আমেদাবাদের মতো কলকাতাও কেন বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী শহরের মর্যাদা পেতে পারে
ব্রিটিশরা কবে এসেছে তা দিয়ে শহরের বয়স নির্ধারণ করা ঠিক নয়
- Total Shares
বিশ্বের যে সব দেশ প্রথম সভ্যতার আলো দেখেছিল, সেই সব দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে সম্প্রতি চিনে একটি আলোচনাসভায় যোগ দিতে গিয়েছিলাম। ভারতে যেমন প্রাচীন কালে সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল সেই একই ভাবে বর্তমান ইরাকের ব্যাবিলনেও সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল। একই ভাবে মেক্সিকোয় মায়া সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল। নিজেদের সভ্যতার কথা বলতেই ভারত ছাড়াও সেই আলোচনাসভায় যোগ দেন মিশর, চিন, গ্রিস, জার্মানি, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ইজরায়েল, ইতালি, মেক্সিকো ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর প্রতিনিধিরা।
ঢোলাবীরা: সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল ভারতে (উইকিমিডিয়া কমনস)
এই সব দেশে যাঁরা বিশেষ করে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সংশ্লিষ্ট ইতিহাস অথবা জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলির সংস্কৃতিমন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা এবং ইউনেস্কো ও আইকম (ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মিউজিয়াম)-এর প্রধানরা এখানে প্রতিনিধিত্ব করেন। ভারত থেকে ছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব (জাদুঘর) নিরুপমা কোত্রু, মহারাজা সওয়াই মান সিং সিটি প্যালেস জাদুঘরের ডায়রেক্টর কনসাল্ট্যান্ট ও অধ্যাপক অজিত কুমার (প্রাচীনকালের বাণিজ্য নিয়ে তাঁর ব্যুৎপত্তি রয়েছে)। এবং ভারতীয় সংগ্রহালয়ের নির্দেশক হিসাবে আমিও সেখানে যোগ দিয়েছিলাম।
“মডার্ন আরবন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেক্টিং হেরিরেজ” এবং আরেকটি হল “রেস্টরিং অ্যান্ড প্রোটেক্টিং অফ হেরিটেজ অফ এনসিয়েন্ট ক্যাপিটাল” – দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়েই আমি বলেছি। মডারেটরও ছিলাম আমিই। তিনদিনের শেষ দিনে সমস্ত বিষয়টির সংক্ষিপ্তসার বলার ভার যে ছ’জনের উপরে ন্যস্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে আমিও অন্যতম। এই আলোচনার আয়োজক ছিল প্যালেস মিউজিয়াম, ফরবিডন সিটি। এটি বেজিংয়ের প্রাচীনতম স্থান। এই স্থানে রাজারা থাকতেন বলে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই এই নাম।
আলোচনাসভায় লেখক
এই আলোচনা থেকে আমার মনে হয়েছে যে আমরা যদি চেষ্টা করি তা হলে কলকাতাও ঐতিহ্যশালী শহরের মর্যাদা পেতে পারে। ইরানের ইয়েড্ডা নামে একটি স্থান আছে যেটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তারা যার ভিত্তিতে এই মর্যাদা পেয়েছে আমাদের কলকাতা শহরেরও সেই সমস্ত ভিত্তিই রয়েছে।
কলকাতায় সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান। এখানে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমান, পারসি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জরাথ্রুস্টীয়, আর্মেনিয়ানরা আছেন এবং তাঁদের সংস্কৃতির স্থাপত্যও রয়েছে। তা ছাড়া এখানে ফরাসি, ডাচ, ড্যানিসদের সংস্কৃতিও দেখা যায়। এটি জীবন্ত শহর। ইয়েড্ডার সঙ্গে এই দুই জায়গাতেই মিল কলকাতার। কলকাতার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও রয়েছে যা অন্তত ২০০০ থেকে ২৫০০ বছরের পুরোনো। ইংরেজরা কবে কলকাতায় এসেছে তা দিয়ে কলকাতার বয়স বিচার করা ঠিক নয়। কলাকাতার সংস্কৃতি মাত্র ৩০০ বছরের পুরনো, এ কথা আমি মানি না।
এই শহরের পরম্পরা সুপ্রাচীন (পিটিআই)
শহরের বয়স নির্ণয় করতে হবে পুরাতত্ত্ব দিয়ে, শহরে বিদেশিদের আগমন দিয়ে নয়। তারা আসার আগেও এই শহরে বিভিন্ন পরিবার থাকত। শহরের ২০০০ বছরের ইতিহাস তো পাওয়াই যায়। গঙ্গার নিম্ন অববাবাহিকায় থাকা এই স্থানের অন্য একটি গুরুত্বও রয়েছে। এই সব তথ্য একত্রিত করে আমরা যদি চেষ্টা করি তা হলে এই শহরও ঐতিহ্যশালী শহরের মর্যাদা পেতেই পারে।
ঐতিহ্যশালী শহরের মর্যাদা পেতে গেলে তার প্রথম ধাপই হচ্ছে একটানা সভ্যতার বিকাশ বা কন্টিনিউটি অফ সিভিলাইজেশন। কলকাতার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। কোনও শহরে যে সব স্থাপত্য রয়েছে তা যদি আধুনিকীরণের সঙ্গে না বদলে থাকে তবে সেটিকে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে গণ্য করা হয়। এই শহরে এমন অনেক স্থাপত্য রয়েছে যা বছরের পর বছর ধরে একই ভাবে রয়েছে। বহু ভবনেরই কোনও পরিবর্তন ঘটেনি গত আড়াইশো-তিনশো বছর ধরে। সেই সব ভবনের সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
কলকাতায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থান (পিটিআই)
কলকাতা ছাড়াও গঙ্গার তীরে যে সব সাংস্কৃতিত ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে, ধর্মস্থান রয়েছে ও বিভিন্ন ধর্মের পরম্পরা ছিল তা এখনও রয়েছে। কলকাতা এমন এক শহর যা সারা বিশ্বকে আকর্ষিত করেছ। একে আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালু বলা চলে। যে সব শহরের এই আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালু থাকে তাকেই এই মর্যাদা দেওয়া হয়, ঐতিহ্যশালী শহরের মর্যাদা দেওয়া হয়।
মহাকরণ: ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন (পিটিআই)
সম্প্রতি গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবরাকেও এই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
যদি এই শহরের পুরাতত্ত্ববিদ, স্থপতি, জাদুঘরের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁরা সকলে যদি ভারত সরকারের মাধ্যমে একযোগে এই প্রচেষ্টা করে তা হলে আমার বিশ্বাস কলকাতা শহরও এই মর্যাদা পেতে পারে। কারণ কলকাতা শহর এই মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।