী দেওয়া যেতে পারে কিনা বা চলচ্চিত্র সমালোচনার ভেক ধারণ করে রাজনৈতিক ধারাবিবরণী দেওয়া চলবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হওয়া দরকার।

বাস্তব হল, যখনই কোনও ছবিকে বিজেপি অথবা আরএসএস-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপন বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে তখনই সেই সব ছবি দেখতে সিনেমাহল ভেঙে পড়েছে।

আমি যে সব ছবির কথা বলেছি তার কোনওটাই মুক্তি পাওয়ার সময় হাউসফুল হচ্ছিল না, কিন্তু যত দিন গেছে এই সব ছবির শোয়ে দর্শকসংখ্যা তত বেড়েছে। এর অর্থ হল, পছন্দ বিষটি হল মুখের কথা – তা নিয়ে নীরব থাকাই শ্রেয়, এ নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক মতালম্বীরই ইন্টারনেটে সমালোচনা করুন।

এই সব রাজনৈতিক রং লাগা সমালোচনা পড়ে যাঁরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন তেমন কয়েকজনের মধ্যে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি। যে সব ওয়েবসাইট একটু বাম-ঘেঁষা তাঁরা রি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, মণিকর্ণিকা: দ্য কুইন অফ ঝাঁসির মতো ছবির তীব্র পরিপন্থী এবং এই সব ছবিকে প্রজ্ঞাপন বলে মনে করেন, উল্টোদিকে যাঁরা দক্ষিণপন্থী তাঁরা এই সব ছবির তারিফ করেন। তাই শুধু যে সমালোচকরা চলচ্চিত্র সমালোচনা বিভাগে রাজনৈতিক মন্তব্য করছেন তা নয়, প্রকাশকের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিও এই বিভাগে প্রতিফলিত হয়।

এর ফলে ছবির গল্পটা কেমন, তার চিত্রনাট্য কেমন, দৃশ্যায়ন কেমন হয়েছে, পোস্ট-প্রোডাকশন কেমন হয়েছে – চলচ্চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রে এই সব বিষয়গুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না – মানে যে ভাবে বাণিজ্যিক ছবিগুলির সমালোচনা হওয়া উচিত সে ভাবে তা হচ্ছে না।

হায় রে, এই ধরনের চলচ্চিত্র সমালোচকরা এখন লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছেন।

নাকি ইতিমধ্যেই তাঁরা বিলুপ্ত হয়ে গেছেন?

লেখাটি পড়ুন  ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000
Comment